'দাদা অঙ্ক কী কঠিন…', 'চন্দ্রবিন্দু'র এই গানটা কে না শোনেননি
'দাদা অঙ্ক কী কঠিন…', 'চন্দ্রবিন্দু'র এই গানটা কে না শোনেননি। ক্লাস এইট-নাইনের অঙ্ক কষতে বসলে অনেক বাচ্চাই গুনগুন করে এই গানটা গেয়ে ওঠে। হাজার চেষ্টার পর অঙ্ক না মিললে মাথা চুলকাতে বসে অনেকেই। অঙ্কভীতি অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর মনেই কাজ করে।
জবজবে করে তেল মাখানো এক খানা বাঁশ। সেই বাঁশ দিয়ে একটা বাঁদর উঠছে আবার নেমে যাচ্ছে। কতটা সে উঠল আর কতটা নামল এ নিয়ে সকলকেই হিমশিম খেতে হয়েছে কম বেশি। চাল-ডাল, জল, দুধ নিয়ে সে কী নাজেহাল কান্ড! বাপরে বাপ এ যে অঙ্কের ক্লাস!
কে সি নাগের সেই সব বিখ্যাত পাটিগণিতের অঙ্ক যা রাত্রে শুয়ে পড়ার পরও মাথায় ঘুরপাক খেতো। স্কুল ও কলেজ পেরুনো মধ্যবয়সীদের দুঃস্বপ্নে বার বার ফিরে আসে কেশব চন্দ্রের নাম ৷ কারণ স্কুলস্মৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে সাদা পৃষ্ঠায় কালো অক্ষরে পাটীগণিত। বর্তমান প্রজন্ম হয়তো তাঁর নামও শোনেনি।
১৮৯৩ সালের ১০ জুলাই, রথযাত্রার দিন হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন কেশব চন্দ্র নাগ। পিতা রঘুনাথ নাগ ও মাতা ক্ষীরোদাসুন্দরী। শৈশবেই পিতৃহারা হন। মা ক্ষীরোদাসুন্দরীই সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব পালন করেন। পড়াশোনা শুরু হয় গুড়াপের একমাত্র বাংলা বিদ্যালয়ে। সপ্তম শ্রেণী থেকে বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরের ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা। নবম শ্রেণীতে আবার বিদ্যালয় পরিবর্তন, কিষেণগঞ্জ হাইস্কুল। এখান থেকেই ১৯১২ সালের প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতায় এসে ১৯১৪ সালে রিপন কলেজ ( অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে আইএসসি প্রথম বিভাগে পাশ করেন।
ছোট্ট ছেলে কেশবকে কাকা মুখে মুখে ধরছেন পৌনে তেরোর নামতা। ছেলেও বলছে ঠিক, নির্ভুল। ছোটবেলার কেশব দেখছে এক ফড়ে আর আড়তদারের ইলিশের দরদস্তুর। গুঁফো আড়তদারবাবুটি ফড়েকে জিজ্ঞেস করছেন, ইলিশের মণ দেড়শো টাকা হলে একটা আড়াইসেরি ইলিশের দাম কত পড়বে? ঠোঁটের গোড়ায় নিশপিশ করতে থাকা উত্তর ফস করে দিয়ে বসছে গঙ্গার পাড়ে বসে থাকা বালক কেশবচন্দ্র— ন’টাকা ছ’আনা! গোঁফবাবু ছেলের নামধামইস্কুল জেনে নিয়ে বলছেন, স্কুলের হেডস্যরকে আমার নাম বোলো, ‘আশুতোষ মুখোপাধ্যায়’, পড়াশোনার খরচা মায় বইখাতাটাও ফ্রি হয়ে যাবে!
রটে যা তা সব সত্য নয়। এই সবই কে সি নাগকে ঘিরে কিংবদন্তি। আসল মানুষটা কলকাতা এসেছিলেন বড় হয়ে কলেজে ভর্তির সময়। উঠেছিলেন মির্জাপুর স্ট্রিটে বড়দা সত্যচরণ নাগের মেসে, ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন রিপন কলেজে (এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ)। তাঁর স্কুলবেলাও গোলাপগন্ধী নয়। বর্ধমানের গুড়াপের ছেলে সিক্স অবধি পড়েছেন গ্রামেরই ইস্কুলে, পরের দু’বছর তিন মাইল দূরের ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর স্কুলে। রোজ তিন-তিন ছ’মাইল পথ হেঁটে যাওয়া-আসা। রাস্তাও বলিহারি, গ্রীষ্মে এক পা ধুলো, বর্ষায় হাঁটু-ডোবা কাদা। শীতের বেলা বাড়ি ফিরতে গড়িয়ে যেত সন্ধেয়। এক দিন সন্ধেয় নির্জন পথে হেঁটে ফিরছেন, হঠাৎ খটাস খটাস শব্দ। যত এগোনো, শব্দও বাড়ে। নির্ঘাত ভূত! ছেলে তো পায়ের চটিজোড়া খুলে দে দৌড়! তার পরেই বোঝা গেল শব্দরহস্য। চলতি পথে চটির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল ছোট ছোট নুড়ি, পা ফেলতে তারাই এক-একটা বেরিয়ে আসছিল ছিটকে, আর শব্দ হচ্ছিল ও রকম। ইস্কুলবেলার সেই ঘটনাই নাকি পরে তাঁর বইয়ের বিখ্যাত ‘টাইম অ্যান্ড ডিসট্যান্স’-এর অঙ্কগুলোর শেকড়!
জীবন তাঁকে নিয়ে গিয়েছে বিচিত্র পথে। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন কিষেনগঞ্জের স্কুল থেকে। তাঁর মেজদা তখন কাজের সূত্রে সেখানে। এই মেজদা, পরে কলকাতায় থাকা বড়দা একে একে মারা গেলে কেশবচন্দ্রের উপরেই এসে পড়ে সংসারের ভার। ভবিষ্যতের প্রবাদপ্রতিম অঙ্কশিক্ষক খুব কম বয়সে স্কুলশিক্ষকতার চাকরি নেন। গোড়ায় নিজের পড়া দুই স্কুলে, পরে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে। সেখানে চাকরি পাওয়াও এক গল্প। সে আমলে বহরমপুরের বিখ্যাত স্কুলটির হর্তাকর্তা ছিলেন সাহেবরা। কেশবচন্দ্রের ইন্টারভিউ হয়েছিল কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেলে। সাহেবরা চমৎকৃত হয়েছিলেন ছিপছিপে তরুণের আচরণের ঋজুতায়। ভাল মাটি, জল-হাওয়া পেলে প্রতিভাও বাড়ে তরতরিয়ে, বহরমপুর কৃষ্ণনাথ স্কুল থেকেই নাম ছড়িয়েছিল তরুণ শিক্ষক কেশবচন্দ্রের। মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ঘরের ছেলেদের টিউটর নিযুক্ত করেছিলেন তাঁকে। তাঁর জন্য খুলে দিয়েছিলেন রাজবাড়ির বিশাল লাইব্রেরি। তাতে কতশত বিজ্ঞানের বই, দেশবিদেশের পত্রপত্রিকা! কেশবচন্দ্র পরে বলেছিলেন, পরে অঙ্কের বই লেখার সময় কাজে দিয়েছিল সেই বই-ভরা লাইব্রেরিতে তন্নিষ্ঠ পাঠস্মৃতি।
১৯২৪ থেকে ১৯৬০, ‘মিত্র স্কুল’ দেখেছিল এক জীবন্ত কিংবদন্তিকে। শুধু কে সি নাগ কেন, বিখ্যাত সব মাস্টারমশাইরা তখন পড়ান মিত্র ইনস্টিটিউশনে। ম্যাট্রিকে প্রথম দিকের র্যাঙ্কগুলো বাঁধা থাকত স্কুলের ছেলেদের, পূর্ণ সিনেমাহলের কাছে মিষ্টির দোকানের বিখ্যাত ‘মাতৃভোগ’ রেজ়াল্টের দিন নাম পাল্টে হয়ে যেত ‘মিত্রভোগ’। কোন মাস্টারমশাইদের শ্রমের ফসল ঘরে তুলত ইস্কুল? বাংলায় কবিশেখর কালিদাস রায়, সংস্কৃতে পণ্ডিত জানকীনাথ শাস্ত্রী, ভূগোলে যতীন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র, আর্টে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী! কবিশেখরই তাঁকে প্রথম বলেছিলেন অঙ্কের বই লেখার কথা। তোমার ক্লাস ছেলেরা গোগ্রাসে গেলে, তুমি বই লিখবে না?
কেশবচন্দ্র কলকাতায় থাকতেন ভবানীপুরের ১২ নম্বর রসা রোডের মেসে, সেখানে বসেই লিখে ফেললেন পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য ‘নব পাটীগণিত’। পরে পরিচয় ক্যালকাটা বুক হাউস-এর কর্ণধার পরেশচন্দ্র ভাওয়ালের সঙ্গে। এক দিন তিনি কেশবচন্দ্রের ঘরে এসে দেখেন, টেবিলের উপরে মোটা একটা খাতায় পাতার পর পাতা জুড়ে অঙ্ক। শুধু অঙ্কই নয়, কোন অঙ্ক কী ভাবে, কত রকম ভাবে করা যাবে, গুছিয়ে লেখা। পরেশবাবু চাইলেন সেই খাতা, বই আকারে ছাপবেন। কেশবচন্দ্র কিছুতেই দিতে রাজি নন, ছেলেমেয়েরা অঙ্ক শেখার আগে অঙ্কের ‘মানে বই’ হাতে পেলে বিপদ। পরেশবাবু বোঝালেন, অঙ্কের শিক্ষকদের জন্য এ খুবই দরকারি বই হবে, তাঁদের জন্য অন্তত প্রকাশ করা দরকার। রাজি হলেন কেশবচন্দ্র। ১৯৪২-এ বেরোল ‘ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স’। ‘নব পাটীগণিত’-এর মতোই, মার্কেট ও মন, দুই-ই জয় করল তা। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মোট ৪২টা বই লিখেছেন, ‘অঙ্কের বই মানেই কে সি নাগ’ লব্জ হয়ে গিয়েছে তত দিনে।
তিনি মহাবিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে গৃহশিক্ষকতার শুরু করেন। ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে থার্ড মাস্টার হিসাবে কর্মজীবনের শুরু। কিছুদিনের মধ্যেই সংসারের দায়িত্ব সামলেও চাকরি ছেড়ে অঙ্ক ও সংস্কৃত নিয়ে বিএ পাশ করেন। এরপর অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে কিষেণগঞ্জ হাইস্কুল যোগ দিলেন। পরবর্তীতে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে যোগ দেন। অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে তার সুখ্যাতি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানে আসলে তিনিই কেশবচন্দ্রকে ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে নিয়ে আসেন। সুদীর্ঘ কর্মজীবন শেষে এখান থেকেই তিনি প্রধানশিক্ষক হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন।
ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশন, যে স্কুলে অঙ্কের মাস্টারমশাই ও পরে হেডমাস্টারও ছিলেন কে সি নাগ, সেখানকার চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক কি তার পরের দিকের ছাত্ররা কিন্তু জোর প্রতিবাদ করবেন। খোদ কে সি নাগের অঙ্ক ক্লাস করেছেন তাঁরা, জানেন, অঙ্ককে কেমন সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন মাস্টারমশাই। কেমন ছিল সে পদ্ধতি? ক্লাসে এসে গম্ভীর গলায় বলতেন ‘সিমপ্লিফাই’, আর মুখে বলতে বলতে বোর্ডে লিখে দিতেন অঙ্কটা। তার পর কোনও ছাত্রকে ডেকে বোর্ডে কষতে বলতেন। পুরোটা করতে দিতেন, ভুল করতে দিতেন। তার পর ভুল-হওয়া অংশটুকু চিহ্নিত করে, মুছে দিয়ে, ঠিক পথে নিয়ে যেতেন অঙ্কটাকে। একটা অঙ্ক ঠিক হলেই হল না। একই রকম, বা একই গোছের আরও অঙ্ক তক্ষুনি করতে দিতেন। এতে ছাত্রদের মনে অঙ্কগুলো করার তরিকা, বা এ ধরনের অঙ্কে যে যে জায়গায় ভুল হতে পারে সেগুলো গেঁথে থাকত, তারা আর ভুল করত না। বীজগণিত নয়, পাটিগণিতের পদ্ধতিতে সমাধান করতে বলতেন— তাতে যুক্তির বোধ বাড়ে। সোজা থেকে ক্রমশ কঠিন, এই ভাবে অঙ্ক করাতেন। কে সি নাগের বই থেকে অঙ্ক করা ছাত্রমাত্রেই জানে, অনুশীলনীর গোড়ার অঙ্কগুলো সোজা, পঁচিশ-তিরিশ দাগের পর থেকে জব্বর কঠিন। কিন্তু ওঁর ক্লাসে অঙ্ক শিখেছে যারা, তাদের কাছে জলভাত। অঙ্ক তো অঙ্ক নয়, ভালবাসা। দৈনিক বসুমতীর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অঙ্ক কি জুজু না কি? ভালবাসলেই অঙ্ক সহজ হয়ে যায়।
অঙ্কের মাস্টারমশাই মানেই রাগী, গম্ভীর, নীরস একটা অবয়ব মনে পড়ে সবার। কে সি নাগও কি তেমনই ছিলেন? বকুনি দিতেন? মারতেন? মিত্র ইন্সটিটিউশনের প্রাক্তনীদের স্মৃতিচারণে তাঁদের ‘স্যর’-এর বর্ণনা আছে। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে, গায়ে আলোয়ান, খদ্দরের পাঞ্জাবি-ধুতিতে গটগট হাঁটতেন। ক্লাসে অঙ্ক না পারলে ‘গাধা’ সম্বোধন বিরল ছিল না, তা বলে পিঠে ধাঁইধপাধপ নয়। কারণ অঙ্ক কী কায়দায় শেখানো হচ্ছে তা তো বলাই হল! হেডমাস্টারের ঘর থেকে খেয়াল রাখতেন, পাশের মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে কোন ছেলে কত কড়া ট্যাকল করছে। পরে ডেকে পাঠিয়ে অভিনব শাস্তি: স্কুলের পিছল উঠোন পরিষ্কার, দু’দিন প্যারালাল বার প্র্যাকটিস, বা জ্যামিতির রাইডার সল্ভ করতে হবে! ক্লাসে মাঝে মাঝে পাওয়া যেত তাঁর রসবোধের ঝলক। একটি বৃত্তের কেন্দ্র O থেকে বৃত্তের পরিধির উপরে একটি বিন্দু X পর্যন্ত রেখা টেনে জিজ্ঞেস করছেন, তা হলে এটা কী হল? ‘একটি ব্যাসার্ধ’, ‘OX ব্যাসার্ধ’, ‘কেন্দ্র O থেকে X বিন্দু পর্যন্ত OX ব্যাসার্ধ’, নানান উত্তর এল। কিছুতেই খুশি নন। বললেন, ‘‘O X যোগ করে হল অক্স, মানে ষাঁড়!’’ এক দিন ক্লাসে নিজের বইখানা ছাত্রদের দেখিয়ে বললেন, এই বইটা পাঁচ টাকায় বিক্রি করলে আমার কত লাভ থাকবে, বল। ছাত্ররা সবাই বইয়ের দাম জানে, তিন টাকা। সমস্বরে উত্তর, দু’টাকা লাভ! মাস্টারমশাই বললেন, হল না। পাঁচ টাকা। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, সে কী! ‘‘আমাকে তো আর বইটা কিনতে হয়নি, তাই পাঁচ টাকাই লাভ!’’ বলেই মুচকি হাসি। এক বাড়িতে ছাত্র পড়াচ্ছেন, ছেলেটির মাথায় কিছুতেই অঙ্ক ঢোকে না। পাশ দিয়ে ছাত্রের বাবা যাচ্ছিলেন, মাস্টারমশাইকে সৌজন্য-প্রশ্ন করলেন, ছাত্রের পড়াশোনা কেমন বুঝছেন? কেশবচন্দ্রের উত্তর, কালীপুজো আসছে, দেখবেন যেন এ বাইরে বেরিয়ে না যায়, মায়ের সামনে বলি দিয়ে দেবে! সহাস্য অভিভাবক মাস্টারমশাইকে ‘লাঠ্যৌষধি’র প্রয়োগ করতে বলে পা বাড়ালেন।
কলকাতায় প্রথমদিকে রসা রোডে মেসে ভাড়া থাকতেন। পরে ১৯৬৪ সাল থেকে থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার গোবিন্দ ঘোষাল লেনে নিজস্ব বাড়িতে।
মিত্র ইনস্টিটিউশনে কেশবচন্দ্রের সহকর্মী কবিশেখর কালিদাস রায়ের বাড়িতে বসত সাহিত্যিকদের আড্ডা রসচক্র সাহিত্য সংসদ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, জলধর সেনের মতো দিকপাল সাহিত্যিকরা সেখানে নিয়মিত আসতেন। কেশবচন্দ্রও সেখানে অন্যতম সদস্য হয়ে ওঠেন। সম্ভবতঃ কবিশেখর কালিদাস রায়ের প্রধান অনুপ্রেরণায় তিরিশের দশকের মাঝামাঝি প্রকাশক ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্সের মাধ্যমে ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হল নব পাটীগণিত। কিছুদিনের মধ্যেই পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে পড়ে বইটি। পাঠ্যপুস্তক হিসাবেও স্বীকৃত হয়। ১৯৪২ সাল নাগাদ ক্যালকাটা বুক হাউসের পরেশচন্দ্র ভাওয়ালের আগ্রহাতিশয্যে কেশবচন্দ্রের বাঁধানো অঙ্কের খাতা প্রকাশিত হয় অঙ্কের সহায়িকা ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স নামে। বইটি বিশাল জনপ্রিয় হয়।
একে একে আরও অঙ্কের বই প্রকাশিত হয়। ধীরে ধীরে ইংরেজি, হিন্দি, নেপালি, উর্দু ইত্যাদি ভাষায় অনুদিত হয় তার বই।
একে একে আরও অঙ্কের বই প্রকাশিত হয়। ধীরে ধীরে ইংরেজি, হিন্দি, নেপালি, উর্দু ইত্যাদি ভাষায় অনুদিত হয় তার বই।
গণিতের বইয়ের অসম্ভব জনপ্রিয়তা দেখে ১৯৫৫ সালে তিনি নাগ পাবলিশিং হাউস নামে নিজের প্রকাশনা সংস্থা খোলেন। তার বই বিক্রি থেকে পাওয়া রয়্যালটির টাকার একটা বড় অংশ দেয়া হয় দুটি চ্যারিটি ফান্ডে; একটি তার নিজের নামে, অন্যটি তার স্ত্রী লক্ষ্মীমণির নামে।
কেশবচন্দ্র ছিলেন শ্রী শ্রী সারদা মায়ের প্রত্যক্ষ শিষ্য। ১৯২৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত নিয়মিত ডায়েরি লিখেছেন। নাম দিয়েছিলেন রত্ন-বেদী। এতে রয়েছে বহু কবিতা, ভক্তিমূলক গান। আবার একই সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের রসিকতার কথাও। ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য যেখানে যে মন্তব্যটি মনে ধরেছে, টুকে রেখেছেন এই খাতায়। আর খাতার উপরে লিখে রেখেছেন বিনা অনুমতিতে পাঠ নিষেধ। এছাড়া অনুবাদকের ভূমিকায় তিনি স্বামী অভেদানন্দের বহু ইংরাজি বক্তৃতা ও ভগিনী নিবেদিতার লেখা অনুবাদ করেছেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনেও সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণও করেন। গান্ধীজীর 'অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ' আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী এই শিক্ষাবিদ। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য পাওয়া সনির্বন্ধ অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাকে বলতেন 'গণিত শিল্পী'।
শোক এসেছিল জীবনে। প্রথমে পুত্রশোক। তারপর স্ত্রী লক্ষ্মীমণি। তিনি ছিলেন অতুল্য ঘোষের বোন। কাজপাগল অঙ্কের মাস্টারকে তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন অঙ্ক নিয়ে ডুবে থাকার পরিসার। সংসার নিয়ে ভাবতে হত না। স্ত্রী সামলাতেন দৈনন্দিন সাংসারিক খুঁটিনাটি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাই বলেছিলেন, আই লস্ট মাই ফ্রেন্ড।
ব্যক্তিগত শোককে ভুলতে তিনি নিজেকে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বলোকের ছন্দে। নানারকম কর্মদ্যোগে বেছে নিয়েছিলেন আরও বেশি ব্যস্ততা।
গুড়াপের মানুষ তাঁকে চেনে অন্যভাবে। তাঁদের কাছে কেশবচন্দ্র সত্যি ঈশ্বর। গ্রাম ছেড়েছিলেন জীবন শিক্ষা আর জীবিকার টানে। কিন্তু ফিরে ফিরে আসতেন নিজের মায়ের মাটিতে। গুড়াপের উন্নতির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন। গুড়াপের প্রতিবেশী জিতেন্দ্রনাথ রায় — পরবর্তী কালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অষ্টম অধ্যক্ষ স্বামী বিশুদ্ধানন্দ — ছিলেন তাঁর ফ্রেন্ড ফিলসফার অ্যান্ড গাইড। তরুণ কেশবকে তিনিই দেখিয়েছিলেন কর্মযোগের দিশা। গুড়াপে শিক্ষার প্রসারের জন্য ১৯৩২ সালে বাড়ির কাছে প্রতিষ্ঠা করেন গুড়াপ রমণীকান্ত ইনস্টিটিউশন।
জীবনে চাহিদা ছিল খুব কম। অনেকটা সময় কাটিয়েছেন মেসবাড়িতে। কর্মজীবনের একদম শেষে এসে রসা রোডের মেসবাড়ি থেকে উঠে ১৯৬৪ সালে গোবিন্দ ঘোষাল লেনে বাড়ি তৈরি করে থাকতে শুরু করেন।
নিজে তৈরী কর ছিলেন একটি প্রকাশনী সংস্থা। নিজের অঙ্কের বই লেখার পাশাপাশি করেছেন অনুবাদের কাজ। ভগিনী নিবেদিতার লেখা অনুবাদ করেছিলেন।
অঙ্ক ছিল তাঁর জীবন। ভালবাসতেন ফুটবল। মোহনবাগান ক্লাবের কট্টর সমর্থক। তাই মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্যতালিকায় এক নম্বরে গোষ্ঠ পাল, দ্বিতীয় নামটাই তাঁর। উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা ছিল বেজায় প্রিয়, মাঝে মাঝে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখে আসতেন। সঙ্গী নাতনি।
মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন, গজা খুব প্রিয় ছিল। রথের দিন জন্মেছিলেন, প্রতি বছর রথে সন্ধেয় নাগবাড়ির ঘরোয়া স্মরণসভা শেষে আজও সবার জন্য একটা করে গজা বাঁধা। জন্মদিনে ওঁর ছাত্রেরা আসতেন বাড়িতে। অভিনেতা বিকাশ রায় আসতেন গোলাপের তোড়া নিয়ে। যত বছরের জন্মদিন, ততগুলো গোলাপ। ওঁর ছাত্রতালিকায় আছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সকলের স্মৃতিময় লেখাপত্তরে ভরে আছে মাস্টারমশাইয়ের কথা। তাঁর প্রসঙ্গে আর এক ছাত্র সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘অবাক হয়েছিলাম, যাঁকে দেখে ভয় হোত, কড়া ধাতের মানুষ বলে মনে হোত সেই কেশববাবু স্যারই যখন গান করার উৎসাহ দিতেন আমাকে’।
খেলার মাঠে যখন যেতে পারতেন না তখন ধারাবিবরণী শুনতেন রেডিয়োতে। তাঁর প্রথম অসুস্থতার ধাক্কাও আসে সেখান থেকেই। তবে ফুটবলের মাঠে নয়, ক্রিকেটের ময়দানে।
১৯৮৫’র ভারত-পাক কানপুর টেস্ট চলছে। ম্যাচে টানটান উত্তেজনা। সেই উত্তেজনায় কাঁপছে তাঁর ঘরটাও। হঠাৎ সংজ্ঞা হারালেন। হাসপাতল বলল- সেরিব্রাল স্ট্রোক। মৃত্যুর হাত এড়ানো গেলেও দু’বছর শয্যাশায়ী। আর সুস্থতায় ফিরতে পারেননি। প্রয়াত হন ১৯৮৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি।
বরং ছাত্রের ভুলটা ডাস্টার দিয়ে মুছে ফের তাকে নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে বলতেন মা সারদার মন্ত্রশিষ্য কেশবচন্দ্র নাগ।
অঙ্ক, অঙ্ক বইয়ের প্রবল জনপ্রিয়তায় আড়ালে চলে গিয়েছে তাঁর কল্যাণমূলক কাজকর্ম। তবে জন্মস্থান হুগলির গুড়াপে গেজানা যাবে তাঁর অন্য দিক। গণিতচর্চার সঙ্গে নিজের গ্রামকে আলোয় আনার জন্যও নিরলস পরিশ্রম করে গিয়েছেন কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের প্রবাদপ্রতিম এই শিক্ষক। সে কারণে স্থানীয়রা তাঁকে মানেন গুড়াপের নবরূপকার হিসাবে। নিজের গ্রামে স্কুল, গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র, পাঠাগার তৈরি, সব কিছুতেই ছিলেন পথপ্রদর্শক। গুড়াপের নাগপাড়ায় বাড়ির পাশে একটা আশ্রম করেছিলেন তিনি। সেখানে পড়াশোনাও হত। ছিল দাতব্য চিকিৎসালয়। সেই আশ্রম এখন রামকৃষ্ণ মিশনের অধীন। আশ্রমে আজও দুঃস্থ ছাত্রদের দুপুরর খাবারের বন্দোবস্ত করা হয়। চলে নানা সেবামূলক কাজ। কেরালার বন্যাদুর্গতদের কাছে ত্রাণ গিয়েছে আশ্রম থেকেও।
গুড়াপবাসীর কাছে কেসি নাগ ঈশ্বর-পুত্র। বাড়ির কাছে তাঁর নামাঙ্কিত ফলক-ছবি বসিয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন। সেটা রক্ষণাবেক্ষণ করেন তারাই।
এত বছর পেরিয়েও তাঁর অঙ্কের বইয়ের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েনি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয় তো বটেই, বিদেশেও রপ্তানি হয় তাঁর বই। দেশে-বিদেশে থাকা বাঙালিরা তাঁদের পরের প্রজন্মকে অঙ্কের প্রাথমিক পাঠ শেখাতে ভরসা রাখেন কেসি নাগের অঙ্ক বইয়ের উপরে। শোনা যায়, কলকাতায় মেসে থাকার সময়ে যে দোকানে খেতেন, তার মালিক অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে অনেকেই তাঁকে ঠকাতো। সেই মানুষটিকে হিসাব শিখিয়ে তাঁকে ঠকার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র নাগ। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম, বাঙালিকে ‘জীবনের অঙ্ক’ শিখিয়ে চলেছেন বাঙালির চিরকালীন অঙ্কের শিক্ষক কেসি নাগ।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন