আপডেট :

        রিশাদের ব্যাটে বাংলাদেশের সিরিজ জয়

        কণ্ঠশিল্পী খালিদ মারা গেছেন

        বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ

        গুণী প্রধান শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান

        বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃ‌তিতে আইরিশ মন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন

        ইসলামবিদ্বেষ ঠেকাতে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস

        বাংলাদেশ-বৃটেন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫১ বছর: বৃটিশ হাইকমিশনার

        ঢাকায় সুইডিশ রাজকন্যা

        ইরাকের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তা করবে আইএইএ

        বিস্ফোরক মামলায় যুবদল-ছাত্রদলের ৪ নেতা কারাগারে

        জিএসপি সুবিধার মেয়াদ ২০৩২ সাল পর্যন্ত বাড়াতে আয়ারল্যান্ডের সমর্থন চাইলেন প্রধানমন্ত্রী

        ট্রাম্প মানসিকভাবে অসুস্থ: জো বাইডেন

        জৈন্তাপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬

        বিএনপি ইফতার পার্টিতে আল্লাহ-রাসুলের নাম না নিয়ে আওয়ামী লীগের গীবত গায়: প্রধানমন্ত্রী

        মার্কিন গণতন্ত্রকে কটাক্ষ পুতিনের

        শাল্লায় বিল শুকিয়ে মৎস্য আহরণ

        দেশে যুক্তরাষ্ট্রের পাপেট সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত সব নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ: সজীব ওয়াজেদ জয়

        সিএনজি-লেগুনা’র দখলে রাস্তা

        তিন বিভাগে ৩ দিন বৃষ্টির সম্ভাবনা

        এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম

পরিবেশ মানেই খাদ্য আর খাদকের সম্পর্ক

পরিবেশ মানেই খাদ্য আর খাদকের সম্পর্ক

আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস

একটি মেয়ে খুব ছোটবেলা থেকেই একটি ছোট্ট ময়াল সাপ পুষত। যত দিন গেছে সাপটা একটু একটু করে বড় হয়েছে। আর যত বড় হয়েছে ততই ন্যাওটা হয়ে উঠেছে মেয়েটির। মেয়েটি যখন পড়তে বসত, ও মেয়েটির পা বেয়ে উঠে গলা জড়িয়ে ঝুলত। মেয়েটি যখন শুতে‌ যেত,‌ সাপটি তার বিছানায় উঠে মেয়েটির পাশে গিয়ে শুত।
সাপটি যত এ সব করত মেয়েটিও তত দুর্বল হয়ে পড়ত সাপটির উপর। নিজের থেকেও সাপটিকে বেশি ভালবাসতে শুরু করেছিল সে। কিন্তু হঠাৎ একদিন মেয়েটা দেখল, সাপটিকে খাবার দিলেও সাপটি খাচ্ছে না। দু'দিন গেল। চার দিন গেল। ছ'দিন গেল। কিছুতেই কিছু খাচ্ছে না। তা হলে কি ওর শরীর খারাপ হল!
অগত্যা মেয়েটি একদিন এক পশু চিকিৎসকের কাছে গেল। ডাক্তার সব শুনে বললেন,‌ সাপটি কত বড়? মেয়েটি বলল।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, সাপটা কি আপনার খুব কাছাকাছি থাকে?
মেয়েটি বলল, হ্যাঁ।
--- সাপটা কি এর মধ্যে আপনাকে পেঁচিয়ে ধরেছে কোন‌ও দিন?
মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, ও তো আমার বিছানায় আমার সঙ্গেই  ঘুমোয়। ঘুমোনোর সময় আমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে আমার গোটা শরীর জুড়ে খেলে বেড়ায়।
ডাক্তার খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে কী সব ভাবলেন। তার পর বললেন, খুব সাবধান।
--- কেন? মেয়েটি জিজ্ঞেস করতেই ডাক্তার বললেন, আসলে ও যে আপনাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে, সেটা কিন্তু ভালবেসে নয়। ও আসলে আপনার শরীরের মাপ নিচ্ছ। আন্দাজ করার চেষ্টা করছে, আপনার চেহারাটা ঠিক কত বড়। আরও কতটা জায়গা খালি রাখতে হবে। সেই জন্যই না খেয়ে খেয়ে ও পেটের মধ্যে জায়গা তৈরি করছে, আপনাকে খাবে বলে।
এই হচ্ছে সাপ। সব সাপের বিষ না থাকলেও‌ সব সাপই কিন্তু ভয়ঙ্কর। তাই যারা যাঁর খেয়ে-পরে তাঁরই ক্ষতি করার চেষ্টা করে, আমরা তাকে অনায়াসেই বলি--- সাপের জাত।
পৃথিবীর সব চেয়ে বিষধর সাপের কামড়ে হাতির মতো দশাসই প্রাণী পর্যন্ত ছটফট করতে করতে মারা যায়। শুধু একটা প্রাণীই মরে না। আর সেই প্রাণীটি হল--- ঘোড়া।
সাপের কামড়ে‌ কোনও দিন ঘোড়া মরে না। মারাত্মক বিষধর সাপ দংশন করলেও, খুব বেশি হলে তিন দিন অসুস্থ থাকে। তার পর যথারীতি সুস্থ হয়ে ওঠে।
আর এই ঘোড়া থেকেই আসে দুনিয়ার সব রকম সাপের যে কোনও রকম মারাত্মক বিষের একমাত্র প্রতিষেধক--- অ্যান্টি ভেনম (anti venom)।
কোনও মানুষ সাপের ছোবলে মৃত্যুপথযাত্রী হলে তাঁকে প্রথমেই দিতে হয় অ্যান্টি ভেনম। এই অ্যান্টি ভেনম তৈরি করার একটি পদ্ধতি আছে।
যেমন ধরুন‌, পৃথিবীর সব চেয়ে ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ, কিং কোবরার অ্যান্টি ভেনম তৈরি করতে হবে। সেটা তৈরি করতে হলে ওই সাপের বিষ প্রথমেই একটি ঘোড়ার শরীরে ঢুকিয়ে দিতে হবে।
না, বেশি ঢুকিয়ে‌ দিলেও কোনও ক্ষতি নেই। ঘোড়া মারা‌ যাবে না। খুব বেশি হলে‌ দিন তিনেক একটু ঝিমোবে। হয়তো অসুস্থও হবে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। তার পর আবার‌ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আর সেই তিন দিনের মধ্যেই ঘোড়ার রক্তে ওই সাপের বিষ‌ মিশে অ্যান্টি ভেনাম তৈরি হয়ে যাবে।
তখন ঘোড়ার শরীর থেকে সেই রক্ত বেশ কিছুটা বের করে তার লাল এবং সাদা অংশ‌ আলাদা করতে হবে। আর এই সাদা অংশ অর্থাৎ ম্যাট্রিক্স থেকেই অ্যান্টি ভেনাম‌ বেরিয়ে আসবে।
এই ভাবেই যে সাপের অ্যান্টি ভেনাম তৈরি করতে চান, সেই সাপের বিষ ঘোড়ার শরীরে ঢুকিয়ে এই পদ্ধতিতে তৈরি করতে হবে সেই সাপের বিষের প্রতিষেধক।
কাউকে সাপে কামড়ালে একমাত্র এই অ্যান্টি ভেনামই সরাসরি ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে ঢুকিয়ে নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে তাঁকে বাঁচানো যাবে
কথায় আছে, বড় মাছ সব সময় ছোট মাছকে খায়। ঠিক তেমনি জঙ্গলে যত জীবজন্তু আছে, তারা সব সময় তার চেয়ে কম জোরি বা ছোট প্রাণী দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে খায়। এই ভাবেই তারা জীবন ধারণ করে। ‌আর এটাই হল প্রকৃতির নিয়ম। পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখার একমাত্র ফর্মুলা।
নিয়মের যে ব্যতিক্রম হয় না, তাও নয়। এই তো কিছু দিন আগে একটি ভিডিওতে দেখলাম, একটি মা-হরিণ সদ্য বাচ্চা প্রসব করতে করতে যেই দেখেছে একটি বাঘ তার দিকে ধেয়ে আসছে, এমনি সে কোনও রকমে বাচ্চাটি ফেলেই প্রাণভয়ে দে ছুট।
বাঘটি এসে দেখল, আশপাশে কেউ নেই। তখন সদ্যোজাতকে সে জিভ দিয়ে চাটতে শুরু করল।আমি তো ভাবলাম, হয়ে গেল। সদ্যোজাতটির খেল খতম। এক্ষুনি বাচ্চাটাকে খেয়ে ফেলবে।
কিন্তু অবাক কাণ্ড, দেখা গেল সে ওই হরিণের বাচ্চাটির গোটা গা জিভ দিয়ে চেটে চেটে পরিষ্কার করল। যেটা মা-হরিণটির করার কথা ছিল। তার পর মুখে করে ঘাড়টি ধরে একটি গাছের আড়ালে নিয়ে গেল।
না, বাচ্চাটির গায়ে সে এতটুকুও দাঁত বসায়নি। বরং বাচ্চাটিকে খাবার জন্য যখন অন্য বাঘেরা ছুটে এল, তখন এই বাঘটিই তাদের সঙ্গে লড়াই করে সেই সদ্যজাত হরিণছানাটিকে রক্ষা করল।
শুধু রক্ষাই করেনি, তার পর থেকে সর্বক্ষণ চোখে চোখে রেখেছে। যাতে বনের অন্য কোনও জীবজন্তু তাকে আক্রমণ করতে না পারে। যাতে এই বাচ্চাটি তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে ভুল পথে গিয়ে হারিয়ে না যায়।
তাই সন্ধ্যা নামলেই একেবারে মুখে করে নিজের ডেরায় নিয়ে গেছে। বুকের কাছে নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। আর বাচ্চাটিও হয়েছে তেমন ন্যাওটা। সারাক্ষণই বাঘটির পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু তাই-ই নয়, বাচ্চাটি বারবার কিছুটা গিয়েই ছুটে এসে গোত্তা মারছে বাঘটির পায়ে। পেটের তলায়। কিন্তু বাঘটি একটুও বিরক্ত হচ্ছে না। উলটে আদর করছে। সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে।
এমন ঘটনাও তো ঘটতে দেখেছি আমরা। আমরা তো জানি বাঘ, সিংহ, হাতি, গন্ডার, ভাল্লুক কী খায়। কিন্তু জঙ্গলে থাকলে ওরা যা খায়, চিড়িয়াখানায় থাকলেও কি তাই-ই খায়? না। একদম না।
চিড়িয়াখানার প্রত্যেকটি প্রাণীর খাবারের তালিকাই যে শুধু আলাদা, তাই-ই নয়, একই রকম প্রাণীর ওজন, বয়স এবং গড়ন‌ হিসেব করেই তাদের খাবারের পরিমাণ ঠিক করা হয়। প্রত্যেক সুস্থ পশুকে সপ্তাহে ছ'দিন খাবার দেওয়া হয়। সপ্তাহে কেবল একদিনই কাউকে কিছু খেতে দেওয়া হয় না।
ঘড়ির কাঁটা গণ্ডগোল করতে পারে। কিন্তু ওদের কোনও সময়ের হরফের হয় না। সকাল ঠিক ৮টা বাজতে না বাজতেই খাওয়ার‌ জন্য দল বেঁধে তারস্বরে ডাকাডাকি শুরু করে দেয় ম্যাকাও পাখিরা। সেই সময়ই সকালের খাবার নিয়ে খাঁচায় ঢোকেন ‘অ্যানিম্যাল হ্যান্ডেলার’। মেনুতে থাকে নানা ধরনের তাজা ফল এবং চিনে ও কাঠবাদামের মতো বেশ কয়েক রকমের শুকনো খাবার।
আর ভাল্লুক? ভাল্লুকের কোনও তর সয় না। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই চাই পুরো এক কেটলি ভর্তি টুবুটুবু চা এবং সেটা অবশ্যই গরম গরম।
খাওয়ার কথা যখন‌ উঠলই, তখন হাতির প্রসঙ্গ উঠবে না তা কি কখনও হতে পারে! জানা গেছে, প্রতিটি হাতি দিনে ১০০ থেকে ১৩০ কিলোর মতো খাবার খায়। প্রতিটি জলহস্তী খায় ৫০ থেকে ৭০ কেজি খাবার। যার মধ্যে থাকে নানা রকম সবজি এবং ঘাস।
এক একটি কুমির প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ কেজি করে মাছ খায়। এদের অবশ্য সপ্তাহে ছ'দিন নয়, খাবার দেওয়া হয় সপ্তাহে তিন দিন। একদিন ছাড়া ছাড়া। বাঁদরদের জন্য থাকে আপেল, কলা, শসা-সহ রকমারি ফল।
এক-একটি পূর্ণবয়স্ক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য প্রতিদিন‌ বরাদ্দ থাকে প্রায় আট কেজি করে মাংস। সিংহের খাবার পরিমাণও প্রায় একই রকম।
তবে সব প্রাণী কিন্তু ম্যাকাওদের মতো খাবারের জন্য ডাকাডাকি করে না। কোনও বন্যপ্রাণীকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হলে তাকে প্রথমে চিড়িয়াখানার খাবারে অভ্যস্ত করে তুলতে হয়। সেটা কিন্তু যথেষ্ট কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষের ব্যাপার।
আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক একটি বাঘ পুষতেন। তার নাম ছিল খৈরি। সেই বাঘটিকে প্রতিদিন মাংস দেওয়া হত ঠিকই, কিন্তু সেই মাংসের বড় বড় খণ্ডগুলোকে তার মুখের সামনে ধরার আগে একটা বড় গামলা ভরা দুধের মধ্যে চুবিয়ে নিতেন।
আমরা একবার তাকে দেখার জন্য ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। দিনে দিনে গিয়ে ফিরে আসা যায় না। তাই রাতে ওখানেই ছিলাম। বাঘটা ছাড়াই থাকত।
আমরা যখন রাত্রিবেলায় খাটে শুয়ে আছি, হঠাৎ দেখি সে একা একা আমাদের খাটের এ পাশ ও পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।‌ তাকে দেখে আমার তখনই মনে হয়েছিল, আজ রাতে তার জন্য বুঝি বুফে পার্টি দেওয়া হয়েছে। আর আমরা হলাম খাটে, থুড়ি প্লেটে সাজানো এক-একটা জ্যান্ত খাবার। কিন্তু না, ও আমাদের কাউকে এতটুকুও আঁচর কাটেনি। শুধু টেঁরিয়ে টেঁরিয়ে দেখছিল।
সুন্দরবনের বাঘের বুদ্ধি অবশ্য এ‌ রকম পোষ্য বাঘের মতো এতটা ভোঁতা নয়। বরং মনে হয়, মানুষের চেয়ে বুদ্ধিতে কোনও অংশে কম নয়।
একবার সুন্দরবন বেড়াতে গিয়ে আমি শুনেছিলাম, এক কাঠুরিয়া যখন গাছ কাটছিল তখন দূর থেকে একটি বাঘ নাকি তাকে দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে তাকে আক্রমণ করেনি। বাঘটা জানত সে যেখানে আছে, সেখানে থেকে যেহেতু হু হু করে হাওয়া বয়ে ওই দিকে যাচ্ছে, সেই হাওয়ায় তার গায়ের গন্ধ পেয়ে লোকটি সতর্ক হয়ে যেতে পারে। তাই সে একদম ঘুরপথে গিয়ে,‌ বাতাসটা যে দিকে বইছিল, তার উল্টো দিক থেকে খুব সন্তর্পণে পা টিপে টিপে তার দিকে এগোছিল।
সেই কাঠুরিয়া যখন কাঠে কুড়ুল মারছিল, সেই শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে সে পা ফেলছিল মাতলার পাড়ের থকথকে কাদায়‌। যাতে ওই কাঠুরিয়া তার পায়ের শব্দ শুনতে না পায়। এই হচ্ছে জংলি বাঘের বুদ্ধি।
শুধু বাঘ নয়, বাঁদরের বুদ্ধিও কি কোনও অংশে কম? এই তো কিছু দিন আগে‌ একটি রেল স্টেশনের গায়ে দুটি বাঁদর নিজেদের মধ্যে মারপিট করছিল। একটি বাঁদর ভীষণ ভাবে জখম হয়। অন্যটি পালিয়ে গেলেও ওই রক্তাক্ত বাঁদরটি কিন্তু সোজা চলে গিয়েছিল সামনের এক ওষুধের দোকানে। যেখানে সকালে বিকেলে ‌লাইন দিয়ে লোকে ডাক্তার দেখান।
তাকে যখন ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হল, ওষুধ খাওয়ানো হল, সে তখন‌ একদম বাধ্য বালকের মতোই চুপচাপ বসে ছিল।
পশু-পাখি, জন্তু-জানোয়ারেরা নাকি সব বুঝতে পারে।‌ শত্রুতাও বুঝতে পারে। ভালবাসাও বুঝতে পারে। বুঝতে পারে আবহাওয়ার আগাম খবরও।
তাই বৃষ্টি হওয়ার আগে পিঁপড়েরা মুখে করে ডিম নিয়ে দল বেঁধে আস্থানা ছেড়ে লাইন দিয়ে অন্য কোনও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাড়ি দেয়।
ভূমিকম্পের অনেক আগেই মাটির তলা থেকে বেরিয়ে আসে কীট-পতঙ্গ, পোকামাকড়। শীত পড়তে না পড়তেই শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য গর্তে ঢুকে পড়ে সাপেরা। খাবার জন্যও বেরোয় না। পুরোটা শীত ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়।

এটা জানেন দেখেই শীতের কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার দাপট শুরু হওয়ার আগেই পশু-পাখিদের জন্য নানা রকম ব্যবস্থা নেয় চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ। কিছুটা বদল করা হয় মাংসাশীদের ডায়েট চার্টও।
সাপেরা যাতে শীতে কষ্ট না-পায়, তার জন্য শুকনো পাতা, খড় আর কম্বলের ‘বিছানা’ দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হয় ‘রেপটাইল হাউস’। পাশাপাশি, প্রতি চেম্বারে জোরালো বাল্ব জ্বালিয়ে গরম রাখার ব্যবস্থাও করা হয়।
শীতে অলস হয়ে পড়ে কুমিরও। এই সময়টায় তাদের খাওয়ার পরিমাণও কমে যায়। তারা যাতে ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে না-পড়ে, তার জন্য কুমিরের এনক্লোজারে সাদা ও হলুদ বালি মিশিয়ে ‘স্যান্ড বাথ’ করে দেওয়া হয়। যাতে রোদের তাপে বালি গরম হয়ে গেলে সেখানে উঠে কুমিররা একটু  স্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারে।
পাশাপাশি‌ গরমের দাপটে জন্তুরা যাতে অসুস্থ হয়ে না পড়ে তার‌ জন্য চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ গরমকালে যেমন খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি এনক্লোজারগুলোকে ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করে, ঠিক তেমনি শীতেও তারা বেশ কিছু সতর্কতামূলক বিশেষ ব্যবস্থা নেয়। বদলে দেয় খাওয়ার মেনুও।
নাইট শেল্টারে ওরা যাতে কষ্ট না-পায়, তার জন্য বাঘ, সিংহ, লেপার্ড, জাগুয়ারদের বেশি করে মাংস দেওয়া হয়। অন্য‌ সময় সাধারণত মাংসাশীদের মোষ ও মুরগির মাংস মিশিয়ে দিলেও, সেখানে মোষের মাংসের পরিমাণই থাকে বেশি। কিন্তু গরমকালে মোষের মাংসের পরিমাণ কমিয়ে মুরগির মাংস বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর শীতকালে হয় এর ঠিক উল্টো। বেশি করে মোষের মাংস দেওয়া হয়।‌ যাতে শরীরটা গরম থাকে।
মেনু পরিবর্তনের পাশাপাশি মাংসাশীদের নাইট শেল্টারে কাঠের তক্তা পেতে দেওয়া হয়। কারণ, সিমেন্টে বাঁধানো মেঝেয় শুলে নাকি পশুরা ঠাণ্ডায় কষ্ট পায়।
হরিণদের এনক্লোজারে নাইট শেল্টারে বেশি করে শুকনো খড়ের কুঁচো দিয়ে দেওয়া হয়। একমাত্র পাখিদের এনক্লোজারেই আলাদা করে কোনও কিছু করা হয় না।
চিড়িয়াখানায় এ সব করা হলেও বনে কিন্তু ওরা ওদের মতোই থাকে। চোরা শিকারিদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। বন কেটে কেটে বসতি করলেও ওরা রুখে দাঁড়ায় না। ওদের সংখ্যা লুপ্ত হতে বসলেও মুখে কোনও রা করে না।
অথচ মানুষ! পশু-পাখিদের আচার-আচরণ নিয়ে সেই আদ্যিকাল থেকেই মানুষের কুসংস্কারের কোনও অন্ত নেই।
মানুষ মাত্রই মরণশীল। কখন কার মৃত্যু হবে কেউ জানে না। তবু বলা হয়, মৃত্যুর আগাম খবর নাকি জীবজন্তুরা ঠিক পেয়ে যায়।
বলা হয়, পেঁচা যদি গান গায়, তার মানে‌ তার‌ কাছাকাছি কারও মৃত্যু হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য পেঁচার একটি বিশেষ ডাককেই ‘গান’ বলা হয়। ক্যাথলিক সন্ন্যাসীরা তো পেঁচাকে দীর্ঘকাল ধরেই ‘ডেভিলের অ্যাসোসিয়েট’ বলে বর্ণনা করে আসছেন।
কালো প্রজাপতি সম্পর্কেও কিছু লোকের একই রকমের ধারণা রয়েছে। আসলে এটি এক প্রকারের মথ। রাতচরা এই কালো পতঙ্গকে অনেকেই অশুভ বলে মনে করেন। দোরগোড়ায় কালো পতঙ্গ মানেই নাকি মৃত্যু‌‌ এসে শিয়রে দাঁড়িয়েছে। এ রকম বহু কাহিনিই আকছাড় ছড়িয়ে আছে ইউরোপীয় দেশগুলির সাহিত্যে। এমনকী আমাদের দেশের‌ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় ছোটগল্প ‘মরণ ভোমরা’তেও আছে একটি কালো ভ্রমর।‌ যাকে গোটা উপন্যাস জুড়ে দেখানো হয়েছে মৃত্যুর দূত হিসেবে।
মথ‌ নয়, দক্ষিণ আমেরিকার মায়া ও আজটেক সভ্যতায়‌ মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে ধরা হয় নিশাচর প্রাণী--- বাদুড়কে। ইউরোপের সংস্কৃতিতে বাদুড়ের স্থান আবার‌ পরলোক আর ইহলোকের মাঝামাঝি একটা জায়গায়। বাদুড় নিয়ে আমাদের এই দেশেও মৃত্যু-সংক্রান্ত সংস্কার কম নেই।
ইউরোপে কারও বাড়ির আশপাশ দিয়ে সাদা পেঁচা উড়ে গেলে সেটাকে অনেকেই মৃত্যুর পূর্বাভাস বলে মনে করেন। এই ভাবনার পিছনে কাজ করছে উইচক্রাফ্‌ট নিয়ে বহু যুগ ধরে চলে আসা ইউরোপীয়দের‌ এক সংস্কার। সাদা পেঁচা উইচদের অ্যাসোসিয়েট হিসেবে প্রসিদ্ধ।
তবে এই ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন জনপ্রিয় লেখিকা জে কে রাওলিং। হ্যারি পটারের অ্যাসোসিয়েট হেডইউগ হল একটি সাদা পেঁচা। আর সে কখনওই ‘অশুভ’ নয়।
আমাদের দেশে আরও একধাপ এগিয়ে‌ অনন্ত কাল আগে থেকেই সাদা পেঁচাকে বলা হয়--- লক্ষ্মী পেঁচা। অর্থাৎ ধন-সম্পদ-ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর বাহন। ফলে সাদা পেঁচা দেখাটাও বড় সৌভাগ্যের।
কালো ঘোড়াকেও মৃত্যুর দূত বলে মনে করে গোটা ইউরোপ। কোনও শুভযাত্রায় কেউ যদি কোনও কালো ঘোড়াকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেন, তা হলে তার মনে হয়, তার ঘাড়ে বোধহয়‌ স্বয়ং যমদূত এসে নিঃশ্বাস ফেলছে।
পশ্চিমের বহু মানুষ মনে করেন, কোনও মোরগ যদি কোনও মুরগির সঙ্গে কথা বলে, তা হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে কারও না কারও মৃত্যু হবেই।
তবে এ সব ক্ষেত্রে নাকি অবিবাহিতা মেয়েদের মৃত্যুর আশঙ্কাই বেশি থাকে। যদি দু’টি মুরগি একটি মোরগের সঙ্গে কথা বলে, তা হলে ধরে নেওয়া হয়, সেখানে‌ কোনও দম্পতির মৃত্যু আসন্ন। আর যদি কোনও মুরগি কোনও মোরগের ডাককে নকল করে, তা হলে যিনি সেই ডাক শোনেন, তাঁর মনে হয়, তাঁর আশপাশেই মৃত্যু ঘোরাফেরা করছে।
বিড়ালও নাকি‌ মৃত্যুর খবর আগাম বয়ে নিয়ে আসে। তারা নাকি মৃত্যুর গন্ধ পায়। কুকুরের আচরণেও নাকি ফুটে ওঠে আসন্ন মৃত্যুর খবর। তারা নাকি এ‌ রকম কোনও অমঙ্গলের আঁচ পেলেই সুর করে কান্না‌ জুড়ে দেয়।
বলা হয়, দিনের বেলায় যদি কোনও বাড়িতে শেয়াল ঢুকে পড়ে, তবে সেই বাড়িতে নাকি কারও না কারও মৃত্যু হবেই।
এক বা একাধিক ক্ষেত্রে কাকতালীয় ভাবে হয়তো কোথাও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। হয়তো কেউ মিল খুঁজে পেয়েছেন বহু আগে বা অন্যত্র ঘটা আগের কোনও ঘটনার সঙ্গে। তাই বলে‌ সেটাকেই অবধারিত বলে ধরে নিতে‌ হবে!
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবী শুধু আমাদের একার নয়। এই পৃথিবীর ওপর আমাদের যেমন অধিকার আছে, সেই একই রকম অধিকার আছে সমস্ত পশুপাখির। এমনকী সামান্য একটা পিঁপড়েরও। চোখে দেখা যায় না এমন কীট-পতঙ্গেরও।
তাই আমাদের উচিত তাদের বাঁচিয়ে রাখা। তাদের যদি আমরা বাঁচিয়ে না রাখি, তা হলে ভারসাম্যের অভাবে আমরাও একদিন এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাব। ফলে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই সমস্ত পশু-পাখিকে বাঁচিয়ে রাখার দায় নিতে হবে আমাদেরই। এবং আমাদের মন থেকে চিরতরে দূর করতে হবে বহু‌ যুগ আগে থেকে চলে আসা এই সব কুসংস্কারকে। যত তাড়াতাড়ি এটা করা যায়, এই পৃথিবীর পক্ষে ততই মঙ্গল।


শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত