আপডেট :

        বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীর তালিকা চান ওবায়দুল কাদের

        ওসমানীনগরে বদর দিবস পালিত

        বাংলাদেশের কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান

        ট্রেনের টিকেটসহ কালোবাজারি গ্রেপ্তার

        ৪ বিভাগে ঝোড়ো হাওয়ার সম্ভাবনা

        প্রকাশ পেল তুফান সিনেমার ফার্স্টলুক

        নিউইয়র্কে রাস্তায় আচমকা নারীদের ঘুষি মারছে অজ্ঞাতরা

        যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর মৃত্যু

        পাপারাজ্জিকে ঘুষি: টেলর সুইফটের বাবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ

        দশ বছরে ৬৪ হাজার অভিবাসীর মৃত্যু, সাগরেই ৩৬ হাজার

        বাল্টিমোরে সেতুধসে দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজের সব ক্রু ভারতীয়

        কে হচ্ছেন নতুন বন্ড

        জাহাজের ধাক্কায় বাল্টিমোরে সেতু ধসের সর্বশেষ

        শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের ভালো করা উচিত: সাকিব

        রিকশাওয়ালাদের গেম শো

        আর্জেন্টিনায় ৭০ হাজার সরকারি কর্মীকে বরখাস্ত

        সর্বজনীন পেনশন স্কীম কার্যক্রমের উদ্বোধন

        ভুটানের রাজাকে গার্ড অব অনার ও বিদায়ী সংবর্ধনা

        গাজায় মানবিক বিপর্যয় মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে পরিণত: জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান

        ভুয়া পিতৃপরিচয় দিয়ে বৃদ্ধের সঙ্গে প্রতারণা

তালেবানের জয়ের পর আফগানিস্তান কোথায়?

তালেবানের জয়ের পর আফগানিস্তান কোথায়?

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল নিয়ন্ত্রণে আসার পর তালেবান (ইসলামিক এমিরেটস আফগানিস্তান-আইইএ) যুদ্ধের অবসান ঘোষণা করে বলেছে, শিগগিরই নতুন সরকার গঠন করা হচ্ছে। এই সরকার গঠনের প্রক্রিয়া পরিণতির দিকে নেয়ার জন্য দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, রিকনসিলিয়েশন কমিটির চেয়ারম্যান ড. আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও হেজবে ইসলামী নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার সমন্বিত একটি কমিটি কাজ করছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ, পরাষ্ট্রমন্ত্রী হানিফ আতমারসহ বিদায়ী প্রশাসনের বেশ কিছু নেতা কাবুল থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্ররা কাবুলের এই অপ্রত্যাশিত আকস্মিক পতনে স্ব স্ব দেশের কূটনৈতিক মিশন সদস্য, নাগরিক এবং আফগান অংশীদারদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

এখন প্রশ্ন হলো ২০ বছর পর আমেরিকান সমর্থনপুষ্ট সরকারের পতন এবং তালেবানের বিপুল বিজয়ে আফগানিস্তানের কী ভবিষ্যৎ বা পরিণতি অপেক্ষা করছে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। আফগানিস্তানের এখন অর্থনীতির যে আকার রয়েছে এই অর্থ তার ১০৫ গুণ। এই যুদ্ধে প্রাণহানি ঘটেছে দুই লাখ ৪১ হাজার জন, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সৈন্য রয়েছে তিন হাজার ৫৮৫ জন (আত্মহননের হিসাব এর বাইরে), আফগানিস্তানের সেনা ও পুলিশ সদস্য ৭৮ হাজার ৩১৪ জন, তালেবান ও সরকারের বিপক্ষের যোদ্ধা রয়েছে ৮৪ হাজার ১৯১ জন এবং বেসামরিক নাগরিক ৭১ হাজার ৩৪৪।

বাইডেনের স্বীকারোক্তি অনুসারে আফগানিস্তানে এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের তেমন কোনো অংশ তারা তুলে আনতে পারেনি। বাইডেন এমনও বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো দেশের গৃহযুদ্ধে অংশ নিতে সেনাবাহিনী পাঠাবে না। কিন্তু এর পরও যুক্তরাষ্ট্র কি আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় চলে যাবে? তেমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কাবুলের পতন আমেরিকান হিসাব নিকাশের চেয়ে যতই দ্রুত হোক না কেন সেখান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর যা ঘটছে অথবা ঘটতে চলেছে তা একবারেই আমেরিকান অনুমানের বাইরে তা মনে করার কারণ নেই। যার জন্য বাইডেন বলেছেন, আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো সময় আগেও ছিল না।

শান্তি স্বস্তি কতদূর, কী চাইছে তালেবান?
এখন প্রশ্ন হলো আফগানিস্তানে কী হতে যাচ্ছে। তালেবানরা সেখানে কী ধরনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। তাদের স্বল্প মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যইবা কী? আর আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশ, বিশেষত চীন রাশিয়া পাকিস্তান ইরান তুরস্ক, যেসব দেশ তালেবানের নেতৃত্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দানের কথা বলছে, তারা আফগানিস্তান থেকে কী প্রত্যাশা করে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইউরোপ ও ন্যাটোর দেশগুলো, সেই সাথে ভারত আফগানিস্তানের নতুন পরিবর্তনে কী ভূমিকা পালন করতে পারে সেটিও একটি বড় প্রশ্ন।

স্বল্প মেয়াদের যে দৃশ্যপট আফগানিস্তানে দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয় তালেবানের নেতৃত্বাধীন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার আফগানিস্তানে খুব শিগগির প্রতিষ্ঠিত হবে। মার্কিন বিশেষ দূত জালমে খালিলজাদ তালেবান প্রতিনিধি এবং আশরাফ গনির সাবেক সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য আমেরিকান কূটনীতিকদের একটি দল নিয়ে দোহায় রয়েছেন। মার্কিন সরকারের মতে, তালেবানকে যা করতে হবে, তা হলো একটি সরকার গঠনের চেষ্টা করা যা অন্তর্ভুক্তিমূলক, যা মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, যে সরকার মেয়েদের তাদের পূর্ণ ক্ষমতাকে এগিয়ে নেয়ার অধিকারকে সম্মান করে।

এই সরকারের ধরন তালেবানের প্রথম সরকারের মতো হবে বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের জন্য যে তিনজন কাজ করছেন তাদের দু’জন পূর্ববর্তী সরকারের শীর্ষ দুই ব্যক্তি আর তৃতীয়জন আগের সরকারের সময় কাবুলে স্বাভাবিক জীবনে ছিলেন। তারা তালেবানের অংশ না হলেও নতুন সরকারে তাদের অংশীদারিত্ব থাকবে বলে মনে হয়। তালেবান নেতৃত্ব থেকে এই পর্যন্ত যে বক্তব্য এসেছে সে ধারণা অনুসারে প্রথমত, তারা ইসলামী অনুশাসনের অতীত দৃষ্টান্তÍ এবং আফগানিস্তানের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য সমন্বয়ে একটি সরকারব্যবস্থা আফগানিস্তানে আনতে চাইবে, যার মধ্যে আফগানিস্তানের আঞ্চলিক জাতি ও গোত্রগত যে বাস্তবতা রয়েছে তার প্রতিফলন ঘটবে।

আফগানিস্তানে ক্ষমতার দু’টি কাঠামো রয়েছে। এর একটি হলো ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় পর্যায়। আরেকটি হলো প্রাদেশিক পর্যায়ের যার অধীনে রয়েছে জেলা প্রশাসন। প্রাদেশিক পর্যায়ে যে জাতিগোষ্ঠীর প্রাধান্য থাকবে সেখান থেকেই প্রাদেশিক গভর্নর নিয়োগ করা হবে। এই নিয়োগে তালেবান বা আইইএতে তার অবস্থানের চেয়ে সেই অঞ্চলে তার মর্যাদাগত অবস্থানকে মুখ্য এবং তালেবান সম্পৃক্ততাকে দুই নাম্বারে বিবেচনায় আনা হতে পারে। এর মধ্যে তালেবানের প্রাদেশিক গভর্নর ও জেলা প্রধান নিয়োগে সেটি দেখা গেছে।

তালেবান নেতৃত্ব থেকে পাওয়া আভাস অনুসারে তারা শাসন পদ্ধতি হিসেবে হজরত ওমরের রা: প্রশাসন ব্যবস্থার সাথে বিদ্যমান আফগানিস্তানের লয়া জিরগা ব্যবস্থা (সংসদ) ও ইরান ধরনের রাষ্ট্র শাসন ও ধর্মীয় গাইডলাইনের সমন্বয় ঘটানোর একটি ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করছে। এই ব্যবস্থায় ‘আমিরুল মোমেনীন’ হবেন রাষ্ট্রের আধ্যাত্মিক গাইড ও প্রধান যার অধীনে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো-বিচার বিভাগ থাকবে। এর পাশাপাশি লয়া জিরগা বা সংসদভিত্তিক সরকার গঠন হতে পারে যার প্রধান প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী যেকোনো পরিচয়ের হতে পারেন। সংসদের একটি উচ্চ পরিষদও থাকবে যাতে আঞ্চলিক জাতিগত সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং গভর্নরদের ক্ষমতার মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় থাকবে। ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপারে আগের মতো কঠোর বাধ্যবাধকতার পরিবর্তে নাগরিকদের মধ্যে যে যে ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণ করেন তা করার অবকাশ থাকবে। নারী শিক্ষার বিষয়ে আফগান ঐতিহ্য ও উদার ইসলামী মতের সমন্বয় থাকতে পারে।

ক্ষমা উদারতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা
তালেবানদের এবারের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে যে বিষয়টি বিশেষভাবে দেখা গেছে সেটি হলো, তারা ক্ষমা উদার মনোভাব অন্তর্ভুক্তিমূলক মানসিকতা আর মৌলিক বিষয়ে বিচ্যুত না হওয়ার নীতি অনুসরণ করেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার পরও সেই নীতিই তারা অনুসরণ করবে বলে মনে হচ্ছে। তারা রাষ্ট্রের সব ধরনের পরিষেবা প্রদানকারী ব্যবস্থায় কর্মরতরা যেভাবে আছে সেভাবেই রাখবে এবং তাদের উদ্দীপ্ত করার জন্য ৫ শতাংশ বেতন বাড়িয়ে দেবে। আফগান নিরাপত্তাবাহিনীর যেসব সদস্য রয়েছেন তাদের মধ্যে যারা চাকরিতে বহাল থাকতে চাইবে তাদের তিন থেকে ছয় মাসের একটি উদ্বুদ্ধকরণ প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এতে যারা সততা ও কমিটমেন্টের ব্যাপারে উপযুক্ত প্রমাণ হবে তারা সেনাবাহিনী বা পুলিশ বাহিনীর চাকরিতে ফিরে যেতে পারবে। আর তালেবান মিলিশিয়া বা যোদ্ধাদের মধ্যে যারা সামরিক বাহিনী বা পুলিশে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মধ্যে বয়স ও অন্যান্য বিবেচনায় যোগ্য হবেন তারাই এর অন্তর্ভুক্ত হবেন। বাস্তবে তালেবান প্রশাসনের ধরন ঠিক কী হবে সেটি একেবারে নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে তালেবানের এখন নেতৃত্বের যে কয়েকটা স্তর রয়েছে তাতে জাতিগত পশতুন তাজিক উজবেক হাজারা তুর্কমেন সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এবারের লড়াইটাও সেভাবেই হয়েছে।

তালেবানদের রাষ্ট্র চালানোর আগের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে ২০ বছর আগের পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট এখন অনেকটাই ভিন্ন। এক দিকে চল্লিশ বছরের এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অন্য দিকে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে বিভক্তি এবং আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের নতুন করে প্রক্সি-যুদ্ধে জড়ানোর আশঙ্কা আর বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যে বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত রয়েছে তার প্রভাব পড়া। তালেবান নেতৃত্বের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে এই ক্ষেত্রে যে বিশেষ প্রভাব লক্ষণীয় সেটি হলো তারা আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানে যার যতটুকু সম্পৃক্ততা ঠিক ততটুকু আলোচনা সমঝোতায় যেতে চেষ্টা করেছেন। আমেরিকা চীন ও রাশিয়ার সাথে তালেবানদের আনুষ্ঠানিক চুক্তি বা সমঝোতা হয়েছে।

এর বাইরে অন্য প্রতিবেশীদের সাথেও তালেবানরা ক্ষমতা গ্রহণের আগে একধরনের সমঝোতায় গেছেন। এসব সমঝোতায় যে ক’টি মৌলিক বিষয় উঠে এসেছে তা হলো এক. আফগানিস্তানের বাইরের কোনো দেশের বিরুদ্ধে দেশটির ভূমি ব্যবহার করে কোনো ধরনের তৎপরতা চালানোর সুযোগ দেয়া হবে না। আর আফগানিস্তানও বাইরের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সাথে যুক্ত হবে না। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও অন্যান্য সহযোগিতা গ্রহণের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত হবে, এ ক্ষেত্রে কেবল আফগানিস্তানের জাতীয় স্বার্থ মুখ্য বিবেচিত হবে। তৃতীয়ত, আফগানিস্তানের সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতির মূলোৎপাটন এবং ন্যায়ভিত্তিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর করার প্রচেষ্টা চালানো হবে। চতুর্থত, অভ্যন্তরীণভাবে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকব্যবস্থা অনুসরণ করা হবে আর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মানবাধিকার রক্ষা ইত্যাদি বৈশ্বিক অনুশাসনের সাথে সমন্বয় করা হবে।

তালেবানের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ
রাষ্ট্র হিসেবে আফগানিস্তানের বেশ ক’টি শক্তিমান কূটনৈতিক অংশীদার পক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তিন বৃহৎ বৈশ্বিক শক্তি আমেরিকা চীন ও রাশিয়া। এই তিন পক্ষের তিনটি ভিন্ন নিরাপত্তাগত উদ্বেগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে আলকায়েদা ও আইএস-এর মতো উগ্রবাদী শক্তি যারা আমেরিকার স্বার্থে আঘাত হানতে চায়। এ ধরনের শক্তি যাতে আফগানিস্তানে প্রশ্রয় না পেতে পারে তার জন্য য়ুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি হয়েছে। মার্কিন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কাবুলে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বীকৃতি এখনো দেয়নি আর পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারাও বলতে অস্বীকার করেছেন যে, আমেরিকা এখনো আশরাফ গনিকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয় কি না। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ভবিষ্যতের আফগান সম্পর্ক তালেবানের কর্মের ওপর নির্ভর করবে। আফগানিস্তানে তালেবান সরকারকে কেবল তখনই স্বীকৃতি দেয়া হবে যদি সরকার নারীর অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং ‘সন্ত্রাসীদের’ থেকে দূরে থাকে।

চীনের প্রধান নিরাপত্তা উদ্বেগ হলো জিংজিয়াং। আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশ তাদের একই বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর সদস্য আর ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও রয়েছে অভিন্নতা। যুক্তরাষ্ট্র এই চীনা উইঘুরদের সমর্থনের জন্য আফগানিস্তানের ভূমিকে অতীতে ব্যবহার করেছে। সেটি যাতে সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে তালেবানরা চেিনর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাশিয়ার উদ্বেগ হলো মধ্য এশিয়া এবং তার ককেসাস অংশ নিয়ে। এই অঞ্চলের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী তুর্কি জাতিগোষ্ঠী ধারার এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সুন্নি মুসলিম। আফগানিস্তানকে যাতে এই অঞ্চলের কোনো শক্তি ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত হতে চায়, যেটি আমেরিকার একটি কৌশলগত কাজের অংশ হতে পারে বলে মস্কোর আশঙ্কা রয়েছে। তালেবানরা মস্কোর এই নিরাপত্তা উদ্বেগের ব্যাপারেও প্রতিশ্রতিবদ্ধ।

অন্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও ইরানের নিরাপত্তা উদ্বেগ হলো দেশ দু’টির অন্তর্ঘাত ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়া। আগের শাসনে পাকিস্তানের প্রধান উদ্বেগ ছিল আফগান ফ্রন্ট। এখান থেকে মদদ নিয়ে খাইবারপাখতুন খোয়ায় টিটিপি ও বেলুচিস্তানে বালুচ বিদ্রোহীরা অন্তর্ঘাতী কাজ চালিয়ে গেছে। তালেবান সরকার কোনোভাবেই এ ধরনের কোনো সুযোগ দেবে না বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর ইরানের বেলুচদের মধ্যে যে বিদ্রোহী তৎপরতা রয়েছে তারাও যাতে কাবুল সরকারের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদদ না পায় সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে।

কিছুটা দূরবর্তী প্রতিবেশী ভারতের সাথে তালেবানের কোনো আনুষ্ঠানিক সমঝোতা হওয়ার কথা এখনো জানা যায়নি। তবে তালেবান দিল্লির প্রতি যে বার্তা দিয়েছে সেটি হলো তারা ভারত আফগানিস্তানের উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখেছে সেটিকে স্বাগত জানায়। তবে একই সাথে ভারত যদি আফগানিস্তানের কোনো শত্রুকে এ দেশে অস্থিরতা তৈরির কোনো তৎপরতায় ইন্ধন না দেয় তাহলে আফগানিস্তানও তার মাটিকে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো কাজে ব্যবহার হতে দেবে না। ভারতের সাথে তালেবানের সম্পর্কের বিষয়টি রিসিপ্রোকাল বা পরস্পরমুখী।

ক্ষমতা নেয়ার পর আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে সব পক্ষের কূটনৈতিক অংশীদার বা বিদেশী শক্তির কাছে যে অঙ্গীকার দেয়া হয়েছে সেটি রক্ষা করা। এটি করতে হলে অভ্যন্তরীণ জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সহনশীল ও সমন্বয়ের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সামাজিক ক্ষোভ ও বিরোধের বিষয়গুলো যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সদস্য বেশ ক’টি দেশ আফগানিস্তানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাদের নীতিনির্ধারণের কথা বলেছে। কেউ কেউ সর্বাত্মক অবরোধের হুমকিও দিয়েছে। অবরোধ বা প্রক্সি-যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার মতো কোনো নীতি বা পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয় তার জন্য কঠোর থাকতে হবে তালেবান নেতৃত্বকে। তবে এ কথা সত্যি, যে আদর্শ ও মূল্যবোধ তালেবানকে ২০ বছরের কঠিন যুদ্ধে বিজয়ের এই পর্যন্ত এনে দিয়েছে সেটি তারা পরিত্যাগ করবে না।

এটি ঠিক যে, আফগানিস্তানে তালেবান শাসিত সরকারের প্রকৃতি কেমন হতে পারে তা বলা মুশকিল, কিন্তু এটি তালেবান নেতাদের একটি নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে, যারা ব্যাপক ভ্রমণ করেছে, বিশ্ব দেখেছে এবং অন্যান্য অনেক সরকারের সাথে আলোচনা করেছে। যে কেউ আশা করবে যে তারা তাদের নির্বাসনের সময় অনেক কিছু শিখেছে; প্রধানত অমুসলিম শক্তির আন্তর্জাতিক পরিবেশে বসবাসের বাস্তবতাকে স্বীকার করা ছাড়া তাদের কাছে অন্য কোনো বিকল্প নেই।

ভূরাজনৈতিক হিসাব নিকাশ
বিশ্লেষক গ্রাহাম ই ফুলার মনে করেন, আফগানিস্তানে ওয়াশিংটন যে নীতি অবলম্বন করেছে তা সম্পূর্ণ অবাস্তব উচ্চাকাক্সক্ষা এবং দুর্বল নীতি বাস্তবায়ন দ্বারা চালিত। এই কারণে বর্তমান পরিণতি দীর্ঘ দিন ধরে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। নব্য-সাম্রাজ্যবাদী নিউ কনজারভেটিভরা যুক্তি দেন যে, আমেরিকান প্রস্থান এবং পরবর্তী কাবুল সরকারের পতন বিশ্বের একটি পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকান ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ গভীরভাবে নষ্ট করবে। এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি অন্তর্নিহিত আদর্শ এই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বত্র বৈশ্বিক পুলিশ হিসেবে কাজ করতে হবে এবং এটি করতে ব্যর্থ হওয়া দুর্বলতা এবং পতনের লক্ষণ।

তবে এটি ঠিক যে, আমেরিকার সামগ্রিকভাবে পতন দেশীয় এবং ভূরাজনৈতিকভাবে তার গভীর দুর্বলতার প্রতীকী চিহ্ন; ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক ধারণা রয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক আধিপত্য বজায় রাখার বিষয়ে অস্বীকারের একটি ফ্যান্টাসি বুদ্বুদে বাস করছে। যদি আফগানিস্তানে ২০ বছরের মার্কিন সামরিক উপস্থিতির প্রকৃতপক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যের দিকে অগ্রগতি দেখায়, তবে এই একটি জিনিসই হবে।

মানবিক স্তরে অবশ্যই এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, নতুন তালেবান সরকারের অধীনে আফগানরা কেমন ভাগ্যের মুখোমুখি হবে। আফগান জনগণ ১৯৭৮ সাল থেকে ক্রমাগত যুদ্ধ এবং সামরিক হস্তক্ষেপের শিকার হচ্ছে। আফগান কমিউনিস্টদের একটি অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সোভিয়েত আক্রমণ, পরবর্তী সময়ে মার্কিন সমর্থিত মুজাহিদীন গোষ্ঠী দ্বারা সোভিয়েতদের বিতাড়িত করার লড়াই, পরবর্তীকালে মুজাহিদীনদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়া এবং অবশেষে তালেবানরা জাতীয় শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করে একটি সরকার গঠন পর্যন্ত এটি ঘটেছে।

বাস্তবে আফগানিস্তানের প্রতি ওয়াশিংটনের মনোযোগ আফগানদের জন্য একটি উন্নত এবং অধিকতর ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে খুব কমই জড়িত ছিল। আফগানিস্তানে আলকায়েদার উপস্থিতি ধ্বংস করার জন্য আমেরিকান আক্রমণের কথা বলা হয়। কিন্তু আমেরিকান আক্রমণ এবং দীর্ঘ দখলের গভীর এবং অধিকতর গভীর কারণ ছিল রাশিয়া এবং চীনের সীমান্তে মধ্য এশিয়ায় সামরিক ও ভূরাজনৈতিক উপস্থিতি তৈরি করা। সেই উচ্চাকাক্সক্ষা কখনোই নগ্নভাবে প্রকাশ করা হয়নি কিন্তু সব আঞ্চলিক শক্তি স্পষ্টভাবে তা বুঝতে পেরেছিল। আমেরিকান দখলের ‘জাতি-নির্মাণ এবং মানবিক’ দিকগুলো ছিল মূলত ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আড়াল করার উইন্ডো ড্রেসিং। আমেরিকান নিওকন এবং উদার হস্তক্ষেপকারীদের মধ্যে সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো এখনো পুরোপুরি মারা যায়নি।

ভালো লাগুক বা না লাগুক, সম্ভাব্য ‘আমেরিকান পরবর্তী ভূরাজনীতির’ একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে বিশ্বব্যাপী যেখানে একাধিক খেলোয়াড় নিযুক্ত সেখানে ঐতিহাসিকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা। আর এই ক্ষেত্রে, একাধিক খেলোয়াড় আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে। বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র ইরান, রাশিয়া এবং চীন এই যে তিনটি দেশকে শত্রু মনে করে তারা আসলে সবাই ওয়াশিংটনের সাথে আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য একই প্রধান লক্ষ্যকে ভাগ করে নেয় : সেটি হলো স্থিতিশীলতা, রক্তপাত এবং আদর্শ রফতানির অবসান। কিন্তু এই তিনটি দেশই আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ায় আমেরিকান হস্তক্ষেপ এবং আধিপত্যের তীব্র বিরোধিতায় একত্রিত হয়।

আগে, তালেবানরা হয়তো এই প্রতিবেশী দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে খুব কমই চিন্তা করত, আজ মধ্য এশিয়া একটি ভিন্ন জায়গা। আফগানিস্তান ভেঙে পড়েছে এবং তালেবানের সামাজিক নীতি যাই হোক না কেন, তাদের দেশকে ন্যূনতম সমৃদ্ধি এবং শান্তিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের ভবিষ্যতে সাহায্য করার জন্য চীনের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা রয়েছে। আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ায় বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের চীনা উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় অর্থনৈতিকভাবে সংযুক্ত হয়ে নিজের পুনঃনির্মাণ করতে পারে। চীন তালেবানের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং তাদের আন্দোলনের যে কোনো বিস্তার এড়ানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে, যা কেবল জিনজিয়াংয়ে চীনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে না, বরং ককেসাস ও মধ্য এশিয়ার রাশিয়া এবং শিয়া ইরানের নিরাপত্তাকেও প্রভাবিত করে।

ইরান, চীন বা রাশিয়া- এ রাষ্ট্রগুলোর কেউই যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের আঙিনায় তথা সামরিকভাবে মধ্য এশিয়ার প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায় না। মধ্য এশিয়ার কেন্দ্র থেকে মার্কিন সামরিক প্রভাব দূর হয়ে গেলে, একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল আফগানিস্তান আসতে পারে সবার ইচ্ছা ও স্বার্থে।

শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত