আপডেট :

        ব্রাজিলে ভয়াবহ বন্যায় নিহত ৫৭, ঘরছাড়া ৭০ হাজার মানুষ

        ইসরায়েলে আল-জাজিরা টিভি বন্ধের সিদ্ধান্ত

        মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠানে বিক্ষোভ

        ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থীদের ওপর ইসরাইলি সমর্থকদের হামলা

        যুক্তরাষ্ট্রে কিশোরকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে শিক্ষিকা গ্রেপ্তার

        যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি ‘বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ’ বলে উল্লেখ উত্তর কোরিয়ার

        যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তিন কর্মকর্তার মৃত্যু

        বান্ধবী খুঁজে পেতে বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন, ব্যাপক সাড়া

        অনুমতি ছাড়া গাছ কাটা বন্ধে রিট

        মানবপাচার মামলায় ৪ দিনের রিমান্ডে মিল্টন সমাদ্দার

        বাংলাদেশ ট্যুর গ্রুপ

        বাংলাদেশ ট্যুর গ্রুপ

        রাশিয়ার সঙ্গে চলমান সংলাপ অব্যাহত রাখতে হবে

        চুক্তি চান না বরং বিরোধী পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত ইমরান খান

        চুক্তি চান না বরং বিরোধী পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত ইমরান খান

        এএফআইপি ভবন উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

        সুন্দরবনের আগুন লাগার ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি

        সুন্দরবনের আগুন নেভাতে প্রচেষ্টা

        প্রাইজবন্ডে প্রথম পুরস্কার

        পাউবোর ৩৭০ বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন

নজরুলের ‘রাজনৈতিক নন্দনতত্ত্ব’

নজরুলের ‘রাজনৈতিক নন্দনতত্ত্ব’

ড.মাহবুব হাসান

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় মিথ ব্যবহার সম্পর্কে নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনা এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দাবি করে। কেন না, এতোকাল যে  চেতনাদৃষ্টি নজরুল মানস বিশ্লেষণ করে এসেছে, যে অন্তর্গূঢ় অভীপ্সার প্রতীকরুপে মিথ-পুরাণ-ঐতিহ্যের গ্রন্থনাকে বিচার করা হয়েছে, তার ভেতরে  পুনরুক্তি আর বক্তব্যের আবর্তনই লক্ষ্য করা যায়  বেশি। কারণ অধিকাংশ লেখকই নজরুলের কবিতা বিচার করেছেন তার ‘বিদ্রোহী চৈতন্যের’ আলোকে। আর সেই বিদ্রোহের স্বরুপ অন্বেষণ করেছেন তারা  তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত মিথ ও গদ্যরচনার  আলোকে। কিন্তু তাঁর কবিতার এবং অন্যান্য রচনার সৌন্দর্য বিচার তেমন একটা হয়নি। ইতিপূর্বে যত বই বেরিয়েছে,তার অধিকাংশই তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় ব্যবহৃত নটরাজ শিব-এর দ্বিমাত্রিক রুপাদলের অনুসরণে। শিব-এর নটরাজ রূপ হচ্ছে ধ্বংসকারী, সেটা নৃত্যপাগল রুপ, আবার তিনিই সৃষ্টির রক্ষাকর্তা এবং পুনর্নির্মাণের কর্তাও। নজরুল ধ্বংস চেয়েছেন পুরাতনের আর গড়তে চেয়েছেন নতুন কিছু। পুরাতনকে ভেঙে সেখানে নতুনকে নির্মাণই তো মানুষের চিরকালীন প্রত্যাশা। তাই নজরুলের এই প্রবণতাই যথার্থ, চিরায়ত আশারই প্রতিফলন, কিন্তু তাতে রয়েছে তাঁর নিজস্ব স্টাইল। তিনি কী ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, সেটা জানা জরুরি।

তিনি ধ্বংস করতে চেয়েছেন ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল, তাদের বিধি-বিধান। তাদের সভ্যতা। কেন? কারণ ব্রিটিশরা  এ-দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংস করার চেষ্টায় ছিলো। আমাদের ‘আনকালচারড’ বলে তাদের কালচার চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো আমাদের সমাজ-সংসারে, মেধা-মননে, চিন্তার রেখাপথে অন্তরের প্রবাহে। তারা উন্নত আর আমরা অনুন্নত বা অবনত সংস্কৃতির মানুষ, এই মিথ্যা ধারণা প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ছিলো নিরলস। শিক্ষা আর সভ্যতায় তারা প্রাগ্রসর- এই ফতোয়া দিয়ে আমাদের চিরায়ত বহমান শিক্ষা-ধারা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে খাটো করে চলছিলো। আর তারা

এ-দেশের একটি শ্রেণিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের মানসিকভাবে ‘নেটিভ ইংরেজ’ বানাতে চেয়েছিলো, যাতে তারা মনে করে যে ইংরেজ ও তার সংস্কৃতি বিশ্বজনীন এবং তারা একই সংস্কৃতির মানুষ। সেই সূত্রে এ-দেশের গরিব মানুষদের খ্রীষ্টধর্মে দিক্ষিত করে ব্রিটিশদের অনুকারী বানাতে চেষ্টা চালিয়েছিলো। মূল উদ্দেশ্য ‘ব্রিটিশ পুডল’ সৃষ্টি করা, যাতে এ-দেশের সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার কথা চিন্তা করতে না পারে। ভাবতে না পারে তারা শোষিত হচ্ছে।

এ-দেশের মানুষেরা যাতে বুঝতে না পারে যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার আমাদের সম্পদ লুটে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের উৎপাদিত পাটকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে গড়ে ওঠে পাট শিল্পের কারখানা। মূলত আমেরিকা ও ভারত থেকে শত শত বছর ধরে লুটে নেয়া সম্পদের মাধ্যমেই ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব সাধিত হয়। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তারা প্রাগ্রসর হয়। কিন্তু তারা জ্ঞান-গরিমায় প্রাগ্রসর হয়েছে বলে আমরা অনগ্রসর জাতি- এটা তো হয়ে পারে না। আজ থেকে ১২/১৩শ বছর আগে ভারতে শিক্ষা বিস্তার কেমন ছিলো, তার একটি উদাহরণ দিলেই তা উপলব্ধি করা যাবে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠান, যা পাল শাসনামলে বাংলাদেশসহ গোটা ভারতের শিক্ষা বিস্তারের এক মাইল ফলক প্রতিষ্ঠান ছিলো। আর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক ছিলেন আমাদের বিক্রমপুরের সন্তান শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকর। বৌদ্ধদের প্রতিটি পীঠ-ই [ধর্মীয় মন্দির] ছিলো এক একটি বিদ্যালয়। তো, সেই জাতিসত্তাকে যখন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় ইংরেজ সরকার, তখন একজন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে তাদের আসল উদ্দেশ্য। এ-কারণে ভারতে ২শ বছর শাসন চালালেও ধর্মান্তরিত করার ক্ষেত্রে এবং নেটিভ ইংরেজ তৈরির ক্ষেত্রে তারা তেমনভাবে সফল হয়নি। তবে তাদের ভাষার প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তারিত হয় এ-কারণে যে সে-সময় আমাদের জ্ঞান-গরিমার  ধারায় স্থবিরতা নেমে এসেছিলো। কারণ তৎকালীন ভাষা সংস্কৃত প্রায় মৃত, পালি ও প্রাকৃত থেকে বেশ কয়েকটি ভাষা বেরিয়েছে বহুআগেই। জ্ঞান চর্চায় তখন আমাদের কোনো মৌলিক ভাষা ছিলো না। আর রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে চালু ছিলো পার্সি বা ফারসি। ফারসিও ছিলো শাসকদের ভাষা। জনগণের মধ্যে চালু ছিলো আঞ্চলিক ভাষা। আর এই সুযোগটাই ইংরেজরা নিয়েছিলো। আমরা তো নিরক্ষর ও অসংস্কৃত জাতি ছিলাম না, তবে আমরা ইউরোপের জ্ঞান চর্চা করিনি। সেটা করতে হয়েছে আমাদের, কারণ ততদিনে পৃথিবীর জ্ঞানকেন্দ্র ইউরোপের দখলে চলে গেছে। লুটে নেয়া সম্পদের জোরে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণায়  প্রভূত অগ্রগতি সাধন করে। সেটা এক ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবে যোগসূত্র থেকেই যায়।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলে পড়ে আমরা মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিলাম নানাদিক থেকে। অর্থনৈতিকভাবে দেশকে পঙ্গু করে দেয়ার পাশাপাশি আমাদেরকে ব্রিটিশদের ওপর নির্ভরশীল করে তুলতে চেয়েছিলো।। ব্রিটিশ শোষণযন্ত্র, তাদের রাজশক্তির গর্ব ও অহমিকা, ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা এবং তাদের সভ্যতার চাপে পিষ্ট হতে হতে আমাদের পিঠ দেয়ালে  ঠেকে গিয়েছিলো। এই সব শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্যই নজরুলের বিদ্রোহ। শুধু কবিতায়ই নয়, তিনি বাস্তবেও বিশ্বাসী ছিলেন, কেমন করে দেশের স্বাধীনতা আনা যায়। কবি এবং সাংবাদিক হিসেবে তিনি সেই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেছেন তার লেখায়,তার অভিভাষণে এবং কর্মময় জীবনে। তার নমুনা আমি পরে দেবো তাঁরই লেখা থেকে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা পূর্ব বাংলার মানুষ কমরেড মোজাফফর আহমদ ছিলেন তার ঘনিষ্ট বন্ধু। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়তে হবে। সর্বাত্মক যুদ্ধ ছাড়া দেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। এ-সবই তাঁর কবিতায় আমরা পাই। দেশকে ঔপনিবেশ-মুক্ত স্বাধীন করাই ছিলো তার প্রধান চিন্তা, তার কাব্য চেতনার মূল-শেকড়। তার সমগ্র রচনার মূল চেতনাই বাম চেতনাক্রান্ত। সামগ্রিকভাবে মানবতার মুক্তির জন্যই তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন।

        আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস
    আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।

মিথ-পুরাণের বীর-মহাবীর শক্তির প্রতীক ছাড়াও ইতিহাসের যে সব চরিত্র নজরুল ‘বিদ্রোহী’তে ধ্বংসকারীর সহযোগী করেছেন, তাদের মধ্যে বেদুইন আর চেঙ্গিস--দুই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই আলোচনার দাবি রাখে। কারণ এ-দুটি নাম দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। বেদুইনরা মুক্তস্বাধীন জাতিসত্তার মানব সন্তান। আর চেঙ্গিস হচ্ছে সভ্যতা বিনাশকারী এক দুরন্ত যোদ্ধা।
চেঙ্গিস পারসিক সভ্যতার বিশিষ্ট স্থাপনাই কেবল ধ্বংস করেনি, জ্ঞান-গরিমার পাঠাগারও জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। সে-জন্য তিনি ইতিহাসের এক ঘৃণিত মহাবীর হিসেবেই চিত্রিত।
বেদুইনরা কারো অধীনতা পছন্দ করে না, মানেও না। তারা মুক্ত-স্বাধীন জীবনানন্দে ভরপুর মানব সন্তান। নজরুল সেই চির-স্বাধীন বেদুইন-সত্তা মনে করেন নিজেকে, তিনি দখলদার ব্রিটিশের অধীনতা মানেন না, মানতে রাজি নন। তিনি স্বাধীন জীবনের জন্য, স্বাধীন দেশের জন্য বেদুইন হতে চেয়েছেন বা নিজেকে বেদুইন বলেছেন। আর তাঁর এই ‘আমি’ হচ্ছে গোটা ভারতের প্রতিনিধিত্বমূলক শব্দ।  যিনি যখন এই কবিতা পড়বেন, তখন তিনিই হয়ে যাবেন সেই ‘আমি’। ফলে এক আমি এখানে বহুবচনের প্রতীক। অর্থাৎ নিপীড়িত জনগণের প্রতীক, শোষিত মানুষের প্রতীক। তাই এই আমি’র অভিঘাত বিপুল মানুষের ইচ্ছাকেই প্রতিফলিত করে।
পরস্পর বিরোধী দুটি চরিত্রের উপস্থিতি কেন নজরুল একই সমান্তরালে ব্যবহার করলেন? এটি একটি বড়ো প্রশ্ন অবশ্যই। নজরুলের মানস পরিবেশ বিচার করলেই তা বেরিয়ে আসবে। ঠিক একই চৈতন্য রেখাচিত্র থেকে তিনি লিখেছেন-- ‘মম এক হাতে  বিষের বাঁশরী, আর হাতে রণতুর্য’ [উদ্ধৃতে কোনো ত্রুটি আছে কি?] রাজনৈতিক চরিত্রের হাতে প্রেমের বাঁশি আর যুদ্ধের হাতিয়ার একই সমান্তরালেই থাকে। কারণ তাকে মানুষকে যেমন ভালো বাসতে হয়, তেমনি অত্যাচারীকেও বিনাশ করতে হয়। নজরুল চেতনার এই বৈপরীত্যই তার সৌন্দর্যবাদিতায় ধরা পড়ে।
 আমার মনে হয়েছে, তিনি চেয়েছিলেন ব্রিটিশদের শাসন-শোষণ-নির্যাতন আর লুটপাটের যে শাসন-শৃঙ্খল, তাকে গুড়িয়ে দিতে। কারণ ইংরেজের ভারতীয় সরকার আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে বিলীন করে চলছিলো।  ইউরোপীয় সভ্যতার চাকচিক্য ও যান্ত্রিকতা যতোটা না সুন্দর তার চেয়ে অনেক বেশি তারা নির্মম ও অমানবিক। তারা যান্ত্রিক জীবন ধারন করে হারিয়েছে মানবতা ও মমত্ববোধ, মানুষ এই অভিধার সাথে  যে সব উপাদান ওতপ্রোত, অঙ্গাঙ্গী, তার অনেকখানিই তারা ছাঁটকাট করেছে স্বার্থসিদ্ধর জন্য। তাদের আছে কেবল উদগ্র আগ্রাসী লুটেরা মানসিকতা। আজকেও সারা পৃথিবী জুড়েই পশ্চিমাদের লুটেরা মানসিকতা বিদ্যমান। এই অমানবিক সভ্যতার ইতি জরুরি।
তাই নজরুল সেই ঔপনিবেশিক আমলেই দ্রোহী হয়েছিলেন। শুধু কবিতায় নয়, তিনি ধূমকেতু প্রকাশ করে সেখানেও ঘোষণা করেছিলেন দেশের স্বাধীনতা। লিখলেন তিনি- ধূমকেতু কী চায়?
ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা।
ভারতের রাজনীতিকদের মধ্যে  সবার আগে ‘ধূমকেতু’ দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এর জন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছিলো। সমগ্র চেতনায় তিনি ছিলেন গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক উজ্জ্বল কবি, প্রাণের পুরুষ।
তাই তিনি যে কোনো প্রতীককেই তার স্বাধীনতার দ্যোতকে রূপান্তর করে নিতে পেরেছিলেন। চেঙ্গিসকে বেছে নেবার পেছনে ব্রিটিশদের ধ্বংসকারীর প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ঠিক দুই বিপরীত চরিত্রের সম্মিলন তিনি ঘটিয়েছেন এমন এক রুপকের অভীপ্সায়, যা আমাদের চির আকাক্সক্ষার। আমরা ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্তি চেয়েছি, আর সেই মুক্তি আসবে বেদুইনের মতো দুর্বার শক্তি কাজে লাগিয়ে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে।


নজরুল ইসলাম শুধু নটরাজ শিব মিথ প্রকল্পনায়ই তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর
শিল্পবোধ-চৈতন্যে নটরাজের প্রলয় ও সৃজন বেদনা নির্বস্তুক সৌন্দর্যবাদিতায় রূপায়িত, বস্তুবাদি ও ইতিহাস-সৃষ্ট ধ্বংসকারী হিসেবে নজরুলের মানসচৈতন্যে চেঙ্গিস অনেক বেশি সহায়ক। কারণ নজরুল চান ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের শাসন-শোষণের শৃঙ্খলের ধ্বংস।
এটাই যদি হয় কাজী নজরুল ইসলামের অভীপ্সার অন্তর্গূঢ় সত্য, তাহলে তার দ্রোহিতার নন্দনতত্ত্ব নতুন হতে বাধ্য। আমার মনে হয়েছে ভারতীয় ও ইউরোপীয় নন্দনতত্ত্বকে না এড়িয়েও, তাকে নতুন ডাইমেনশনে বেঁধেছেন তিনি। আর আমরা তার নাম দিতে পারি ‘রাজনৈতিক নন্দনতত্ত্ব’। ভারতীয় ও ইউরোপীয় নন্দনতাত্ত্বিক চিন্তাধারা, ধ্যান-ধারণা নির্বস্তুকতাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। নজরুল সেই চিন্তাকে বস্তুবাস্তবতার আকর করে তুলেছেন। অর্থাৎ এসথেটিক সেন্সকে জীবন-প্রতিবেশের রাজনৈতিকতায় এনে দাঁড় করিয়েছেন তিনি।
নজরুলের কবিতায় মিথ-পুরাণ প্রয়োগের নান্দনিকতা বিচারে উপর্যুক্ত দৃষ্টিচেতনা ব্যবহার করবো আমি। তবে তার আগে নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে নজরুলের কি ধারণা ছিলো সে সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

১.
আমার সুন্দর প্রথম এলেন ছোট গল্প হয়ে, তারপর এলেন কবিতা হয়ে। তারপর এলেন গান, সুর, ছন্দ ও ভাব হয়ে। উপন্যাস , নাটক, লেখা [গদ্য] হয়েও মাঝে মাঝে এসেছিলেন।...তখনো একথা ভাবতে পারিনি, এ লেখা আমার নয়,এ লেখা আমারি সুন্দরের, আমারি আত্মা-বিজড়িত আমার পরমাত্মীয়ের। জেলে আমার সুন্দর শৃঙ্খলের কঠিন মালা পরিয়েছিলেন হাতে-পায়ে; জেল থেকে বেরিয়ে এলেই আমার অন্তরতম সুন্দরকে সারা বাঙলাদেশ দিয়েছিল ফুলের শৃঙ্খল, ভালোবাসার চন্দন, আত্মীয়তার আকুলতা। আট বছর ধরে বাংলাদেশের প্রায় প্রতি জেলায়, প্রতি মহকুমায়, ছোট বড় গ্রামে ভ্রমণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে, কখনো কখনো বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালাম। এই প্রথম আমার মাতৃভূমি বাঙলাদেশকে ভালো বাসলাম। মনে হল, এই আমার মা। তাঁর শ্যামল স্নিগন্ধ মমতায়, তাঁর গভীর স্নেহ-রসে, তাঁর উদার প্রশান্ত আকাশের কখনো ঘন, কখনো ফিরোজা-নীলে আমার দেহ-মন-প্রাণ শান্ত-উদার আনন্দ-ছন্দে ছন্দায়িত হয়ে উঠল। আমার অন্তরের সুন্দরের এই অপরুপ প্রকাশকে এই প্রথম দেখলাম প্রকাশ-সুন্দর রূপে, আমার জননী জন্মভূমিরূপে।’ [ নজরুল রচনাবলী-৪, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ.৩২-৩৩]

২.
কিসের ধর্ম? আমার বাঁচাই আমার ধর্ম। দেবতার জল ঝড়কে আমি বাঁধবো, প্রকৃতিকে আমি প্রতিঘাত দেবো। আচারের বোঝা ঠেলে ফেলে দেবো, সমাজকে ধ্বংস করবো। সব ছারে-খারে দিয়েও আমি বাঁচবো।
আমার আবার ধর্ম কি? যার ঘরে বসে কথা কইবার অধিকার নাই, দুপুর রাতে দুঃস্বপ্নে যার ঘুম ভেঙ্গে যায়, অত্যাচারকে চোখ রাঙাবার যার শক্তি নাই, তার আবার ধর্ম কি? যাকে নিজের ঘরে পরে এসে অবহেলায় পশুর মত মেরে ফেলতে পারে, যার ভাই-বোন-বাপ-মাকে মেরে ফেললেও বাক্যস্ফূট করবার আশা নাই, তার আবার ধর্ম কি? দুই বেলা দুটি খাবার জন্যই যার বাঁচা, একটু আরাম করে কাল কাটিয়ে দেবার জন্যই যার থাকা, তার আবার ধর্ম কি?


ওগো তরুণ, আজ কি তুমি ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকবে -তুমি কি বাঁচবার কথা ভাববে না? ওরে অধীন, ওরে ভন্ড, তোর আবার ধর্ম কি? যারা তোকে ধর্ম শিখিয়েছে, তারা শত্রু এলে বেদ নিয়ে পড়ে থাকতো? তারা কি দুশমন এলে কোরআন পড়তে ব্যস্ত থাকতো? তাদের রণ কোলাহলে বেদমন্ত্র ডুবে যেত, দুশমনের খুনে তাদের মসজিদের ধাপ লাল হয়ে যেত, তারা আগে বাঁচতো।’ [ প্রাগুক্ত, পৃ. ৮-৯]    

৩.
এ-কথা স্বীকার করতে আজ আমার লজ্জা নেই যে, আমি শক্তি-সুন্দর রূপ-সুন্দরকে ছাড়িয়ে আজো উঠতে পারিনি। সুন্দরের ধেয়ানী দুলাল কীটসের মত আমারও মন্ত্র ‘‘ বিউটি ইজ ট্রুথ, ট্রুথ ইজ বিউটি’’
আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে, তাকে ক্ষুধা-দীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধ-ভূমিতে তাঁকে দেখেছি কারাগারের অন্ধকূপে তাঁকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি। আমার গান সেই সুন্দরকে রূপে রূপে অপরূপ করে দেখার স্তবস্তুতি।’’ [প্রাগুক্ত, পৃ.-৯০-৯১]

৪.
সকল ভীরুতা, দুর্বলতা, কাপুরুষতা বিসর্জন দিতে হবে। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নয়,ন্যায়ের অধিকারের দাবিতেই আমাদিগকে বাঁচতে হবে। আমরা কারো নিকট মাথা নত করবে না।--রাস্তায় বসে জুতা সেলাই করব, নিজের শ্রমার্জিত অর্থে জীবন যাপন করব, কিন্তু কারও দয়ার মুখাপেক্ষী হব না। এই স্বাধীনতা চিত্ততার জাগরণ আজ বাংলার মুসলমান তরুণদের মধ্যে দেখতে চাই। ইহাই ইসলামের শিক্ষা; এ-শিক্ষা সকলকে গ্রহণ করতে বলি। আমি আমার জীবনে এ-শিক্ষাকেই গ্রহণ করেছি। দুঃখ সয়েছি, আঘাতকে হাসিমুখে বরণ করেছি, কিন্তু আত্মার অবমাননা কখনও করিনি। নিজের স্বাধীনতাকে কখনও বিসর্জন  দেইনি।’
[ প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৬]

৫.
হিন্দু মুসলমানের দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ-স্তুপের মত জমা হয়ে আছে- এই অসাম্য, এই ভেদ জ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে, অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম, অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম, আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম সুন্দর।’ [ প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৭ ]

উপরোল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলো থেকে আমরা নজরুল মানসের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভীপ্সা উপলব্ধি করতে পারি। তিনি যে রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখটিকেই তার কাব্য ও গদ্য রচনার মৌলিক ধারা করে তুলেছিলেন, তাতে কোনো দ্বিমত নেই। কারণ সৌন্দর্যবাদের ক্ষেত্রে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিবর্তন এসেছে প্রায় প্রতিটি শতকেই। চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন তেমনি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও বিবর্তন এসেছে। নান্দনিকতা সম্পর্কে উনিশ শতকি দৃষ্টিভঙ্গিকে সরিয়ে দিয়েছে বিশ শতকি দৃষ্টিভঙ্গি। উনিশ শতকি এসথেটিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো নির্বস্তুক বিশুদ্ধবাদী। আর বিশ শতকি দৃষ্টিপাত নির্বস্তুক নয়, জীবনবাস্তবতার বাইরেও নয়। বিশ শতকে রাজনীতি সৃষ্টিচেতনার প্রধান প্রবাহ যেমন হয়ে উঠেছে তেমনি শিল্পচেতনার ধারাও গেছে পাল্টে। টেরি ঈগলটন তাঁর ‘দ্য পলিটিক্স অব দ্য এসথেটিকস-এ লিখেছেন‘‘ সৌন্দর্যের খুঁটিনাটি ও রসের তর্ক বাদ দিয়ে এখন দরকার নান্দনিকতার অন্তর্গত রাজনৈতিকতার অধিবিচার। আখ্যানের ভাষার সৌন্দর্য বিচার করে লাভ নেই, সে বিচার অনেক হয়েছে; দরকার তার মধ্যে অন্তর্লীন রাজনীতি ও মতাদর্শের কারুকাজ পুঃনপুঃন পরীক্ষা।’’
ঠিক এই কথাটিই খাঁটে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার ক্ষেত্রে। তিনি রাজনৈতিক নান্দনিকতার দুয়ার উন্মোচন করেছেন বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে। আমি তাকেই বাংলা কবিতায় প্রথম ও প্রধান রাজনৈতিক নন্দনতত্ত্বের কবি বলে চিত্রিত করতে চাই। তবে অনেকেই এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকেও গুরু মনে করতে পারেন। কিন্তু তাদের বিরোধিতা করছি না, কেবল বলতে চাই, রবীন্দ্র মনন ও মানস পরিপূর্ণ ছিলো উপনিষদিক নির্বস্তুবাদিতায়। তাই তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক চেতনায় ভারতীয় মিথ ও মেটাফরই ছিলো মূল অবলম্বন, যা পরোক্ষে কাজ করে। কিন্তু নজরুলের কবিতায় রাজনীতির নীতি-অভিঘাত নির্মিতি পেয়েছে সমকালীন ও ইতিহাসভিত্তিক চরিত্রে এবং মিথের দ্বৈরথে। আর  তাঁর কবিতায় অ্যালেগরি/ মেটাফরের মৌলিক ভূমি ছিলো বস্তুবাদি জীবননিহিত। তিনি একই সাথে নির্বস্তুক মিথের পাশে বস্তুবাদি বা চলমান জীবনের মিথও ব্যবহার করেছেন অকপটে। এখানেই নজরুল ভিন্ন, এখানেই তিনি নতুন-মাত্রিক এবং এখানেই তাঁর কবিতার রসের নতুনত্ব। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-...নজরুল ইসলাম সম্বন্ধে তোমাদের মনে যেন কিছু সন্দেহ রয়েছে। নজরুলকে আমি ‘‘বসন্ত’’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাকে কবি বলে আখ্যায়িত করেছি। জানি তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস, তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও  রুপ ও রসের সন্ধান করনি, অবজ্ঞা ভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।

কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এসব তোমাদের আবদার বটে। সমস্ত জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনা যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্য তাকে প্রকাশ করবে বৈকি! আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও ঐ সুর বাজত।’’
রবীন্দ্রনাথের এই লেখায় দুটি বিষয় সত্য হয়ে উঠেছে- এক. সময় পাল্টে গেছে।

দুই. নজরুলের কবিতায় রূপ আর রস আছে। অসির ঝনঝনা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন উচ্চস্বরগ্রামে বাঁধা কবিতা, যুদ্ধংদেহী শব্দচয়ন এবং তার প্রত্যাশাজাত অভিঘাত রচনা। রবীন্দ্রনাথ যে বিবর্তনের কথা বলেছেন, সেই বিবর্তনের কথাও টেরির ভাষ্যে আমরা পাই। দুর্ভাগ্য আমাদের এই যে, নজরুলের কবিতার এই এসথেটিকস চেতনার বিবর্তনকে আমরা ধরতে চাইনি বা আগ্রহ দেখাইনি। কিন্তু আজ সময় এসেছে নজরুলের রাজনৈতিক সৌন্দর্যবাদিতার পরিপ্রেক্ষিতকে তুলে ধরে তাঁর কবিতার সৌন্দর্য় বিবেচনার। একুশ শতকে দাঁড়িয়েও যদি আমরা উনিশ শতকি সৌন্দর্যবাদি দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নজরুলের ও পরবর্তীদের কবিতা বিচার করি, তাহলে, আমাদের আধুনিক ও আধুনিকোত্তর [মডার্ণ ও পোস্ট-মডার্ণ] হতে সময় লাগবে আরো কিছুকাল।  আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি এসথেটিক চিন্তার ক্ষেত্রেও এসেছে নতুন চিন্তার দ্যূতি। গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে-পড়াকে অগ্রগামি করতে হবে। সেই আলোকেই নজরুলের কবিতা বিচার করার সময় এসেছে।
সমালোচনা সাহিত্য যদিও পুরোনো সাহিতকে কেন্দ্র করেই চলে, তাই এই সাহিত্য নিজেই সমকালীন সাহিত্য হিসেবে গণ্য। কিন্তু আমাদের ভাবনায় এমনটা নেই। কিন্তু এই সত্য মনে রাখতে হবে যে পোস্ট কলোনিয়ালিস্ট সমালোচনা ধারার সৃষ্টি হয়েছে পুরোনো সাহিত্যকে ঘিরেই। এবং সেই পুরোনো সাহিত্যের নবীভবন সৃজন করাই সেই ধারার প্রধান কাজ। আমি মনে করি পোস্ট কলোনিয়ালিস্ট সমালোচনা সাহিত্য ধারা বা নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টি চেতনার আলোকে নজরুলের কবিতার বিচার ও বিশ্লেষণ হওয়া জরুরি।


‘সাহিত্য বিচারের মানদন্ড, রস-রূপ নিরীক্ষার বিবর্তিত দৃষ্টি-সত্তা নজরুলের সাহিত্যকে সমরোত্তর সাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছে। পাশাপাশি নন্দনতাত্ত্বিকতায় রাজনৈতিক-অভীপ্সার অন্তর্গত ধারাপাত যে বাক্সময় নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়েছে, তাকে আমরা সাহিত্য বিচারের নতুন তত্ত্ব হিসেবে বিবেচনায় আনতে পারি। এ-বিষয়টি বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তিনি অকাতরে ওই নতুনের কেতন-এর বরকন্দাজকে তাঁর বসন্ত গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছিলেন এবং নজরুলের কবিতার রসাস্বাদনে ব্যর্থতার জন্য স্নেহভাজন কবিদের তিরস্কারও করেছিলেন। দৈশিক পটভূমি, সমকালীন জীবন বাস্তবতা, রাজনৈতিক বাস্তবতা, উপনিবেশ-কারাগার-ধর্মী জীবন যাপন নজরুলকে অসি হাতে শত্রু নিধনে পরাক্রমী বীরপুরুষদের ভূমিকায় নামতে হয়েছে। তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক নবীভবন এই যে, তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সভ্যতার মূল উৎপাটন করে সেই স্বর্গাধিপতির বুকে পদচিহৃ এঁকে দিতে চান। কেন না, ওই ভগবান বা খোদা নকল ভগবান-খোদা। তাই সেই নকল ভগবান-খোদার আরশ ভেদ করে উঠতে চাইছেন তিনি, বিদ্রোহী কবিতায়।’
[নজরুলের কবিতায় মিথ ও লোকজ উপাদান/মাহবুব হাসান, প্রকাশক: নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ২০০১, পৃ.৮৩]
‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লেখা এবং তা প্রকাশের অপরাধে ব্রিটিশের ভারতীয় সরকার তাকে আটক করে এবং বিচার করে এক বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়। কবিতাটি মূলত  দেবী দুর্গা আবাহনমূলক। এই রকম একটি কবিতার জন্য তাকে কারাবরণ করার হেতু কি সেটা জানা দরকার। কবিতাটি দেবী আবাহনের হলেও তিনি দেবীকে সশরীরে উপস্থিত হতে বলেছেন। কারণ-
      আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?
      স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল
      দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
      ভূ-ভারত আজ কসাইখানা,-আসবি কখন সর্বনাশী?
কথাগুলো দেবীকে বলা হলেও আসলে মূল লক্ষ্য ভারতের ঔপনিবেশিক রাজ সরকার। স্বর্গসম ভারত জয় করেছে চাঁড়াল শক্তি, তারা দেব শিশুদের মারছে, যুবাদের ফাঁসিতে লটকাচ্ছে, ভারত এখন কসাইখানায় পরিনত হয়েছে।
এ কবিতার রাজনৈতিক অভিঘাত এখানেই যে, গোটা ভারতের শাসন পরিস্থিতির বিষয়টি বেরিয়ে আসছে মিথের আড়াল থেকে। বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে বেরিয়ে আসে ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরামের ফাঁসির বিষয়টি। সমকালীন জীবন-বাস্তবতার সাথে মিথ চরিত্রের মিথষ্ক্রিয়া করেন নজরুল, আর এভাবেই নতুন টেক্সট সৃষ্টি হয়, সৃজিত হয় রাজনৈতিক নন্দনতত্ত্বেরও।
এই কবিতাটি লেখা হয়েছিলো দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার দুর্গাপুজোর বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশের জন্য, তাদেরই অনুরোধে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কবিতাটি ছাপতে সাহস পায়নি। তাই নিজের কাগজ ধূমকেতুতে তিনি এটা প্রকাশ করেন। এই অপরাধেই কার বিচার হয়। কিন্তু নজরুল ঔপনিবেশিক সরকারের ওই বিচার মানেননি, মানতে রাজি ছিলেন না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের কাছে তিনি অপরাধী হলেও এই কবিতা আমাদের উদ্দীপিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামে সামিল হতে।
‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ পাঠে আমরা জানতে ও বুঝতে পারি তার রাজনৈতিক অভীপ্সার আসল মর্ম।

কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কর রে লোপাট
                   রক্ত-জমাট
শিকল-পূজোর পাষাণ-বেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান
বাজা রে তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস-নিশান
উড়–ক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদী।

গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা?
মুক্ত-স্বাধীন সত্যকে রে?

হা হা হা পায় যে হাসি
ভগবান পরবে ফাঁসি?
সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে?
[ ভাঙার গান ]
এই গানের প্রতিটি শব্দ কেবল স্বাধীনতার কথাই বলে না, ব্রিটিশের কারাগার ভেঙে ফেলারও কথা বলেছে। তার মানে প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি ব্রিটিশের শাসন প্রত্যাখান করেছেন। ভগবান এখানে জনগণের প্রতীক সেটা না বললেও আমরা বুঝি। তাকে, মানে সেই জনগণকে ফাঁসি দেবে কে? আর সেই মিথ্যা তথ্য কে শেখায়’ আমাদের? ‘মুক্ত-স্বাধীন’ উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে আমরা বেদুইন মানুষের মুক্ত চেহারা চরিত্র যেন মানস নয়নে দেখতে পাই। এই সব ধর্মজাত ও ইতিহাসের চরিত্র বা সমাজের চরিত্র নজরুলের রাজনৈতিক চেতনারই প্রতিফলন ঘটিয়েছে। তিনি কলোনিয়াল সাহিত্যের ডিসকোর্স প্রত্যাখ্যান করে নতুন ডিসকোর্স উপস্থাপন করেন। সে জন্য তার কবিতায় প্রতিবাদের প্রতিরোধের প্রত্নপ্রতিমা [আর্কেটাইপ] লক্ষ-কোটি স্মৃতিসত্তা অনুষঙ্গসমেত জেগে উঠেছে।
‘নজরুলের নন্দনতত্ত্বও ও নান্দনিকতার মূলে তাই প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধ। যে সময়ে নজরুল লিখেছেন, সেই সময়ের মধ্যে তিনি বাস করেননি; কেন না, সময়টা তার ছিলো না, সময়টা বাঙালির ছিল না, সময়টার শাসক ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। পরাধীন সময়ে সুন্দর কবিতা লেখাকে তিনি অপরাধ ভেবেছেন, সে জন্যই। সাহিত্যকে তিনি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবে দেখেন, এবং এতে তার কোন লজ্জা নেই। নজরুলের লেখায় যৌবন ও যৌবনবাদের যে প্রতীকী সাংস্কৃতিক তাৎপর্য আছে তা বোঝা দরকার। না হলে তার রচনা বিচার ও বোঝা যাবে না।
লেখকঃ ড.মাহবুব হাসান (লস এঞ্জেলেস প্রবাসী)

শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত