আপডেট :

        রিশাদের ব্যাটে বাংলাদেশের সিরিজ জয়

        কণ্ঠশিল্পী খালিদ মারা গেছেন

        বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ

        গুণী প্রধান শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান

        বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃ‌তিতে আইরিশ মন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন

        ইসলামবিদ্বেষ ঠেকাতে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস

        বাংলাদেশ-বৃটেন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫১ বছর: বৃটিশ হাইকমিশনার

        ঢাকায় সুইডিশ রাজকন্যা

        ইরাকের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তা করবে আইএইএ

        বিস্ফোরক মামলায় যুবদল-ছাত্রদলের ৪ নেতা কারাগারে

        জিএসপি সুবিধার মেয়াদ ২০৩২ সাল পর্যন্ত বাড়াতে আয়ারল্যান্ডের সমর্থন চাইলেন প্রধানমন্ত্রী

        ট্রাম্প মানসিকভাবে অসুস্থ: জো বাইডেন

        জৈন্তাপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬

        বিএনপি ইফতার পার্টিতে আল্লাহ-রাসুলের নাম না নিয়ে আওয়ামী লীগের গীবত গায়: প্রধানমন্ত্রী

        মার্কিন গণতন্ত্রকে কটাক্ষ পুতিনের

        শাল্লায় বিল শুকিয়ে মৎস্য আহরণ

        দেশে যুক্তরাষ্ট্রের পাপেট সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত সব নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ: সজীব ওয়াজেদ জয়

        সিএনজি-লেগুনা’র দখলে রাস্তা

        তিন বিভাগে ৩ দিন বৃষ্টির সম্ভাবনা

        এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম

গল্প: মন নদীর পাড়

গল্প: মন নদীর পাড়

ছলাৎ ছলাৎ শব্দে মালিনীর সম্বিত ফেরে৷ তাকিয়ে দেখে রতন মাঝি নৌকা নিয়ে ঘাটে ফিরছে৷


ঘাটে নৌকো বেঁধে রতন চলে যায়৷



সন্ধে নামে ,একটু পরেই ঝুপ করে অন্ধকার নামবে৷


মালিনী বসে থাকে৷ জীবনের পাতা উল্টায়৷ একা জীবনে অভ্যস্ত মালিনী বেশ ছিল৷ রঙ, তুলির মিশ্রনে সাদা ক্যানভাসে ভরিয়ে তুলত বাঙ্ময় চরিত্র৷ যখন প্রদর্শণীতে ছবিগুলো যেত সবার প্রশংসা কুড়াতো৷ মালিনীও সৃষ্টির আনন্দে বিভোর থাকতো৷


ঠিক এরকম সময়েই মালিনীর সঙ্গে একটা চিত্র প্রদর্শণীতে আলাপ অরিত্রর ৷ দমকা হাওয়ার মতন একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসা৷



অরিত্র সেন একটি আন্তর্জাতিক শিল্প কলা কেন্দ্রের প্রশাসনিক আধিকারিক৷ প্রথম আলাপে অরিত্রকে বেশ উপকারী বন্ধু বলেই মনে হয়েছিল মালিনীর৷ মালিনীর আঁকার সংস্থা "তৃতীয় নেত্র" ৷ মাত্র দেড় বছর বয়স৷ সংস্থার আর্থিক সঙ্গতি এখনও সেরকমভাবে না থাকলেও কিছু ভালো মানুষের উৎসাহ এবং অকৃত্রিম দানে মালিনী এই দেড় বছরে কিছু ভালো কাজ করেছে, যা প্রত্যেকের মনে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে৷


ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বড় বড় প্রদর্শণীতে  মালিনীর ছবি প্রদর্শিত হওয়া , আদিবাসী এলাকায় গিয়ে শিশুদের নিয়ে কর্মশালা তৈরি করা, কলকাতা শহরের বুকে অনামী চিত্রশিল্পীদেরকে দিয়ে চিত্র প্রদর্শণী করা ইত্যাদি৷


অরিত্র প্রথম মালিনীকে দেখে বলেছিল, তোমার মধ্যে এই যে কিছু করার প্রবণতা , সত্যিই মালিনী আমাকে মুগ্ধ করে৷


স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে মালিনী বলেছিল, আপনাকে যেন পাশে পাই৷


অরিত্রও বলেছিল, নিশ্চয়ই থাকব৷



তারপরই একদিন অরিত্রর ফোন৷ মালিনী হ্যালো বলতেই অরিত্র বলেছিল, তুমি যে আমাকে তৃতীয় নেত্রতে থাকতে বললে তার জন্য আমাকে তোমাদের সংস্থার শীল মোহর লাগানো চিঠি দাও৷ আনুষ্ঠানিক ভাবে চিঠি দিতে হবে তো না কি? না খালি মুখে মুখে বললেই হবে৷



অরিত্রর কথা শুনে মালিনী সে দিন একটু লজ্জাই পেয়েছিল৷ মোবাইল রেখে সঙ্গে সঙ্গে চিঠি করে পাঠিয়ে দিয়েছিল অরিত্রর মেইলে৷



তারপর থেকেই অরিত্র আর মালিনীর পারষ্পরিক বাক্যালাপ কখনও মোবাইলে আবার কখনও মেসেজে৷



 ছুটির দুপুরে অরিত্র মালিনী কে ফোন করে জানত  মালিনীর জীবনের খুঁটিনাটি কথা।  মালিনী ও নির্দ্বিধায় তার জীবনের গল্প বলতো।


 মালিনী অনুভব করতো অরিত্র তার প্রতি সমবেদনা।  মালিনীকেও  অরিত্র তার জীবনে অনেক গল্পই শোনাতো।


 মালিনীর বরাবরই স্বভাব কোন কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার পেছনে পড়ে থাকা।  সেটা দেখে অরিত্র বলতো,  তুমি না একদম আমার মায়ের মতন   , যতক্ষণ না কাজ শেষ হয় ততক্ষণ পেছনে পড়ে থাকো ৷  মালিনী হেসে বলতো তাই বুঝি?  অরিত্র বলতো একদম ৷


 অরিত্রর জীবনের বোঝা টানতে টানতে বিয়েই করা আর হয়ে ওঠেনি ৷  বাড়িতে বাবা, মা ,দুই বোন এই নিয়ে ছিল অরিত্রর সংসার ৷ অরিত্র যখন কলেজে পড়ে তখন তার বাবা মারা গেলেন  ৷ গোটা সংসারের দায়িত্ব পড়ল অরিত্রর উপর ৷ ছোট দুই বোনকে মানুষ করে বিয়ে দিয়ে অরিত্র যখন নিজের দিকে তাকালো তখন পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে  ৷ মা নিভা দেবী অনেক আগে থেকেই অরিত্রর বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে কাজে তিনিও অসফল হয়েছেন  ৷ অরিত্র সাফ জানিয়ে দিয়েছিল তিনি বিয়ে করে কোনও বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান না ৷ নিভা দেবী বলতেন ,তোকে বৃদ্ধ বয়সে দেখবে কে   ? অরিত্র হেসে বলতো বৃদ্ধ বয়সে দেখার জন্য আমি বিয়ে করতে পারবো না  ৷ আর তুমি কি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে যে বৃদ্ধ বয়সে তার আমাকে না আমাকেই তাকে দেখতে হবে ৷


 নিভা দেবী আর কিছু বলতেন না ৷ এরপরে আর কিইবা বলবেন৷  বছর তিনেক হল নিভা দেবীও মারা গেছেন ৷ অরিত্র এখন ঝাড়া হাত পা  ৷ বালিগঞ্জে পৈতৃক বাড়িতে থাকে৷  সব সময় খাওয়া-পরার একটি লোক থাকে৷  তার নাম গনেশ ৷ সেই বাজারহাট রান্নাবান্না করে ৷ আর একটি ঠিকে কাজের মেয়ে আছে, যে ঘর মোছা ,বাসন ধোয়া আর কাপড় কাচা করে ৷ অরিত্র জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য বছরে দুবার তিনবার ঘুরতে যায় ৷




ওদিকে মালিনী ডিভোর্সী৷ ছেলেবেলা থেকেই মালিনী খুব সুন্দর ছবি আঁকতো ৷ কলেজে পড়তে পড়তে দু, তিনবার প্রদর্শণীতে অংশগ্রহণও করেছিল৷ তারপরে আর যা হয় মালিনীর জীবনেও তাই হলো৷ অসিতের মতন সুযোগ্য পাত্রর সঙ্গে বিয়ে হলো৷ শ্বশুরবাড়ি রক্ষণশীল পরিবার৷ তারা মালিনীর এই  রঙ তুলির প্রেমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করল৷ মালিনী বুকে জমাট বাঁধা অভিমান নিয়ে তার রঙ তুলিকে বাক্সবন্দী করল৷


বিয়ের বছর গড়াল৷ ব্যস্ত মুখর পৃথিবীতে মালিনী শুধুই একটি বিন্দুসম মানুষ৷ নিয়মের বেড়াজালের মধ্যেই মালিনী দুচোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় একটা ক্যানভাস, যাতে সে রঙের মধ্যে তুলি ডুবিয়ে এঁকে চলেছে আদিগন্ত শস্য শ্যামল সবুজ প্রান্তর, সাওতালি রমনীর খোলা বুকে শিশুর স্তন্যপান , গৃহস্থর কল্যানে সাঁঝের বেলায় তুলসী মঞ্চে গৃহবধূর তেল প্রদীপ জ্বালানো৷ এরকম আরও কত টুকরো টুকরো দৃশ্য মালিনীর মানসপটে ভেসে ওঠে৷ ওই টুকুই তার মানসিক আরাম৷ ও জানে চোখ খুললেই ওর সবুজ পৃথিবী হারিয়ে যাবে৷

বিয়ের প্রায় দুবছর গড়িয়ে গেল৷ এখনও তার মাতৃগর্ভ শূণ্য৷ শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় পরিজনেরা আড়ালে আবডালে বলতে লাগল বাঁজা ৷ অথচ এই ব্যাপারে মালিনীর চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই৷


একদিন সহ্যর বাঁধ ভাঙল মালিনীর৷ অসিতকে বলল, চলো আমরা ডাক্তারের কাছে যাই৷ অসিত দৃঢ়স্বরে বলল, না আমার কোনও দোষ নেই৷ যাবার হলে তুমি যাও৷

মালিনী তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিল, তুমি কিভাবে জানবে যে আমাদের মধ্যে কে অক্ষম?

অসিত বলেছিল, তোমার ফালতু কথা শোনার সময় আমার নেই৷

শ্বাশুরীর কানেও গিয়েছিল কথাটা ৷ তিনি উত্তপ্ত হয়ে বলেছিলেন, ছিঃ বৌমা তুমি ডাক্তারের কাছে যাবে নিজের অক্ষমতা জানাতে৷ যা আমাদের বাড়ির কেউ কোনওদিন করেনি৷ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোল আলো করে সবার সন্তান এসেছে৷ কখনও ভুলেও আর ডাক্তারের কাছে যাবার কথা ভেবো না৷

মালিনী চিৎকার করে বলেছিল, মা আপনিও তো একজন মেয়ে৷ আপনার যদি এটা বাড়ি হয়, আমার কি নয়?

শ্বাশুরী গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন, মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি তখনই নিজের বাড়ি হয়, যখন সে সেই বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে পুত্রসন্তান প্রসব করে৷

সেদিন সারা রাত চোখের জলে বালিশ ভিজিয়েছিল মালিনী৷


পরদিন সকালে উঠেই সে এই বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিল ৷ এতগুলো দিন সে যথেষ্ট মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে , তারপরও সে পরজীবী৷

অসিত অফিসে চলে যাবার পর ব্যাগে গুটিকয়েক জামা কাপড়, বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া গয়নাগুলো, আর তার জমিয়ে রাখা হাত খরচের টাকা , বন্ধ ড্রয়ার খুলে রং তুলির বাক্স ব্যাগে ভরে শ্বাশুরীকে ঘরে ডেকে ব্যাগ দেখাল৷

তারপর আস্তে আস্তে বলল, মা আপনাদের বাড়ির কোনও জিনিসই আমি নিইনি৷ শুধু টাকাগুলো আপনার ছেলের দেওয়া , আমার দুবছরের পারিশ্রমিক৷

শ্বাশুরী বললেন, খোকা জানে তুমি যে চলে যাচ্ছো৷

——— সেতো আমার কাগজের একটা নাম, মনের কেউ না৷ তাই আমি তাকে জানাতে বাধ্য নই৷ আর আপনার বাড়ি যখন বাড়ির মালকিনকেই জানিয়ে দিলাম৷


———— বেশ চলে যেতে যখন চাইছো যাও৷ তবে এটাও জেনে রেখো এই বাড়ির দরজা তোমার কাছে চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল৷


মালিনী মৃদু হেসে বলল,  চুক্তিপত্র শেষ হলে সেখানে যে আর ফেরা যায় না৷ সেটা আমি জানি৷

আর কোনও কথা না বলে মালিনী ব্যাগ হাতে তার বনেদী শ্বশুরবাড়ির লোহার দরজা খুলে রাস্তায় নামল৷



প্রথমে কোথায় যাবে ভাবতে লাগল৷ বাপের বাড়ি যাবার কথা একবারও মনে হলো না৷ কারণ বাপের বাড়ির সংসারে ভাই, ভাইয়ের বউ আছে, সেখানে ও গিয়ে উঠলে ওদের কাছে একটা বোঝা হয়ে যাবে৷ আর কৈফিয়ত আর উপদেশের বাণীতে ওর জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে যাবে৷

 তারপর মনে পরল কলেজের বন্ধু তিথির কথা৷ তিথি ওর কলেজে সবথেকে কাছের বন্ধু ছিল৷

মাস ছয়েক আগে মালিনী গড়িয়াহাটে মার্কেটিঙ করছিল, তখন তিথির সঙ্গে দেখা৷

তিথি বলেছিল, ও শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে শিক্ষিকার চাকরি পেয়েছে৷ এখন ওখানেই কোয়াটার্সে বৃদ্ধা মাকে সঙ্গে নিয়ে থাকে৷ তিথির বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছে৷ দাদা বিয়ে করে বউকে নিয়ে অন্যত্র থাকে৷ তাই মায়ের দায়িত্ব ওই নিয়েছে৷

মালিনীর কাছে এখন তিথিই ভরসা৷ মালিনী একটা ট্যাক্সি ডাকল৷ তারপর সোজা হাওড়া স্টেশনে পৌছল৷ স্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে বোলপুরের টিকিট কাটল৷ তারপর একটা জলের বোতল কিনল ৷

কিছুক্ষণ পর মাইকে ঘোষনা হলো ট্রেন নয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে দিয়েছে৷ মালিনী ব্যাগ কাঁধে গিয়ে মহিলা কামরায় উঠল৷ ভাগ্যবশতঃ জানালার ধারে একটা সিটও পেয়ে গেল৷ বড় ব্যাগটা বাঙ্কের উপর রেখে লেডিস ব্যাগটা কোলে নিয়ে বসল৷ জলের বোতল খুলে ঢকঢক করে কিছুটা জল খেলো ৷ সকাল থেকে পেটে কিছু পরেনি৷ তবু খিদে নেই৷

ট্রেনটা হাল্কা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল৷ জানালা দিয়ে ধানক্ষেত, সবুজ মাঠ, খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর, জলাশয়ের জলে সাদা হাস দেখতে মালিনীর শিল্পী মন প্রকৃতির রঙে ডুবে গেল৷

কতক্ষণ এভাবে মালিনী ছিল সে তা নিজেও জানে না৷ ঘোর কাটল চা ওয়ালার চা চা ডাকে৷

ট্রেন তখন বোলপুর স্টেশনে ঢুকছে৷



ট্রেন থেকে নেমে একটা সাইকেল রিক্সায় উঠল মালিনী৷ রিক্সায়ালাকে বলল, পাঠ ভবন চলো৷

লাল সুড়কির রাস্তা দিয়ে পাঠ ভবনের সামনে এসে দাড়াল মালিনী৷ রিক্সাভাড়া মিটিয়ে পাঠ ভবন চত্বরের বড় গেটটার সামনে গিয়ে দারোয়ানকে গিয়ে তিথির কথা বলতেই, দারোয়ান বলল, এখন তো স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, আপনি এই রাস্তা দিয়ে সোজা হেটে যান ওখানে কোয়ার্টাসে দিদিমনি থাকেন৷

মালিনী দারোয়ানের কথা মতন রাস্তা ধরে যেতেই তিথির কোয়াটার্সের সামনে পৌছল৷

একজন বয়স্ক লোককে এদিকে আসতে দেখে মালিনী তিথির কথা জিজ্ঞাসা করল, বয়স্ক মানুষটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সিঁড়ি দিয়ে উঠে বা দিকের দরজাটায়  টোকা দিন গিয়ে ওটাই তিথির ঘর৷

মালিনী সেই মতন গিয়ে দেখল দরজার পাশেই কলিঙ বেল আছে৷ কলিঙ বেল টিপতেই তিথির গলার আওয়াজ পেল মালিনী৷ দরজা খুলে মালিনীকে দেখে তিথি যেন ভুত দেখলো৷


—— তুই ?

মালিনীকে দেখে তিথি অবাক হয়ে গেল৷

মালিনী তিথির দরজাটা ধরে হাঁফাতে লাগল৷ তিথি মালিনীর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ওকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজাটা দিয়ে দিল৷

তিথি বলল, তুই বোস৷ আমি একটু শরবত করে দিই৷ মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে কিছুই পেটে পরেনি৷ আমি ঝট করে তোকে কিছু বানিয়ে দিই৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই তিথি কাঁচের গ্লাসে শরবত করে নিয়ে এল৷ শরবতের গ্লাস তিথির হাতে ধরিয়ে দিয়ে তারপর ছুটল রান্নাঘরে৷ ডিমের অমলেট আর তার সঙ্গে পাউরুটি টোস্ট ৷ ততক্ষণে মালিনীর শরবত শেষ হয়ে গেছে৷ পাউরুটি টোস্ট আর ডিমের অমলেটটা খেয়ে মালিনী একটু সুস্থ বোধ করতে লাগল৷

তারপর আস্তে আস্তে পুরো ঘটনা তিথিকে বলল৷ তিথি মন দিয়ে চুপ করে সব শুনলো৷ তারপর বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভগবানের বোধহয় ইচ্ছে ছিল তুই এখানে থাকবি৷

মালিনী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, মানে ?

তিথি হেসে বলল, মা দুমাস হলো আমাকে ছেড়ে পরলোকে যাত্রা করেছেন৷ খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল৷ তাই ভগবান তোকে পাঠিয়েছেন৷ তোর যতদিন খুশী ততদিন থাক৷

মালিনীর চোখ জলে ভরে উঠল৷

তিথি বলল, নে ওঠ, স্নান সেরে নিয়ে দুজনে খেয়ে নিয়ে তারপর কিছু একটা প্ল্যান করা যাবে৷



স্নান সেরে দুপুরের আলুপোস্ত আর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে দুই বন্ধু বিছানায় গিয়ে পুরনো দিনের গল্পে মেতে উঠল৷

ওদের গল্পে উঠে এল স্কুলের সামনে আলুকাবলি, আচারয়ালা, মুড়িমাখার স্বাদ৷ পাটিগণিত ভুল করলে অঙ্কের দিদিমনির কড়া বকুনি৷ গল্প করতে করতে দুজনের চোখেই ঘুম নেমে এল৷

ঘুম ভাঙলো যখন তখন সন্ধে হয়ে গেছে৷ কোয়াটার্সের বারান্দায় বেতের চেয়ারে গিয়ে বসলো মালিনী৷ তিথি ট্রে করে দুকাপ চা বানিয়ে নিয়ে এল৷ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মালিনী বলল, ভালোই করেছিস রে, বিয়ে না করে৷

তিথি বলল, ভালো করেছি কিনা জানিনা৷ তবে বাবা মারা যাবার পর বুঝেছিলাম নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে৷ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মানেই আসল স্বাধীনতা৷ দাদা বিয়ে করে আলাদা হয়ে যাবার পর মাকে দেখেছিলাম কেমন যেন অসহায় হয়ে গেছিল৷

আসলে কি জানিস তো মেয়েদের ছোটবেলায় হাতে ওই যে পুতুল ধরিয়ে দেওয়া হয়, তখন থেকেই মেয়েরা বুঝে যায় ঘরকন্যার কাজই আমাদের করতে হবে৷ আর সেটাই সযত্নে ভেতরে লালন করে৷ তাই তো এখনও আমাদের দেশের মায়েরা ছেলে সন্তানের উপর ভরসা করে৷ বিশ্বাসই করতে পারে না মেয়েরাও দায়িত্ব নিতে পারে৷

আমার মায়েরও তাই হয়েছিল৷

আমি যখন পাঠ ভবনের চাকরিটা পেয়ে এখানে এলাম৷ মায়ের কত দুশ্চিন্তা ৷

তারপর যখন কোয়াটার্স পেয়ে মাকে এখানে নিয়ে এলাম মা আস্তে আস্তে বুঝল তার মেয়ে সব পারে৷


রতনপল্লীতে বহুদিন ধরেই একটা এনজিওর উদ্যোগে একটা অনাথ আশ্রম গড়ে উঠেছে৷ তিথির কলিগ মিতা অবসর সময়ে ওখানে যায়৷ বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটায়৷

পরদিন স্কুলে মিতাকে মালিনীর বিষয়ে সব কথা বলল তিথি৷ সব শুনে মিতা বলল ভালো সময়েই তুই বললি অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের স্কুলের জন্য ওরা আঁকার টিচার খুঁজছে৷ খুব বেশী টাকা মাইনে দিতে পারবে না তবে যা দেবে তোর বন্ধুর মোটামুটিভাবে চলে যাবে৷

মিতার কথা শুনে তিথি যেন হাতে চাঁদ পেল৷ তক্ষুণি মালিনীকে ফোন করে বলল, তুই তোর সব একাডেমিক ডকুমেন্টগুলো জেরক্স করে আমার স্কুলের ছুটির সময় চলে আয়৷

মালিনী কিছু বলার আগেই তিথি লাইন কেটে দিল৷


মালিনী সব জেরক্স করে পাঠভবনের সামনে চলে এল৷ কিছুক্ষণ পর তিথি আর মিতা স্কুলের গেট থেকে বেড়োল৷ তিথি মিতার সঙ্গে মালিনীর পরিচয় করিয়ে দিলো৷ তারপর ওরা তিনজন হাটতে হাটতে অনাথ আশ্রমের ভেতর শিশুদের  স্কুল "হাতেখড়ি" তে পৌছল৷ স্কুলের প্রধাণ শিক্ষিকা তনুশ্রী মিত্র৷ মিতার সঙ্গে ওনার খুব ভালো সম্পর্ক৷ ওদের দেখে উনি খুব খুশী হলেন৷

টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে ওরা বসল৷ মিতা ওদের তনুশ্রীদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল৷ তারপর মালিনীর এখানে আঁকা শেখানোর বিষয়ে তনুশ্রীদিকে মিতা বলল৷ তনুশ্রীদি মালিনীর কাছ থেকে সব শুনলেন৷ তারপর বললেন, তোমার ডকুমেন্টগুলো সব জমা দিয়ে যাও৷ আমি কমিটিতে পাঠাই৷ আশা করি হয়ে গেলে আমারও ভালো লাগবে৷

দুদিন বাদেই তনুশ্রীদি মালিনীকে ফোন করে জানালেন তোমার আঁকা শেখাবার কাজটা পাকা হয়ে গেছে মালিনী৷ আগামীকাল থেকেই জয়েন করতে পারো ৷

আনন্দে সেদিন ভেসে গিয়েছিল মালিনী৷ পছন্দসই কাজে মানুষ যে কতটা আনন্দ পায় সেদিন বুঝেছিল মালিনী৷ সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিল তিথিকে৷ তিথি আবার মিতাকে জানিয়েছিল৷ স্কুল ছুটির পর মিতাকে সঙ্গে নিয়ে তিথি বাড়ি এসেছিল৷ ওদের দুজনকে দেখে মালিনী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল৷  সেদিন দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া সেরে বিকেলে মিতা চলে গেল৷ আর মালিনী সন্ধের পর রঙ তুলিতে সাদা কাগজ রাঙিয়ে তুলতে বসল৷


পরদিন সকালবেলায় দুই বন্ধু যে যার স্কুলের পথে রওনা দিল৷ মালিনী স্কুলে পৌছে তনুশ্রীদির ঘরে ঢুকল৷ তনুশ্রীদি মালিনীর হাতে নিয়োগ পত্র দিয়ে দিল৷ তারপর স্কুলের পরিচারিকা মালতি মালিনীকে সঙ্গে করে একটা বড় হল ঘরে নিয়ে গেল৷ ওখানে মাটিতে শতরঞ্চি বিছিয়ে বাচ্চাগুলো রঙ পেন্সিল আর আঁকার খাতা নিয়ে বসে আছে৷ মালিনী ওই খুদে শিল্পীদের মধ্যে  নিজের খুশীর রঙ খুঁজে পেল৷

সময় নদী জীবনের ঘাটগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোতে লাগল৷ মালিনীও নিজের সংস্থা তৈরি করল৷ তনুশ্রীদি, তিথি আর মিতার সাহায্যে ওর আঁকা ভারতের বড় বড় প্রদর্শণীতে স্থান পেল৷ ছবি টুকটাক বিক্রি হতেও শুরু করল৷ এর মধ্যে অসিতের সঙ্গে কাগজে কলমে ডিভোর্সও হয়ে গেল ৷
তিথির কলকাতার মৌলালীর বাড়িটা ওর মা তিথিকে দানপত্র করে দিয়েছিল৷ মালিনী কাজের সুবিধার জন্য কলকাতায় আসলে মৌলালীর বাড়িতেই থাকে৷ হাতেখড়ির আঁকার দিদিমনি এখনও সে৷ সপ্তাহে দুদিন বাচ্চাদের আঁকা শেখানোটা ওর কাছে জিয়নকাঠি৷

এর মধ্যেই অরিত্রর সঙ্গে ওর আলাপ৷ ভাললাগা থেকে বন্ধুত্ব৷ অরিত্রর মালিনীর জীবনের পথকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি মালিনীকে স্বস্তি দিয়েছিল ঠিকই৷ কিন্তু মালিনীর কাজের প্রয়োজনে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা নিয়ে অরিত্রর অনাকাঙ্খিত আচরণ মালিনীকে বেশ আহত করছিল৷ অরিত্রর সঙ্গে কাফে কফি ডেতে বসে কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে গল্প করার উচ্ছ্বাস যে আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসছে মালিনী সেটা অনুভব করছিল৷


 মালিনী এতদিনে বুঝে গেছে জীবনটা প্রতিযোগিতা মূলক কোনও দৌড় নয়,  জীবনটা সফর৷ আর সেই জীবন সফরে  প্রত্যেকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সফর সঙ্গী৷ সময়ই হল বড় বন্ধু৷


মোবাইলের রিঙ টোনের শব্দে মালিনীর ঘোর কাটল৷ স্ক্রিনে ভেসে উঠল অরিত্রর নাম৷  মোবাইলটা বেজে বেজে এক সময় থেমে গেল৷ এখন আর ফোন ধরার জন্য কোনও ব্যাকুলতা নেই তার৷

মন নদীর পাড়েও যে ভাঙন শুরু হয়েছে৷

শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত