কাশ্মিরি অধ্যাপকের ৩৬ ঘণ্টার সশস্ত্র জীবন: অস্ত্রই মুক্তির পথ?
‘আপনার কোনও মনোকষ্টের কারণ হয়ে থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আল্লাহর দরবারে যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে এটাই আমার শেষ আলাপ’। বাবার সঙ্গে এই শেষ বাক্যবিনিময়ের পর কাশ্মির বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রাফি ভাটকে পাওয়া যায়নি আর। পাওয়া গেছে ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে বিদ্ধ তার নিথর দেহ। নিশ্চিত হওয়া গেছে, একদা ধর্ম প্রশ্নে যিনি মার্ক্সবাদের তাত্ত্বিক বোঝাপড়ায় মগ্ন থাকতেন, সেই সমাজতাত্ত্বিক কাশ্মিরের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে শহীদ হয়েছেন ইসলামকে আশ্রয় করে লড়াইরত এক সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠনের মতাদর্শের বশ্যতা মেনে। শিক্ষক হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় এবং শিক্ষার্থীদের ভালোবাসায় সিক্ত এই তরুণ মেধাবী অধ্যাপকের নিস্তব্ধ মরদেহ ভাবিয়ে তুলেছেন সারা ভারতকে। শঙ্কা জোরালো হয়েছে, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আরও অনেক কাশ্মিরি তরুণ ঝুঁকবে সশস্ত্র পন্থায়। পরিসংখ্যানও সাক্ষ্য হাজির করেছে, বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর থেকে এই ধারার তরুণদের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমাগত। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি সশস্ত্র সংগ্রামই কাশ্মির সংকটের চূড়ান্ত নিয়তি?
সকালে রাফি তার বাবাকে টেলিফোনে জানান, বাদিগাম গ্রামে তিনি অন্যদের সঙ্গে আটকা পড়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ঘিরে রেখেছে। ভারতীয় বাহিনীর দাবি, রাফির বাবাকে টেলিফোন তারা ঘটনাস্থলে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান, যেন ছেলেকে আত্মসমর্পণে রাজি করাতে পারেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে পুলিশ দাবি করেছে, রাফি আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সঙ্গে থাকা অন্য হিজবুল মুজাহিদীন সদস্যদের কারণে পারেননি। ওই সশস্ত্র তরুণদের মধ্যে হিজবুল মুজাহিদিনের শীর্ষ নেতাও ছিলেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ভাষ্যমতে, শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটায় নিখোঁজ হওয়ার পর শেষ বিকেলের দিকে তিনি হিজবুল সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন। শনিবার মাঝরাতেই ভারতীয় বাহিনী ঘিরে ফেলে তাদের। অবসান হয় রাফির ৩৬ ঘণ্টারও কম সময়ের সশস্ত্র প্রতিরোধ। পরে সংবাদমাধ্যম ভারতীয় বাহিনীর এনকাউন্টারে চার হিজবুল সদস্যের সঙ্গে তার মৃত্যুর খবর জানায়।
নিখোঁজ হওয়ার আগে রাফি শুক্রবার বিকাল সাড়ে তিনটায় ক্যাম্পাস ছাড়েন। শিক্ষার্থীদের বলেন, নতুন চাকরিতে যোগ দিতে যাচ্ছেন। রবিবার তার নিহত হওয়ার খবরে অঞ্চলটিতে নতুন উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। নিরুদ্বিগ্ন শিক্ষাবিদের জীবন ছেড়ে রাফি কেন সশস্ত্র পন্থায় ঝুঁকলেন, সেই প্রশ্ন জাগে মানুষের মনে। একটা সময় পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর শ্রেণির মানুষেরা সশস্ত্র সংগঠনে সম্পৃক্ত হতেন। ৩ দশকের আত্মনিয়ন্ত্রণের চলমান লড়াইয়ে আত্মাহুতি দেওয়া কাশ্মিরিদের মধ্যেই রাফিই সম্ভবত প্রথম পিএইচডিধারী হিসেবে নিহত হলেন। ‘আমরা বিস্মিত হয়েছি। ভয় পেয়েছি। হতাশা তো আগে থেকেই ছিল। এখন তা আরও বেড়ে গেছে। এখন শিক্ষার্থীকে ভয় পেতে হবে। ভয় পেতে হবে নিজের সন্তানকেও।’ ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন রাফির সহকর্মী গুল ওয়ানি।
কাশ্মির চিরবৈরী ভারত-পাকিস্তানের বিবাদের সবচেয়ে বড় ইস্যু। জয়েশ-ই মোহাম্মদ, লস্কর-ই তৈয়বার মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তান থেকে সেখানে অস্থিরতা সৃষ্টি করে বলে প্রমাণও রয়েছ। তবে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীকে রূপান্তরিত হওয়া বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর থেকে ভারতের অভ্যন্তরেই সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রতি তরুণদের আগ্রহ বৃদ্ধির খবর মিলছে প্রতিনিয়ত। সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি হাজির করেছে সেই পরিসংখ্যান। এতে দেখা গেছে, ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে সশস্ত্র পন্থায় উদ্বুদ্ধ তরুণের সংখ্যা। ২০১৫ সালে ৬৬, ২০১৬ সালে ৮৮ এবং ২০১৭ সালে ১২৬ জন তরুণ যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনে। চলতি বছরে এরইমধ্যে ৪৫ জন তরুণ সশস্ত্র সংগ্রামকে প্রতিরোধের হাতিয়ার বানিয়েছে।
নিখোঁজ হওয়ার আগে শুক্রবার সকালে শেষ ক্লাসে শিক্ষার্থীরা রাফিকে একটি হাতঘড়ি উপহার দেয়। ঘড়িটির ছবিসমেত এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া উপহার। তোমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কথা মনে রাখবো। আল্লাহ সবার মঙ্গল করুন।’ রাফির বাবা আব্দুল রহিম ভাট ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফার্স্ট পোস্টকে জানান, ৯০-এর দশকে তার দুই চাচাতো ভাই সশস্ত্র সংগ্রামের পথে গিয়ে নিহত হন। এরপর থেকেই তিনি রাফিকে নিয়ে ভয়ে ছিলেন। উপযুক্ত শিক্ষা ও পেশা তাকে ওই ধরনের সংগঠন থেকে দূরে রাখবে বলে তিনি আশা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমার মনে হয়, কোনোভাবে আমার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে’। ফেসবুকে এক কাশ্মিরি রাফির সম্পর্কে লিখেছেন, যদি এমন মানুষটি অস্ত্রকে একমাত্র সমাধান বলে মনে করেন তাহলে আমাদের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে বাস্তবেই অস্ত্র একমাত্র সমাধান কিনা। এ পথ কি আরও অনেক তরুণকে সশস্ত্র বিদ্রোহের দিকে টেনে নিয়ে যাবে? আমার আশঙ্কা এমনটা হবে। কিন্তু আশা, আমি যেন ভুল প্রমাণিত হই।’
কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ রবিবার লাদাখে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছেন, শিক্ষিত ও সফল চাকরিজীবী তরুণদের সশস্ত্র পথ বেছে নেওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। এই অঞ্চলের সংকটের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য সব পক্ষকে নিয়ে সংলাপে বসার আহ্বানের কথা যারা কানে তোলেন না, বিষয়টি নিয়ে তাদের অবশ্যই ভাবতে হবে।
সিঙ্গাপুরের এস রাজারাতনাম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনার স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক অনিত মুখার্জি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, এই গ্রীষ্মে আগের বছরগুলোর চেয়ে বেশি সহিংসতা হতে পারে। কারণ, স্থানীয় জঙ্গিদের মধ্যে সদস্য নিয়োগের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। আর কাশ্মির বিশ্লেষক শেখ শওকত হুসাইন ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, রাফির জঙ্গিবাদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে কাশ্মিরি তরুণদের মনে ভারতীয় সরকারে বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভেরই প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘তরুণদের মনে একটা পরিবর্তন এসেছে। তারা ভাবছে, ব্যাপক বিক্ষোভও কোনও কাজে আসছে না। তাই স্বাধীনতা পেতে তাদের অস্ত্র ধরতে হবে।’
এলএবাংলাটাইমস/আই/এলআরটি
শেয়ার করুন