অর্থনীতিতে ধাক্কা সামলিয়ে উঠা কতদিনে সম্ভব!
এক মাসেরও অধিক সময় ধরে চলা এ আন্দোলনে ব্যাপক প্রাণহানির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে বিপর্যস্ত হয়েছে এবং নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে। এই ক্রান্তিকালে এবং নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থায় দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
সহিংসতার কারণে জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশে পৌঁছে। এখন সরকারকে স্বল্পমেয়াদে হলেও এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে পারে তবে দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পাশাপাশি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসনের নিয়মিত বাজার মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রণালয়কে সবসময় সমন্বয় করতে হবে।দেশে এখন নিট রিজার্ভের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার। দেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য সংগৃহীত বড় অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী প্রবণতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬ বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী প্রবাহকে ঊর্ধ্বমূখী করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংক খাত। ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বেড়েছে বিদেশে অর্থপাচার। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুশাসনের অভাব ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের ঘাটতি এ খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো। ব্যাংক খাতে কোনো বিপর্যয় দেখা দিলে পুরো অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকগুলো বেসরকারি ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেই ব্যাংকগুলোর বেশকিছু এখন তারল্য সংকটে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম এবং মৃত প্রায়। বিগত সরকার পুঁজি সরবরাহ করে সেগুলো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। অন্যদিকে অধিকাংশ ব্যাংকে রাজনৈতিক বিবেচনায় একেবারে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় সংকট আরও তীব্রতর হয়েছে। এসব ব্যাংকগুলোর মালিকপক্ষ এবং পরিচালকদের অনেকের বিরুদ্ধে নামে বা বেনামে ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে আত্মসাৎ এবং পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ আদায়ে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বল্পমেয়াদে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি এ খাতের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে। বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত আনা যায় কিনা সে বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে হবে অন্তবর্তী সরকারের।
আমাদের দেশে ব্যবসায়ী, ঋণদাতা, ঋণগ্রহীতা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সব ব্যাংকের মালিকানা ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। পুরো আর্থিক খাতেই একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরাধী ধরার প্রক্রিয়ায় আবার এটিও খেয়াল রাখতে হবে যাতে অর্থনীতি ধসে না পড়ে। প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা যাতে বন্ধ হয়ে না হয় , সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
বহুদিন ধরেই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মূল্যস্ফীতি- এই দুটি ক্ষেত্রে সংকট চলছে; যা এখন আরও তীব্র হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সুদের হার ও মুদ্রা বিনিময় হারসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ঠিক রাখা এবং একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনাও চ্যালেঞ্জিং কাজ হবে অন্তবর্তী সরকারের জন্য।
গত দেড় দশকে দেশে সৎভাবে ব্যবসা করার কোনো সুযোগ ছিল না। গুটিকয়েক ব্যবসায়ী দেশে পণ্য আমদানি করতেন। আবার তারাই বেশি দামে পণ্য বিপণন করেছেন। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশের মানুষ তার সুবিধাভোগী হতে পারেনি। এখন সময় এসেছে বাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা তৈরি করার। তবে এটি করতে গিয়ে যাতে সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটিও দেখতে হবে।
রাজস্ব আদায়, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম থাকাসহ অর্থনীতির অন্যান্য সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। জোর দিতে হবে বিনিয়োগ ও নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে।
ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করতে হবে। সেখানে যে দুর্নীতি ও বিচ্যুতি হয়েছে, তা চিহ্নিত করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধ করে সুশাসন ফেরানোর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপই নেয়া হবে। এরই মধ্যে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে নজরদারি ও তদারকি বাড়ানো হয়েছে। আমদানি থেকে বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মূল্যের ব্যবধান কমানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
দেশের মানুষ প্রত্যাশার জায়গা থেকে সংকট উত্তরণের বাস্তবায়ন দেখতে চায়। ধাপে ধাপে সংস্কারের মাধ্যমে বৈষম্যহীন অর্থনীতির পথেই যেনো অগ্রসর হয় অন্তবর্তী সরকারের পথচলা।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন