পাশের বাসার ‘আন্টি’দের জীবনে ‘ফেস’ করেন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন
মাদক রাখার মিথ্যা অভিযোগে উদ্যোক্তা ও মডেল মেঘনা আলমকে আটক
প্রথমত, যেভাবে দরজা ভেঙে, পরিচয় গোপন করে, মাদক রাখার মিথ্যা অভিযোগে উদ্যোক্তা ও মডেল মেঘনা আলমকে আটক করা হয়েছে, তা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং এ ঘটনাকে গঠনমূলকভাবে "অপহরণ" হিসেবেও দেখার সুযোগ আছে।
আরও ভয়াবহ বিষয় হলো—বিভিন্ন বাহিনীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য: মেঘনা আলমকে নিয়ে যাবার পর থানা পুলিশ বলেছে তারা কিছু জানে না, ডিবি বলছে তারা কিছু করেনি, কয়েক ঘণ্টা পরে আবার ডিবি-ই তাকে আটকের কথা স্বীকার করেছে। যেনো এক 'লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড'-স্টাইলে নাগরিক অধিকার হরণের নাটক পরিচালিত হচ্ছে। এ ধরণের নাটক বিতর্কিত বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ভয়ানক অভাবকে স্পষ্ট করে। কথা হচ্ছে,
যে আইনে মেঘনা আলমকে আটক করা হয়েছে- কেন এখনও ১৯৭৪ সালের সেই বিতর্কিত বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রয়োগ করা হবে?
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন একটি অন্যায় এবং জনকল্যাণবিরোধী আইন হিসেবে বহু বছর ধরেই সমালোচিত। এটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে (অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগ) তৈরি হলেও, বর্তমান বাস্তবতায় এটি একটি অ্যানাক্রোনিজম, মানে সময়চ্যুত একটি আইনি যন্ত্র। যে ধরনের আইন ব্যবহার করে রাষ্ট্র তার কোনও নাগরিককে বিচারবিহীনভাবে আটক রাখে, তখন সেটা গণতন্ত্র নয়, একপ্রকার ‘লিগ্যালাইজড টায়রনি’ বা আইনি স্বৈরাচার। একটি দেশ যেখানে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে, সেখানে এই ধরনের আইনের অস্তিত্ব শুধু প্রশ্নবিদ্ধ নয়, বরং ন্যায়ের পরিহাস। এই আইন কেবল ব্যক্তি নয়, বরং রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোর উপরই এক ধরনের অবিশ্বাস প্রকাশ করে।
বিদেশি রাষ্ট্রদূতের ভূমিকায় কেন কূটনৈতিক ও আইনি অসদাচরণ?
এখানে একটি স্পর্শকাতর ও ভীতিকর দিক হলো—বিদেশি এক রাষ্ট্রদূতের ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অভিযোগ। এটি যদি সত্য হয়, তাহলে এটি কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, একটি দেশের উপর সরাসরি কূটনৈতিক আগ্রাসন। এর মাধ্যমে একজন বিদেশি কূটনীতিক কার্যত বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যক্তিগত পুতুল বানিয়ে ব্যবহার করছেন।
এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব ছিল বিবদমান দুই পক্ষকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে প্রচলিত ফৌজদারী আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অন্যথায়, উচিৎ ছিল সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রদূতকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া যে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র—এখানে ব্যক্তিগত প্রণয়ঘটিত আক্রোশে নাগরিক হয়রানির অনুমতি নেই। কিন্তু কথিত স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে আমরা বরং স্বৈরাচারী আচরণই দেখতে পেয়েছি।
মেঘনা আলম একজন সফল নারী উদ্যোক্তা ও পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিমানুষ হিসেবে পরিচিত। তার মতো একজন নারীর বিরুদ্ধে এমন আচরণ কেবল ব্যক্তি আক্রমণ নয়, বরং নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক অগ্রযাত্রার প্রতীকভঙ্গের এক নগ্ন প্রচেষ্টা। এই ধরণের ঘটনা নারীদের জন্য 'চুপ থাকো, না হলে তুমিও...' ধরনের সতর্কবার্তা বহন করে। যা ভয়াবহভাবে পিতৃতান্ত্রিক এবং মানবাধিকারের পরিপন্থী। উপরন্তু,
এখানে আইনের ব্যবহার হয়নি, হয়েছে আইনকে অস্ত্র হিসেবে অপব্যবহার। কেননা, একজন স্বাধীন নাগরিক যখন রাতের আঁধারে অপহরণের মতো করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন রাষ্ট্রের মৌলিক নৈতিক অবস্থান খর্ব হয়। রাষ্ট্র তখন আর জনগণের হয়ে নয়, ক্ষমতার হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। অতএব,
এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত, সংশ্লিষ্ট বাহিনীর জবাবদিহিতা, এবং অবিলম্বে এই বিতর্কিত বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংশোধন বা বিলুপ্তির দাবি তুলতে হবে। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, বরং নিরাপত্তার নামে আতঙ্ক তৈরি করে, তবে সেই রাষ্ট্র কোনভাবেই গণতান্ত্রিক না; এটা মিথ্যার মুখোশে ঢাকা এক স্বৈরতন্ত্র ছাড়া কিছুই না।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন