জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান আর নেই
বাংলাদেশে শিশু চিকিৎসার পথিকৃৎ চিকিৎসক, জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান আর নেই। শনিবার (৫ নভেম্বর) বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে নিজের প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
খ্যাতনামা এই শিশু বিশেষজ্ঞের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তার স্ত্রী মিসেস আনোয়ারা খাতুন আগেই মারা যান। একমাত্র মেয়ে ম্যান্ডি করিম কানাডা প্রবাসী।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের পরিচালক ডা. এম এ কাশেম জানান ‘বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা নিয়ে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। সম্প্রতি দেশে ও দেশের বাইরে তার দুই-তিনটি অস্ত্রোপচার হয়েছিল।’
জানা গেছে, বর্ষীয়ান এই চিকিৎসক কয়েকমাস ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন। মাঝে দুদফায় সিঙ্গাপুরে তার অস্ত্রোপাচার করা হয়। এরপর দেশে ফিরে সেন্ট্রাল হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে বেশ কিছুদিন ধরে সেখানকার আইসিইউতেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।
এম আর খান ১৯৮৮ সালে আইপিজিএমআরের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) যুগ্ম-পরিচালক এবং শিশু বিভাগের অধ্যাপক পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯৫ সালে সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে ভূষিত করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ২০০৯ সালে তিনি একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদক অর্জন করেন। শিশু চিকিৎসার ওপর তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন যা মেডিকেল কলেজের পাঠ্যসূতিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। চিকিৎসার পাশাপাশি জনসেবায়ও তিনি অনেক কাজ করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে ঢাকার গ্রিন রোডে সেন্ট্রাল হসপিটাল লিমিটেড, মিরপুরে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ এন্ড শিশু হসপিটাল, ধানমন্ডিতে নিবেদিতা মেডিক্যাল সেন্টার এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, উত্তরায় মেডিক্যাল কলেজ ফর উইমেন, সাতক্ষীরা ও যশোরে শিশু হসপিটালসহ আরো অনেক স্বাস্থ্যসেবামুলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। দুস্থ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, তাদের আর্থিক-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে তার পেনশনের টাকা দিয়ে গড়েন ডা. এম আর খান-আনোয়ারা ট্রাস্ট।
জানা গেছে, রবিবার (৬ নভেম্বর ২০১৬) সকাল সাড়ে ১০টায় সেন্ট্রাল হাসপাতালে প্রথম জানাযা, বিএসএমএমইউতে সকাল ১১টায় দ্বিতীয় জানাজা এবং মিরপুরে এম আর খানের শিশুস্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনে তৃতীয় জানাজা শেষে সাতক্ষীরার রসুলপুরের গ্রামের বাড়িতে তাঁর লাশ দাফন হবে।
এম আর খানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, বিএসএমএমইউ-র ভিসি অধ্যাপক কামরুল হাসান খান, বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক এসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা, কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক হারুন আর রশিদ, দ্য লিভার বাংলাদেশের পরিচালক অধ্যাপক মবিন খান প্রমুখ।
১৯২৮ সালের ১ আগস্ট সাতক্ষীরার রসুলপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এম আর খান নামে তিনি সর্বাধিক পরিচিত হলেও তাঁর পুরো নাম মো. রফি খান। বাবা মা, প্রতিবেশি সকলের কাছে খোকা নামে বেশি পরিচিত ছিলেন।
দশ বছর বয়সে সাতক্ষীরা সদরের প্রাণনাথ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় (পিএন স্কুল)-এ ভর্তি হন তিনি। পড়াশুনায় খুব মেধাবী ছিলেন তিনি। ছেলেবেলায় ভাল ফুটবলও খেলতেন। ১৯৪৩ সালে এ স্কুল থেকেই কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজে পড়ার সময় তিনি হাজী মহসীন বৃত্তি লাভ করেন। ড. কুদরত-ই-খুদা ছিলেন তাঁর শিক্ষক। ১৯৪৫ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৪৬ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন তিনি।
তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করে বিলেতের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান এবং ব্রিটেনের এডিনবার্গ স্কুল অব মেডিসিন-এ ভর্তি হন। এডিনবরা থেকে তিনি ডিটিএমএন্ডএইচ ও এমআরসিপি এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিসিএইচ, ১৯৭৪ সালে ঢাকার পিজি থেকে এফসিপিএস এবং ১৯৭৮ সালে এডিনবরা থেকে এফআরসিপি ডিগ্রি অর্জন করেন।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান কৃতিত্বের সাথে শিশু চিকিৎসা ও ডাক্তারি শাস্ত্রে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম মানের ডিগ্রি অর্জনের পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ, সাবেক পিজি হাসপাতালসহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, চিকিৎসা সেবা প্রদানসহ একজন সফল শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। দেশ বিদেশে তার চিকিৎসার অনেক সুনাম রয়েছে। তাঁকে বলা হয় শিশুরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ। বাংলাদেশের শিশুস্বাস্থ্যের জনক হিসেবেও তিনি সর্বজনস্বীকৃত। তিনি ১৯৭৩ সালে ঢাকার আইপিজিএমআর-এ শিশুস্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় এমসিপিএস, ডিসিএইচ এবং এফসিপিএস কোর্স চালু করেন।
সদালাপী, মিষ্টভাষী ও সমাজহিতৈষী এই মানুষটির ছিলো ক্লান্তিহীন পথচলা। সততা, একনিষ্ঠতা, উদারতা, আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় ও নিরন্তর সাধনায় একক প্রচেষ্টায় তিনি সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছান।
এলএবাংলাটাইমস/এন/এলআরটি
শেয়ার করুন