শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করে সংবাদ , পত্রিকা অফিসে আগুন
বন্দুকযুদ্ধ : র্যাবের বিরুদ্ধে একরামুলের স্ত্রীর গুরুতর অভিযোগ
ফোন কলের অডিও প্রকাশ
কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হলেও নিহতের স্ত্রীর দাবি, তার স্বামীকে একতরফা গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
একরামুল নিহত হওয়ার আগে স্ত্রী আয়েশা বেগমের সঙ্গে তার কথা হয়েছিল। আয়েশার দাবি, তার স্বামী নির্দোষ, কিন্তু র্যাব তাকে গুলি করে হত্যা করেছে।
মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা ১৪ মিনিটের একটি কলের অডিও প্রকাশ হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে, যেখানে একজন নারী তার স্বামীকে কাউন্সিলর হিসেবে উল্লেখ করে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়। আরও শোনা যায় সাইরেনের শব্দ।
এর মধ্যে কয়েকজনের ‘কুত্তার বাচ্চা’ ‘শুয়রের বাচ্চা’ বলে গালিগালাজও আছে ওই অডিওতে।
ধারণা করা হচ্ছে যে নারী ‘আমার জামাই কিছু করে নাই’, ‘আমার জামাই কিছু করে নাই’ চিৎকার করছিলেন, সেটি আশেয়া বেগমের। আর তিনি একরামুলের কথাই বলছিলেন।
২৬ মে দিবাগত রাতে কক্সবাজারে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন একরামুল। গত ৪ মে থেকে শুরু হওয়া বিশেষ অভিযানে এ রকম বন্দুকযুদ্ধ বা গোলাগুলিতে ১২০ জনের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই র্যাব বা পুলিশ দাবি করছে সন্দেহভাজনকে ধরতে গেলে তিনি বা তার সহযোগী অথবা সন্দেহভাজনকে নিয়ে অভিযানে গেলে তার সহযোগীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলি করেছে। পাল্টা গুলিতে প্রাণ গেছে সন্দেহভাজনের।
এই বর্ণনা অবশ্য এবারই প্রথম নয়, ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে র্যাব গঠনের পর থেকে ব্যাপকভাবে শুরু হওয়া ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে এমন বর্ণনাই দিয়ে আসছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু এই বর্ণনা কখনও বিশ্বাসযোগ্য হয়নি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে।
এর মধ্যে ৩১ মে কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলন করেন একরামুলের স্ত্রী আয়েশা এবং তার দুই কন্যা তাহিয়াত ও নাহিয়ান। তারা সেদিন বলেন, একরামুলেক হত্যা কোনো বন্দুকযুদ্ধ ছিল না। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ঠান্ডা মাথায়।
ওই সংবাদ সম্মেলনেই একরামুলের স্ত্রী মোবাইল ফোনে কথোপকথনের চারটি রেকর্ড দেন সাংবাদিকদের। আর চারটি রেকর্ড মিলিয়ে মোট ১৪ মিনিটের অডিওটি প্রকাশ হয়েছে। তবে সেটি একরামের সঙ্গে তার স্ত্রী এবং কন্যার কথোপকথনেরই কি না, সেটি যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
কথোপকথনে যা আছে
ফোনে কথা চলছে...
পুরুষ কণ্ঠ: আম্মু! অপরপ্রান্ত থেকে, জে..।
পুরুষ কণ্ঠ: তোমার আম্মু কোথায়?
অপরপ্রান্ত থেকে: আছে।
পুরষ কণ্ঠ: মেজর সাহেবে ডাকছিল। অস্পষ্ট কথা.....। তোমার আম্মুকে বলিও।
অপরপ্রান্ত থেকে: আসতে দেরি হবে যে?...এরপর ফোনের লাইন কেটে যায়।
আবার ফোন রিং হয়-
মেয়ের কণ্ঠ: হ্যালো আব্বু, তুমি কেথায়?
পুরুষ কণ্ঠ: আমি টিএনও অফিসে যাচ্ছি তো, আমি চলে আসব আম্মু।
মেয়ের কণ্ঠ: কতক্ষণ লাগবে?
পুরুষ কণ্ঠ: বেশিক্ষণ লাগবে না। আমি চলে আসব ইনশাল্লাহ। ঠিক আছে? রাখলাম...। এরপর ফোনের লাইন কাটার শব্দ।
আবার ফোন....
মেয়ে: হ্যালো আব্বু! জি আম্মু। আম্মু আমি হ্নীলা যাচ্ছি। মেয়ে: কেন?
পুরষ কণ্ঠ: জরুরি কাজে যাচ্ছি।......মেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে কেন?
পুরুষ কণ্ঠ: যাচ্ছি আম্মু.....(কান্নার স্বরে কথা)।
মেয়ে: যাচ্ছ, তুমি কান্না করতেছ যে...?
এরপর মেয়ের থেকে ফোন নিয়ে...নারীর কণ্ঠ: হ্যালো... হ্যালো...লাইন কেটে যায়।
এরপর আবার ফোন
নারী কণ্ঠ: ফোন রিং হচ্ছে আর কথা বলছে... আল্লাহ একবার মোবাইলটা দে, আল্লাহ একবার মোবাইল দিয়া কথা কইতে দে...আল্লাহ। ফোন রিসিভ হওয়ার পর..হ্যালো কে (নারী কণ্ঠ)? হ্যালো কে? ওপাশ থেকে অনুচ্চ স্বরে কথা বার্তা...
হ্যালো আমি কমিশনারের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি। হ্যালো কে ওইটা...ফোন রিসিভ করছে ওইটা কে...অপরপাশ থেকে অনুচ্চ স্বরে কথা। আমি ওনার মিসেস বলতেছি।
অপর পাশ থেকে আওয়াজ আসছে...এটা বলছ....জ্বি। জড়িত, না?...জ্বি...অনুচ্চ কথা...ট্রিগার টানার শব্দ....গুলির আওয়াজ...ও করে চিৎকারের শব্দ...গোঙানির আওয়াজ.....আবার গুলির শব্দ।
এসময় ফোনের এপাশ থেকে ও আল্লাহ বলে চিৎকার করে ওঠেন নারী। কান্না করে চলছেন মা মেয়ে...আমার জামাই কিছু করে নাই। আমরা বিনাদোষী। আমার হাজব্যান্ড কিছু করে নাই। ফোনের অপর পাশ থেকে অস্পষ্ট কথা বার্তা।....শুয়োরের বাচ্চা বলে গালাগালি...বাঁশি ফুকার শব্দ...ওই কুত্তার বাচ্চা ধর...ওই ধর ওই ধর...(এসব কিছুই হয় গুলি করার পর। যেন আসামি পালাচ্ছে আর র্যাব গুলি করল। অথচ গুলি করা হয় আগে। পরে ধর ধর।)
এপাশে নারী কান্না করে বলে চলছেন...আপনারা কোথায়...আমার জামাই কিছু করে নাই...।
অডিও রেকর্ডের বাকি আওয়াজে সাইরেনের শব্দ আর অস্পষ্ট এবং অনুল্লেখযোগ্য নানা কথাবার্তা আছে।
শুরু থেকেই ছিল নানা প্রশ্ন
একরামুল নিহতের পরই এই বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন উঠে। তার বিরুদ্ধে মাদক সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২০০৮ সালে একবার মামলা হয়েছিল। তবে সেটি আদালতে মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে একরামুলের দ্বন্দ্ব তৈরি হয় এবং সে দ্বন্দ্বেই তাকে মাদক দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু পুলিশের তদন্তে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হয় আর আদালত তাকে খালাস দেয়।
টেকনাফ পৌরসভার তিনবারের কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না বলে নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রঞ্জিত কুমার বড়ুয়া।
‘বন্দুকযুদ্ধে’ টেকনাফের কাউন্সিলরের মৃত্যুর পর তার আর্থিক অসঙ্গতির বিষয়টি সামনে এসেছে। এই বিষয়টি তার মাদক কারবারির পরিচয়কেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
একরামের নিজের কোনো ঘর বাড়ি নেই। বাবার বাড়িতে দুটি কক্ষে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। তিনি পাঁচ বছর আগে বাবার জমিতে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করলেও টাকার অভাবে তা শেষ করতে পারেননি।
এই জনপ্রতিনিধির এক মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে এবং এক মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। টাকা পয়সার অভাবে তাদেরকে ভালো স্কুলে দিতে পারেননি একরাম।
মাসের বাজারের একটি বড় অংশই বাকিতে করে থাকে একরামের পরিবার। দোকানিদের কাছে অনেক দেনাও আছে তার।
একরামের মৃত্যুর পর থেকে বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় পর্যায় এবং সামাজিক মাধ্যমে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এসেছে। অতীতে একরামের সঙ্গে রাজনীতি করা কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে ফেসবুকে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। তিনি স্পষ্টতই লিখেছেন, চক্রান্ত হয়েছে একরামুলকে নিয়ে।
নিহত জনপ্রতিনিধির আর্থিক করুণ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে কক্সবাজারের মেয়র লেখেন, ‘যার চাল চুলো নেই, থাকার জন্য বাড়ি নেই। পরিবার ও সন্তানদের লেখাপড়া চালানোর জন্য যাকে নির্ভর করতে হয় ভাইদের ওপর, বন্ধুদের ওপর। আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে জনগণকে সেবা করতে গিয়ে দেনার দায়ে যার সব শেষ তাকে বানানো হচ্ছে ইয়াবা গড়ফাদার! হায় সেলুকাস।’
তবে একরামুলেকে মাদককারবারি আখ্যা দিয়ে কক্সবাজার র্যাব-৭ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন সে সময় বলেন, ‘সে (একরামুল) মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকার শীর্ষে ছিল। এই তালিকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা। অপরাধ জগতে সে ইয়াবা গডফাদার হিসেবেও পরিচিত।’
‘আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী দুটি মামলায় একরামুল অভিযুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে টেকনাফ থানায় একটি মাদক সংক্রান্ত মামলা রয়েছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও অনেক মামলা রয়েছে।’
বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া
মে মাসের দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে বন্দুকযুদ্ধে ব্যাপকভাবে প্রাণহানি শুরুর পর মাদক নিয়ে অভিযানে বন্দুকের ব্যবহার নিয়ে তীব্র আপত্তি উঠে। মানবাধিকার কর্মীদের পাশাপাশি বিএনপিও এভাবে অভিযানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা বলছেন, বন্দুকযুদ্ধের নাম যা হচ্ছে, সেটি বিচারবহির্ভূত হত্যা। তারা সন্দেহভাজনদের আদালতের মাধ্যমে বিচার করার পক্ষে।
এমনকি ৩১ মে সংসদীয় কমিটিও সরকারের কাছে সতর্কতার সঙ্গে অভিযান চালানোর সুপারিশ করেছে।
এলএবাংলাটাইমস/এন/এলআরটি
শেয়ার করুন