আপডেট :

        কারা কফি থেকে বিরত থাকবেন, জেনে নিন—

        পশ্চিমা সমর্থন ছাড়া কি ইসরায়েলের অস্তিত্ব টিকবে? বিশ্লেষকদের মতামত

        নারী ও শিশু নির্যাতন মহামারি পর্যায়েঃ শারমীন মুরশিদ

        ‘শ্রাবণ বিদ্রোহ’: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের তথ্যচিত্র প্রদর্শন ৭ জুলাই

        লিভারপুল ও পর্তুগালের তারকা দিয়াগো জোতা গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত

        জুলাই সনদের দাবিতে অনড় এনসিপি, নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না: নাহিদ

        প্রধানমন্ত্রী থেকে সংস্কৃতিমন্ত্রী: পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার নতুন ভূমিকা

        বিটিএস ফিরছে পুরো দমে: ২০২৬-এ নতুন গান ও গ্লোবাল ট্যুরের প্রতিশ্রুতি

        ‘কফি খাচ্ছিলাম, চিল করছিলাম—হঠাৎ দেখি পাঁচ উইকেট নেই’

        দুপুরে আজ জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে বিএনপি

        পহেলগাম হামলার পর নিষেধাজ্ঞা শিথিল, পাকিস্তানি সেলিব্রিটিদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্সেস ফিরল

        করোনার টিকা নিরাপদ, আকস্মিক মৃত্যুর গুজবে জবাব দিল গবেষণা

        জুলাই বিপ্লবের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ কিছু মানুষঃ বাঁধনের আক্ষেপ

        শুঁটকি পিৎজা: উত্তরায় ঢাকার খাবারের নতুন ট্রেন্ড সেট করছে

        অর্থ উপদেষ্টার বিপাকে পড়ার কারণ এনবিআর নিয়ে প্রকাশিত খবর

        বাংলাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী জীনাত রেহানা প্রয়াত হয়েছেন

        টাইগারদের শক্তিশালী শুরু: প্রথম সেশনেই তিন উইকেটের ধাক্কা

        ট্রাম্পের বাজেট বিল নিয়ে মাস্কের তীব্র সমালোচনা: শত্রুতার শুরু

        স্বৈরাচারের ছায়া মুছে ফেলতে তৎপর সমাজ

        ধর্ষকের শাস্তি সবার সামনে হোক: সোহম

ঘরে ডেঙ্গু, বাইরে করোনা

ঘরে ডেঙ্গু, বাইরে করোনা

সারোয়ার হোসেন আমার সহকর্মী, এটিএন নিউজের এসাইনমেন্ট এডিটর। সারোয়ার খুবই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। যে কোনো স্বাস্থ্যবিধি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা মানুষ। এতটাই সচেতন, আমরা বলি চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাকে অ্যাম্বাসেডর নিয়োগ দিতে পারে। কিন্তু সর্বোচ্চ সচেতনতাও তাকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারেনি। মাত্র তিনদিনের জ্বরে সারোয়ারের একমাত্র সন্তান শাবাব সারোয়ার ছবি হয়ে গেছে।

ডেঙ্গু বোঝার পর স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়েও শাবাবকে বাঁচানো যায়নি। গত বুধবার রাতে মাত্র ১০ বছর বয়সী ফুটফুটে শাবাব স্বর্গের বাগানের ফুল হয়ে গেছে। রোববার ছিল শাবাবের কুলখানি। তারাবোর কবরস্থানে শাবাবের ছোট কবরটির পাশে দাঁড়িয়ে বেদনায় আমাদের বুক ভেঙ্গে যায়। গত কদিন ধরেই এটিএন নিউজ পরিবার শোকে আচ্ছন্ন। কিন্তু শত শোকও তো সান্ত্বনার প্রলেপ হতে পারবে না সারোয়ারের জন্য।

সহকর্মী, স্বজন- আমরা সবাই আইসিইউর সামনে অপেক্ষা করেছি নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য। কী ভয়ঙ্কর সেই অপেক্ষা, যে না করবে, সে কোনোদিনও বুঝবে না। সৃষ্টিকর্তা, তুমি তোমার সৃষ্টিকে রক্ষা করো, এই ভয়ঙ্কর সময় থেকে। আমরা কত লাশ গুণবো? মৃত্যুর রেকর্ডের ভার আর কততিন বইতে হবে?

সারোয়ার সহকর্মী বলে শোকটা এত বেশি আঘাত করেছে আমাদের। কিন্তু আমরা জানি প্রতিদিন দেশে অন্তত আড়াইশ পরিবার এমন বুক ভাঙ্গা হাহাকারে ভেসে যাচ্ছে। আসলে জানি না আমরা কী করবো। কীভাবে রক্ষা করবো, আমাদের সন্তান, আমাদের স্বজনকে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর দায় সিটি করপোরেশন এড়াতে পারবে না। এতটুকু সংবেদনশীলতার জন্য তাকে ধন্যবাদ। কিন্তু সিটি করপোরেশনের দায়, মেয়রের সংবেদনশীলতা তো আমাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেবে না।

বিশ্বজুড়েই করোনা এক ভয়ঙ্কর অতিমারি হয়ে এসেছে। বাংলাদেশেই করোনায় মারা গেছে ২২ হাজারের বেশি মানুষ। করোনা ঠেকানোর কার্যকর কোনো পন্থা এখনও কেউ পায়নি। অন্তত ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে পারলে হয়তো করোনার বিপদ নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে সেটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ততদিন বসে বসে লাশ গোনা ছাড়া কি আামাদের আর কিছুই করার নেই? আছে- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ত ব্যবহার করা। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমার নিজের ওপরে বা আমাদের পরিবারের ওপর আঘাত না আসছে, ততদিন যেন আমরা করোনার বিপদটা বুঝতেই পারছি না।

‘কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভূ আশীবিষে, দংশেনি যারে।’ সমস্যাটা হলো, আমি স্বাস্থ্যবিধি না মানলে বিপদটা শুধু আমার নয়, আমার চারপাশের সবার। তাই স্বাস্থ্যবিধি মানা না মানাটা নিছক ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয় নয়। সবার সুরক্ষার জন্য সবাইকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ধরুন আপনার বাসার ১০ সদস্যের ৯ জনই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেন। কিন্তু একজন খামখেয়ালী করলো। সেই একজন কিন্তু বাকি ৯ জনকেও বিপদে ফেলতে পারে। আর এই বিপদ কিন্তু যেনতেন বিপদ নয়, একেবারে মৃত্যু ঝুঁকি।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে থাকলেও আপনি নিরাপদ নন। নিজেকে যতই বন্দী রাখুন, এডিস মশা কিন্তু উড়ে উড়ে আপনার ঘরে চলে আসতে পারে। আপনাকে ডেঙ্গুর বিপদে ফেলতে পারে। জ্বলন্ত কড়াই থেকে ফুটন্ত উনুনে, জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’এর সাথে এখন নতুন প্রবচন যুক্ত হবে- ঘরে ডেঙ্গু, বাইরে করোনা।

সারোয়ার শত সচেতন হয়েও তার সন্তানকে বাঁচাতে পারেনি। সারোয়ারের বনশ্রীর বাসায় গিয়ে দেখেছি, তার উল্টাপাশে খালি প্লটে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। একটু দূরেই কনস্ট্রাকশন কাজ হচ্ছে। শাবাবের লাশের পাশেই দেখেছি জমে থাকা পানি, এডিসের কারখানা। সারোয়ার নিজে যতই সচেতন হোক তার পক্ষে তো পুরো বনশ্রী এলাকা এডিসমুক্ত রাখা সম্ভব নয়।

শাবাবের মৃত্যু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, আমরা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ শহরে বাস করি। বর্ষাকালে ডেঙ্গু আসবে, এটা তো সবাই জানে। সিটি করপোরেশন জানে, মেয়র জানেন। বর্ষাকাল কবে আসবে, এডিস কবে আসবে, ডেঙ্গু কবে মারবে; সবই তো জানা। তাহলে আমরা সাবধান হলাম না কেন। আমি জানি, সিটি করপোরেশন মশা মারতে কী কী কামান দাগিয়েছেন তার বিশাল ফিরিস্তি দেবেন। কিন্তু তাদের ফিরিস্তি শুনে তো আমার সন্তান ফিরবে না। আর ছেলেবেলায় কাজের সংজ্ঞায় পড়েছি, সারাদিন ঠেলেও যদি পাথর সরানো না যায়, তাহলে সেটা কোনো কাজ নয়। এখন আপনি শত চেষ্টা করলেন, কিন্তু মশা মরলো না; তাহলে সেটা তো কোনো কাজ হলো না। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মশা মারার একটা কার্যকর পদ্ধতি আমরা আবিস্কার করতে পারবো না; তাহলে এই সভ্যতা, এই ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল কী রইলো। মেয়র নিশ্চয়ই ভাবছেন, এভাবে নানান চেষ্টা দৃশ্যমান করে, দায় স্বীকার করে আর দুটি মাস পার করতে পারলে; একবছরের জন্য নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। কিন্তু এই দুই আরো কত শাবাবকে কেড়ে নেবে কে জানে, কে তার হিসাব রাখবে। সারোয়ারের জন্য শাবাবই ছিল পৃথিবী, কিন্তু সরকারের খাতায় শাবাব তো একটি পরিসংখ্যান মাত্র।

কদিন আগেও জ্বর হলে আমরা করোনা সন্দেহ করতাম, করোনা টেস্ট করতাম। কিন্তু এখন করোনার সাথে ডেঙ্গুও টেস্ট করতে হবে। কোনটা করোনা, কোনটা ডেঙ্গু বোঝার উপায় নেই। ডেঙ্গু রোগী নিয়ে করোনা হাসপাতালে গেলে আপনি ভর্তি হতে পারবে না। আবার করোনা রোগী নিয়ে ডেঙ্গু হাসপাতালে গেলে আপনাকে ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু করোনা বা ডেঙ্গু যাই হোক, সব রোগীরই কিছু জরুরি চিকিৎসা লাগে। ডেঙ্গু রোগীর যেমন ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট জরুরি, করোনা রোগীর তেমনি অক্সিজেন ম্যানেজমেন্ট জরুরি। সঠিক হাসপাতাল খুঁজে বের করতে করতে রোগী মৃত্যুর দুয়ারে চলে যায়। অবস্থাটা হয়েছে, ভেতরে কারো মৃত্যুর অপেক্ষায় আইসিইউর সামনে বসে থাকে কোনো সঙ্কটাপন্ন রোগী।

এ এক জটিল সময়ে বাস করছি আমরা। আমাদের সকল সম্পদ, সকল বড়াই, সকল শিক্ষা, সকল ক্ষমতা, সকল অর্থ- অর্থহীন হয়ে যায় হাসপাতালের বারান্দায়। বুধবার সকালে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পরই স্কয়ারের ডাক্তাররা আসলে বুঝিয়ে দিয়েছিল শাবাবের বাঁচার আশা নেই। তারপর রাত দুইটা পর্যন্ত সারোয়ার, তার পরিবার, তার সহকর্মী, স্বজন- আমরা সবাই আইসিইউর সামনে অপেক্ষা করেছি নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য। কী ভয়ঙ্কর সেই অপেক্ষা, যে না করবে, সে কোনোদিনও বুঝবে না। সৃষ্টিকর্তা, তুমি তোমার সৃষ্টিকে রক্ষা করো, এই ভয়ঙ্কর সময় থেকে। আমরা কত লাশ গুণবো? মৃত্যুর রেকর্ডের ভার আর কততিন বইতে হবে?


লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত