আপডেট :

        বাজেট অধিবেশন বসছে কাল

        সিলেটে কিশোরী মাকে ‘দলবেঁধে ধর্ষণ’, গ্রেপ্তার ৫

        ড. ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

        ঈদ উপলক্ষ্যে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু ১৪ জুন

        জিয়াউর রহমানের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

        সিসিক নির্বাচনে সাধারণ কাউন্সিলর পদে একমাত্র নারী রোকসানা

        ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দেওয়া হল একহাজার টাকার খাম

        যুক্তরাজ্যে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পরিবার নেওয়ার পথ বন্ধ হচ্ছে

        পাকিস্তানের কোনো প্রস্তাবেই রাজি নয় ভারত

        এরদোয়ানকে বাইডেন-পুতিন-জেলেনস্কির অভিনন্দন

        কিয়েভে ফের রাশিয়ার বিমান হামলা

        ফের তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী এরদোয়ান

        শেষ দফার ছাঁটাই শুরু মেটায়

        সাদা নাকি লাল, কোন চিনি খাবেন?

        বিকালের নাশতায় পটেটো ওয়েজেস

        হুমায়ুন ফরীদি: অভিনয়ের সঙ্গে তার যেসব কথা রয়ে গেছে

        সার্বিয়ায় সামান্থার সঙ্গী বলিউড নায়ক বরুণ ধাওয়ান

        আমাদের নিয়ে যা যা রটছে, তার ভিত্তি নেই- সৃজিত

        খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের নতুন তারিখ

        মারধরের অভিযোগের মামলায় তিন মাসের আগাম জামিন পেলেন নিপুন রায়

আফগানিস্তানে মার্কিন পিছুহটা

আফগানিস্তানে মার্কিন পিছুহটা

সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভ বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আফগান আগ্রাসন ছিল একটি মন্দ ধারণা’।

সেই আক্রমণ ও দখলদারিত্বের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ভুলের পর ভুল করে যাচ্ছিল। চূড়ান্ত পরিণতিতে পরাজয়ের মাধ্যমে সেই ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে ওয়াশিংটনকে। প্রথমত, ‘৯/১১’ ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিশোধস্বরূপ এমন দেশকে আক্রমণ করল, যে দেশের সরকার বা নাগরিক কোনোভাবেই ওই ঘৃণ্য হামলার সাথে জড়িত নয়। তখনকার আফগান সরকার বিন লাদেনকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেনি। শুধু লাদেনের সম্পৃক্ততার প্রমাণপ্রাপ্তি সাপেক্ষে হস্তান্তরের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ আফগান সরকারের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে অত্যাধনিক অস্ত্র ও সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে হতদরিদ্র যুদ্ধবিধস্ত দেশটিতে আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নেন।

এমন একটি ভুল প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভুলই করেছে আফগানিস্তানে। অধিকৃত দেশের দখলদারিত্ব কায়েমে ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ের মাত্র ২ শতাংশ খরচ করেছে আফগানদের উন্নয়নে। ব্রিটিশ সশস্ত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল নিক কার্টার বলেছেন, ‘প্রত্যেকেই সেখানে ভুল করেছে, ভুল গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে’ (নয়া দিগন্ত : ০৭/০৯/২০২১)। দখলের পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তালেবানকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক করে রেখেছিল। সরকার গঠন, সংবিধান প্রণয়ন সব জায়গা থেকে তালেবানকে দূরে রাখা হয়। যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সক্ষমতা বুঝতে ভুল করেছে। কাজেই তারা অ-পশতুন অঞ্চলের যুদ্ধবাজ নেতা ও তাদের অনুগত মিলিশিয়াদের ওপরই নির্ভর করেছে। হেরাতের ইসমাইল খান, উত্তর-পশ্চিমের বালাখ প্রদেশের আব্দুর রশিদ দোস্তাম, পঞ্জশিরের আহমেদ মাসুদ ইত্যাদি ওয়ারলর্ডদের ওপরই ওয়াশিংটন নির্ভরশীল ছিল।

আফগানিস্তানের সমাজব্যবস্থা, ইতিহাস, ভূমিবিন্যাস ইত্যাদি মৌলিক বিষয় বাদ দিয়ে শুধু রাজনৈতিক কৌশল ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের ওপর নির্ভর করেই তালেবানকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল। বিদেশী দখলদারদের প্রতি আফগানদের তীব্র ঘৃণা, তাদের লড়াকু সংস্কৃতি, অতি রক্ষণশীলতা, গোত্রভিত্তিক সমাজ ইত্যাদি আমেরিকানরা বুঝতে চেষ্টা করেনি। বরং ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের আদলে পশ্চিমা ধাঁচের একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণের চেষ্টা করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে বাইরে থেকে মূল্যবোধ চাপিয়ে দেয়ার ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ আমেরিকান নীতির সমালোচনা করেন।

তিনি বলেন, ‘একটা দেশের জনগণ কী করবে, না করবে; তাদের রাজনৈতিক জীবন কেমন হবে তার মানদণ্ড আপনারা (বাইরের শক্তি) চাপিয়ে দিতে পারবেন না’ । এভাবে মার্কিন মদদপুষ্ট সরকার কখনোই জনসম্পৃক্ত হতে পারেনি বা হওয়ার চেষ্টাও করেনি। আর আফগান সরকারি বাহিনী বেতনভুক হয়ে আমেরিকানদের সহায়তা করেছে মাত্র। কারণ দখলদার বাহিনী শুধু আলকায়েদা ও বিন লাদেনকেন্দ্রিক কাজ করেছে। তালেবানের দর্শন নিয়ে কখনো ভাবেনি।

আমেরিকার ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আফগানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. ইউসুফ জাই বলেন, ‘আমেরিকানদের মূল কৌশল ছিল শুধু প্রধান শহরগুলো কব্জায় রাখা। শহরের বাইরে নিয়ন্ত্রণ ছিল তালেবানের হাতে। তালেবান জানত আমেরিকা একসময় আফগান ছাড়বেই। শুধু সময়ের অপেক্ষায় ছিল তারা’। ফলে মার্কিন বাহিনী তালেবানের প্রকৃত যুদ্ধকৌশল না বুঝেই অত্যাধুনিক যুদ্ধসরঞ্জামের অহমিকায় শুধু অবজ্ঞাই করেছে ২০ বছর। এ জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্কীয় কমিটির চেয়ারম্যান মেনেনডেজ বলেছেন, ‘আজকের পরাজয়ের ঘটনা রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট প্রশাসকদের গত ২০ বছর ধরে ধারাবাহিক ভুলগুলোরই চূড়ান্ত পরিণতি। আজ আমরা বহু বছরের গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং ভূলনীতির কারণে এ ভয়াবহ ফল হজম করছি’।

মার্কিন ভূরাজনীতির অগ্রগণ্যতা পরিবর্তন : ২০ বছরে মার্কিন ভূরাজনৈতিক ক্যানভাসে যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। বিশ্ব ইউনিপোলার ব্যবস্থা আস্তে আস্তে মাল্টিপেলার ব্যবস্থায় রূপান্তর হতে চলেছে। ইরান, রাশিয়া ও চীন শক্তিশালী হয়ে ওঠার সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে একটি অলিখিত অক্ষ সৃষ্টি হয়েছে। তুরস্ক শক্তিমত্তার জানান দিচ্ছে। আর চীন অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার সাথে সাথে আঞ্চলিক ও বিশ্বের ভূরাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে করোনার সূত্রপাত, প্রতিরোধ এবং টিকা কূটনীতিতে বিশ্বে একক আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। অন্য দিকে আমেরিকাসহ পুরো পশ্চিমা বিশ্ব করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। একই সাথে চীন দক্ষিণ চীন-সাগরে একাধিপত্য বিস্তারে বদ্ধপরিকর। বেইজিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ জনপ্রিয়তা পেয়েছে যা চীনকে কৌশলগত সুবিধা দিচ্ছে।

এ পটভূমিতে করোনার উৎপত্তি, হংকং ইস্যু এবং দক্ষিণ-চীন সাগরের আধিপত্য ইত্যাদি বিষয়ে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের মুখোমুখি চীন। এ অবস্থায় ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ উছিলা থেকে মনোযোগ সরিয়ে চীন ঠেকানোকে অগ্রগণ্য বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ চীনের সাথে যে কোনো সংঘর্ষে একেবারে ইরান ও চীনের মাঝে থাকা আফগানিস্তানের মার্কিন সেনারা সমূহ হুমকিতে পড়ে যাবে। এটা আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনীর জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘২০ বছর আগের উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট নীতি এখন আর আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে না যুক্তরাষ্ট্র।’ এ দিকে ‘এবিসি’ চ্যানেলকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদের হুমকি অন্য জায়গায় সরে গেছে এবং আমাদের এজেন্ডায় আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চীনের সাথে সম্পর্ক এবং জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে করোনাভাইরাস মোকাবেলা। আর এগুলোতেই আমাদের শক্তি ও সংস্থানের জন্য নজর দিতে হবে’।

আমেরিকার অগ্রাধিকার পরিবর্তন সা¤প্রতিক সময়ে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’, ‘কোয়াড’ ইত্যাদি তৎপরতার মাধ্যমে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। অন্য দিকে পাকিস্তান প্রথম দিকে আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সহযোদ্ধা হয়ে চরম মূল্য দিয়ে এখন হাত গুটিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তান এ যুদ্ধে ৭০ হাজার মানুষ হারিয়েছে, ১৫০ বিলিয়ন ডলার নষ্ট করেছে, নিজের নাগরিকদের বন্দী করে ‘গুয়ান্তানামো বে’ কারগারে পাঠিয়েছে, মার্কিন ড্রোন হামলায় উপজাতীয় এলাকায় রক্তক্ষরণ হয়েছে (জিও নিউজ এবং সামা টিভি, নয়া দিগন্ত : ০২/০৭/২০২১)। কাজেই তালেবানদের সূতিকাগার পাকিস্তান সমর্থন সরিয়ে নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র আরো একা হয়ে পড়ে এ যুদ্ধে। সব মিলে বাইডেনের হাতে দু’টি উপায় ছিল; হয় পশ্চাৎপসরণ অথবা পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তোলা। তিনি পিছু হটাই বেছে নিয়েছেন দূরদর্শী একজন নেতা হিসেবে।

তা ছাড়া যুদ্ধের অন্যতম আকর্ষণ ছিল আফগানিস্তানে মজুদ প্রচুর পরিমাণ খনিজসম্পদ, অপরিশোধিত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু প্রকৃতগতভাবে গেরিলাযুদ্ধের সহায়ক ভূমি হওয়ায় আমেরিকা কোনোভাবেই আকর্ষণীয় সেই প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদে প্রবেশ করতে পারেনি। ফলে ২০ বছরে প্রাপ্তি ছিল শূন্য। বিপরীতে জানমালের বিনিয়োগ ছিল আকাশচুম্বী। কাজেই আর সময়, সম্পদ ও জনবল ক্ষয় না করে বরং পিছুহটে নিজ দেশে ফিরে যাওয়াই মার্কিন নেতারা বুদ্ধিমানের কাজ হিসেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তালেবানদের দক্ষতা : মার্কিন বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, আফগান সরকারি বাহিনীর নির্যাতন এবং গনি সরকারের ব্যাপক দুর্নীতির বিপরীতে তালেবান নেতৃত্বে বিনাখরচে জনগণের মামলা-মোকদ্দমার দ্রুত ফয়সালা করা, চুরি-ডাকাতিসহ বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ দমন ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া সাধারণ আফগানদের মাঝে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

সেই সাথে তালেবান গ্রামভিত্তিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পুলিশ-চৌকিদারদের যথাযথ মাসোহারার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, দক্ষ গোয়েন্দা পরিচালনা, অর্থের বিনিময়ে সরকারি গোয়েন্দা ও দোভাষীদের ব্যবহার করে সফলভাবে মার্কিনিদের সরবরাহ লাইন বন্ধ করা এবং সরকারি বাহিনীর ওপর ছোট ছোট সফল আক্রমণের মাধ্যমে বিদেশী ও সরকারি কর্তৃপক্ষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছিল। তা ছাড়া দীর্ঘ দিন পরাশক্তিগুলোর সাথে যুদ্ধ করে সামরিক কৌশলের পাশাপাশি কূটনীতি সম্পর্কেও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও পরিপক্বতা অর্জন করেছে। ২০১৮ সালে কাতারের দোহায় অফিস খুলে যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছে। আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনেও টেবিলে বসেছে। চীন, রাশিয়া, ভারত ও তুরস্কের সাথেও কূটনৈতিক আলোচনায় অংশ নিয়েছে। এই কূটনৈতিক তৎপরতাকে আফগান সরকার ও সরকারি বাহিনীর ওপর মনস্তাত্তিক চাপ হিসেবে ব্যবহার করেছে তালেবান। এতে আফগানরা বুঝতে পারছিল তালেবান শাসন সমাগত। সত্যিকারার্থেই দক্ষতার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা কূটনৈতিক সংস্কৃতিকে মোকাবেলা করেছে তালেবান।

আফগানিস্তানের ভূমি ‘আলকায়েদা’ বা ‘আইএস’ ইত্যাদি কোনো ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে না দেয়ার অঙ্গীকারে সম্মত হয়ে চুক্তি সম্পন্ন করেছে। একই সাথে আফগান সরকারি বাহিনীর ওপর হামলাও অব্যাহত রেখে যুক্তরাষ্ট্রসহ সব বিদেশী বাহিনীর ওপর তীব্র চাপ অব্যাহত রেখেছে। এভাবে তালেবান একই সাথে যুদ্ধ ও শান্তির আলোচনা চালিয়ে বিজয়ের পথ সুগম করে। তালেবান বলত, ‘ওদের (আমেরিকানদের) হাতে ঘড়ি, আর আমাদের হাতে সময়।’ যুদ্ধের ময়দানে রণকৌশলে নিজেদের অদ্বিতীয় প্রমাণ করেছে তালেবান যোদ্ধারা। গেরিলা যুদ্ধের অনুকূলে ভূমি ব্যবহার করে তারা বিদেশী দখলদারদের নাস্তানাবুদ করেছে। স্বল্প খরচে সর্বনিম্ন ক্ষতির বিনিময়ে ছোট ছোট হামলা চালিয়ে আফগানিস্তানে বিদেশী বাহিনীর জন্য হাঙরের মতো মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। ফলে মার্কিন জেনারেলরা জয়ের সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। এভাবে মার্কিনিদের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কে ‘কাউন্টার ইন্সারজেন্সি’তে পরিণত করে দখলদারদের চোরাবালিতে আটকে অর্থ ও জনবল ক্ষয়ের সমুদ্রে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল তালেবান। ‘এএফপি’ জানায় ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ বলেছে, ‘গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিকার গণতান্ত্রিক সরকার গঠন ও মানবাধিকার রক্ষার চেয়েও স্বল্প সময়ের সামরিক প্রাপ্তিকেই প্রাধান্য দিয়েছিল’। ফলে তালেবান দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দ্বিগুণ মনোবল ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

কৌশলগত ভুল : আফগানিস্তানে আগ্রাসনের পর থেকেই বেশ কিছু কৌশলগত ভুল করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন শীর্ষপর্যায়ের এক আলোচনায় এসব কৌশলগত ভুল ওঠে আসে। আমেরিকানদের প্রথম ভুলটি ছিল ২০০১ সালে তোরাবোরা অভিযানে ওসামা বিন লাদেনকে আটকানোর সুযোগ হারানো। দ্বিতীয়ত, আফগান যুদ্ধ শেষ না করেই ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণে সৈন্যসংখ্যার একটা বড় অংশ সেখানে সরিয়ে নেয়া। অন্য দিকে, আফগানিস্তানে যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত থাকায় ধীরে ধীরে পাকিস্তানে তালেবান শক্তিশালী হয়ে ওঠার বিষয়টিতে মনোযোগ না দেয়া। আবার কয়েক বছর আগে হঠাৎ করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন উপদেষ্টাদের প্রত্যাহারে সেখানে মার্কিনিদের সার্বিক অবস্থান খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান ফ্রাঙ্ক ম্যাকেঞ্জির মতে, আফগানিস্তানে আড়াই হাজার মার্কিন সেনা রেখে দেয়ার সুপারিশটিও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গ্রহণ করতে রাজি হননি। সবচেয়ে মারাত্মক ভুল ছিল সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ও তালেবানের মধ্যে দোহায় সম্পাদিত চুক্তি। ম্যাকেঞ্জি বলেন, ‘আফগান সরকার ও মার্কিন সেনাবাহিনীর ওপর দোহা চুক্তির ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছিল’। তার মতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সেনা কমানোর ঘোষণা ছিল কফিনে ঠোকা শেষ পেরেকের মতো।

প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ ‘৯/১১’ সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে নিজের ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ, অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা সামাল দেয়া, প্রতিশোধস্পৃহা, ভ‚রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করা, বিশাল সামরিক বাহিনীকে ব্যস্ত রাখা, আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং অস্ত্র ব্যবসায়ী ও অন্য বড় বড় কোম্পানিকে ঠিকাদারির কাজ দিতে একটি যুদ্ধ অসংশ্লিষ্ট দেশে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আক্রমণ চালিয়ে ছিলেন। পরবর্তী চারজন প্রেসিডেন্ট ২০ বছর এ যুদ্ধ চালিয়ে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। দেশী-বিদেশী সৈনিকসহ দেড় লাখের বেশি মানুষের জীবন সংহার করেছেন। অবশেষে অপমানজনক পরাজয়কে বরণ করে ৩১ আগস্ট ২০২১ যুক্তরাষ্ট্র শেষ সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের কারণ, উদ্দেশ্য, দীর্ঘ দিন যুদ্ধ পরিচালনার যৌক্তিকতা এবং চূড়ান্ত প্রাপ্তি ইত্যাদি গবেষণার বিষয় হলেও আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়, এ যুদ্ধে শুধুই মানবতা, মানবাধিকার আর ন্যায়পরায়ণতা পদদলিত হয়েছে সভ্যতার দাবিদার পশ্চিমা শক্তিগুলোর দ্বারা।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত