আক্রান্ত দুই সঙ্গী ফেলে অস্ত্র নিয়ে বনে পালাল তিন পুলিশ
সাভারে পুলিশ হত্যা
নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়ক ধরে
রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই দূরপাল্লার গাড়ি
চলাচল করে। চার দিকে অনেক
গার্মেন্ট কারখানা থাকায় সড়কের
আশে পাশের এলাকাতেও সবসময়
শ্রমজীবী মানুষের ভিড় থাকে। গতকাল
বুধবার সকালে মহাসড়কের আশুলিয়ার
বাড়ইপাড়া এলাকার যখন পুলিশ
সদস্যদের ওপর হামলা হয় তখনো
চারদিকে অনেক লোকজন ছিল। কিন্তু
সশস্ত্র পাঁচ পুলিশ সদস্য মিলেও দুই
দুর্বৃত্তকে কাবু করতে পারেননি। উল্টো
দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে
এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আরেকজন
গুরুতর আহত হয়েছেন। আর নিজেদের
জীবন বাঁচাতে দুই সঙ্গীকে ফেলে অন্য
তিনজন অস্ত্র নিয়েই ঘটনাস্থলের
পেছনে গজারি বনে পালিয়ে যান।
অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও পুলিশের এমন
অসহায় আত্মসমর্পণ নিয়ে গতকাল দিনভর
সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক
আলোচনা চলে। সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও এ সংক্রান্ত
আলোচনায় সরব ছিল। তারা বলছে,
জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা
পুলিশের। কিন্তু পুলিশ যখন নিজের
জীবনই বাঁচাতে পারছে না তখন
সাধারণ মানুষ তাদের ওপর আস্থা
রাখবে কিভাবে? এটাই তো প্রথম
কোনো ঘটনা না। এর আগেও একাধিক
ঘটনায় পুলিশকে দুর্বৃত্তদের হাতে
নাজোহাল হতে দেখা গেছে। গতকাল
যারা হামলার শিকার হয়ছে, তারা
সবাই বয়েসে তরুণ। একটি প্রশিক্ষিত
পেশাদার বাহিনীর সদস্যরা কেন
এভাবে অসহায় আত্মসমর্পণ করবেন?
দুর্বলতা কোথায়- তা খুঁজে বের করাটা
এখন সময়ের দাবি।
রাজনৈতিক দলের নেতারাও পুলিশের
সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম
সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম
হানিফ বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর সামর্থ্যে
ঘাটতির জন্য লেখক-ব্লগারদের খুনীদের
গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না।
গতকালের ঘটনা পুলিশের উর্ধ্বতন
কর্মকর্তরাদেরও ভাবিয়ে তুলেছে।
বিশেষ করে ১৩ দিনের ব্যবধানে একই
রকম হামলার ঘটনায় আরেকজন পুলিশ
সদস্যের মৃত্যু এবং আহত সঙ্গীদের ফেলে
রেখে অস্ত্র নিয়ে তিন পুলিশ সদস্যের
পালিয়ে যাওয়ায় ঘটনায় তারাও
বিস্মিত।
পুলিশ সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়,
নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কে
আশুলিয়ার বাড়ইপাড়া এলাকার একটি
চেকপোস্টের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য
সকাল ৭টার দিকে হাজির হয়েছিলেন
শিল্প পুলিশের পাঁচ কনস্টেবল। রাতে
যাঁরা চেকপোস্টের দায়িত্বে
ছিলেন সকালে তাঁরা চলে যান।
নিয়ম অনুযায়ী, আশুলিয়া থানার একজন
এসআইয়ের অধীনে সেখানে পাঁচ
কনস্টেবলের দায়িত্ব পালনের কথা।
কিন্তু তখনো এসআই আসেননি দেখে
পাঁচ কনস্টেবল পাশের একটি
রেস্টুরেন্টে অপক্ষো করছিলেন। সবার
সঙ্গেই ছিল একটি করে চায়নিজ
রাইফেল। সকাল পৌনে ৮টার দিকে
আচমকা সেখানে ঢুকে ধারালো অস্ত্র
নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালায় দুই
যুবক। কিন্তু কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র
থাকা সত্ত্বেও পুলিশ সদস্যরা কোনো
প্রতিরোধ গড়তে পারেননি।
হামলাকারীরা এলোপাতাড়ি
কোপানো শুরু করলে দুই পুলিশ সদস্য গুরুতর
আহত হন। গুরুতর আহতদের মধ্যে পরে মুকুল
হোসেন (২৩) নামের এক পুলিশ সদস্য
মারা যান। আহত অবস্থায় নূরে আলম
সিদ্দিক (২৩) নামের কনস্টেবলকে
হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর
পালিয়ে যাওয়া তিনজন হলেন-
পিনহারুজ্জামান, আপেল মাহমুদ ও
ইমরান আজিজ। তাদের বয়স ২০ থেকে ২৪
বছরের মধ্যে।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে,
হামলাকারীদের কাছে পিস্তল ও
চাপাতি ছিল। ঘটনার সময় পাঁচ পুলিশ
সদস্যের কাছে ছিল পাঁচটি চায়নিজ
রাইফেল। কিন্তু হামলাকারীদের
একজন যখন কনস্টেবল মুকুল ও নূরে আলমকে
চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে,
তখন অন্য পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলের
পেছনের গজারি বন দিয়ে পালিয়ে
যান।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী নাম না প্রকাশের
শর্তে জানায়, তিন পুলিশ সদস্য কাঁধে
অস্ত্র নিয়ে দৌড়ে পালাতে থাকেন।
তখন দুই যুবকের একজন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে
তাঁদের ধাওয়া করে। তিনজনের কাছে
অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁরা বিন্দুমাত্র
প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা
করেননি, বিষয়টি খুবই লজ্জার। পুলিশ
যদি নিজের জীবনকেই রক্ষা করতে না
পারে তবে জনগণের জীবন রক্ষা করবে
কিভাবে? ঘটনার পর আশপাশের
সাধারণ মানুষই ঝুঁকি নিয়ে আহতদের
উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
পুলিশ সূত্র জানায়, হামলা পরবর্তী
পরিস্থিতি নিয়ে যখন সংশ্লিষ্টরা
ব্যস্ত ছিল, সে সময় পরিস্থিতি বুঝে
পালিয়ে যাওয়া তিন পুলিশ সদস্য
আশুলিয়া থানায় ফিরে যান। ঘটনার
বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের
জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তবে
তাৎক্ষণিকভাবে কোনো শাস্তিমূলক
ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে তদন্ত
চলছে। তদন্ত শেষে দায়িত্বে
অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, পালিয়ে যাওয়া পুলিশ
সদস্যরা ফিরে এসে ঊর্ধ্বতনদের কাছে
দাবি করেছেন, দুই যুবক হামলা করলেও
তাদের আশপাশে আরো অন্তত সাত-
আটজন সদস্য ছিল। গতকাল সাভারের
এনাম মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতালে হতাহত দুই পুলিশ সদস্যকে
দেখতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খান কামালও
সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার সময়
কমপক্ষে সাত-আটজন দুর্বৃত্ত পুলিশের ওপর
হামলা চালায়। গত কয়েক মাসে
ব্লগার-প্রকাশকদের ওপর যেভাবে
হামলা হয়েছে, পুলিশের ওপর এই
হামলা হয়েছে একই কায়দায়।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘চেকপোস্টে
পুলিশ সদস্যদের পালাবদলের সময় এ ঘটনা
ঘটেছে। পুলিশের নতুন দল গাড়ি থেকে
নামার সময় হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।
তাদের উপর্যুপরি হামলায় কনস্টেবল মুকুল
মারা যান। মানবতাবিরোধী
অপরাধের বিচার কার্যক্রম নস্যাৎ করার
জন্য এ ধরনের হামলা চালানো হচ্ছে।
হামলাকারীরা কখনো হরকাতুল
জিহাদ, কখনো আনসারুল্লাহ। তারা
আলাদা নাম ব্যবহার করলেও আসলে এক।’
অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও পুলিশ সদস্যরা
হামলাকারীদের গুলি করল না কেন-
এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
বলেন, ‘এ ব্যাপারে পুলিশের আইজি
বলবেন। পরবর্তী নির্দেশ দেবেন।’
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে র্যাবের
মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ
সাংবাদিকদের জানান, পুলিশ
জনগণের নিরাপত্তার জন্য ডিউটি করে।
হামলাকারীরা প্রশিক্ষিত ও সশস্ত্র
ছিল। শিগগিরই দেখবেন এই
হামলাকারীরা রাস্তায় গুলিবিদ্ধ
অবস্থায় পড়ে থাকবে। এর পরও
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা
নিরপরাধ লোকজনের ওপর হামলা
চালালে তাদের নিশ্চিহ্ন করা হবে।
অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কেন খুন
হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি
সাংবাদিকদের জানান, প্রকৃতপক্ষে
কী ঘটেছিল তা তদন্ত করবে ঢাকা
জেলা পুলিশ। ঘটনায় অস্ত্র থাকা
সত্ত্বেও পুলিশ কেন গুলি করেনি, কেনই
বা তিন সদস্য পালিয়ে যান তারও তদন্ত
করবে ঢাকা জেলা পুলিশ।
আশুলিয়া থানার ওসি মহসিনুল কাদির
বলেন, ঘটনাস্থলে নিরাপত্তার
দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের
কাছে চায়নিজ রাইফেল, বুলেটপ্রুফ
জ্যাকেটসহ নিজেদের নিরাপত্তার
জন্য সব ধরনের সরঞ্জাম ছিল। এর পরও
তাঁরা কেন নিজেদের রক্ষা করতে
পারেননি সেটা তদন্তের মাধ্যমে
জানা যাবে।
এর আগে গত ২২ অক্টোবর রাজধানীর
গাবতলীতে চেকপোস্টে এএসআই
ইব্রাহিম হোসেন মোল্লাকেও
ছুরকাঘাত করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
ঘটনার সময় সেখানে অস্ত্রধারী ৯
পুলিশ সদস্য দায়িত্বে ছিলেন। দুর্বৃত্তরা
সংখ্যায় ছিল মাত্র দুজন। তবে অস্ত্র
থাকা সত্ত্বেও ওই পুলিশ সদস্যরা
দুর্বৃত্তদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি।
শেয়ার করুন