মাত্র ৩ ঘণ্টা পর আশ্বাস দিয়ে তেজগাঁও ছাড়লেন আনিসুল
অবৈধ ট্রাকস্ট্যাণ্ড উচ্ছেদে অভিযানে
গিয়ে বিক্ষোভ-সংঘর্ষের মধ্যে প্রায় তিন
ঘণ্টা কার্যত অবরুদ্ধ থাকার পর বিপুল সংখ্যক
পুলিশ ও র্যাবের পাহারায় তেজগাঁও এলাকা
ত্যাগ করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি
করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক।
চলে যাওয়ার আগে হাজারখানেক ট্রাক
শ্রমিকের সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশের হ্যান্ড
মাইকে তিনি ‘আরও ভালো মানের’
টার্মিনাল নির্মাণের আশ্বাস দেন এবং ওই
সড়কে এলোপাতাড়ি ফেলে রাখা ট্রাক ও
অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে অনুরোধ করেন।
মেয়র বলেন, “আপনারা আমাকে ভোট দিয়ে
মেয়র বানিয়েছেন। আমি আপনাদের ছেলে।
আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন। আমরা
আপনাদের জন্য ভালো টার্মিনাল নির্মাণ
করব।”
গত মে মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই ছিল
মেয়র আনিসুলের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের
প্রথম বড় চেষ্টা। এই অভিযানে গিয়ে
শ্রমিকদের বিক্ষোভের মধ্যে তাকে
রোববার বেলা দেড়টা থেকে বিকাল ৪টা ৪০
মিনিট পর্যন্ত বাংলাদেশ ট্রাক ও কভার্ড
ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের অফিসে আটকে
থাকতে হয়।
পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় আহত
হয়েছেন অন্তত তিনজন শ্রমিক। এরা হলেন
জসিম উদ্দিন, বদরুদ্দোজা ও মো. মাসুম।
এরা তিনজনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে
হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক
মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন।
শ্রমিকদের হামলায় আলোকচিত্র
সাংবাদিক তানভীর আহমেদসহ বেশ
কয়েকজন সাংবাদিক আহত হন।
শ্রমিকদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর
অভিযোগ উঠলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার
বিপ্লব কুমার সরকার।
তিনি বলেন, “তিন রাউন্ড ফাঁকা গুলি করা হয়েছিল।
ইটের আঘাতে একজন আহত হয়েছিল।”
এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি বলেও
জানান বিপ্লব সরকার।
তিনি বলেন, “উচ্ছেদ যতটুকু হয়েছে ততটুকুই
থাকবে। মেয়র বলেছেন, নতুন কিছু করলে
শ্রমিক মালিকদের সাথে আলোচনা করেই
করবেন।”
তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকা থেকে
কারওয়ান বাজার রেল ক্রসিং পর্যন্ত
টার্মিনালের বাইরে অবৈধভাবে ফেলে
রাখা পুরনো ট্রাক ও বিভিন্ন স্থাপনা
সরাতে বেশ কিছুদিন ধরেই সতর্ক করে
আসছিলেন উত্তরের মেয়র আনিসুল। গত ৮
নভেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত পাঠিয়ে
অভিযান চালানোর পর অবশিষ্ট স্থাপনা
সরাতে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেন তিনি।
রোববার দুপুর ১টার দিকে রেলমন্ত্রী মুজিবুল
হককে সঙ্গে নিয়ে সাত রাস্তা এলাকায়
অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের অভিযানে যান
মেয়র আনিসুল হক। উচ্ছেদের কাজে ব্যবহৃত
সিটি করপোরেশনের ভারী যানগুলো এসময়
র্যাব, পুলিশবেষ্টিত হয়ে অবৈধ স্থাপনা
গুঁড়িয়ে দিতে থাকে।
বেলা পৌনে ২টার দিকে ট্রাকস্ট্যান্ডের
পেছনের দিকে কয়েকটি অবৈধ স্থাপনা
ভেঙে সামনের দিকে আসার সময়
ট্রাকস্ট্যান্ডের মুখে একটি ‘অবৈধ
বুলডোজার’ গুঁড়িয়ে দেওয়া শুরু করে সিটি
কর্পোরেশনের বুলডোজার।
এ সময় মেয়র আনিসুল বলছিলেন, “এটা পাঁচ
হাজার টাকায় বিক্রি করব, কে কিনবে?
এখানে ম্যাজিস্ট্রেট আছেন, তিনি চাইলে
বিক্রি করে দিতে পারেন। এসব জঞ্জাল
রেখে লাভ নেই।”
পাশেই একটি ট্রাক অবস্থান করছিল। মেয়র
ট্রাকটি সেখানে থাকার কারণ জানতে চান।
চালক কোনো উত্তর না দিলে মেয়র সেই
ট্রাকের উপরও বুলডোজার চালাতে বলেন।
এ সময় রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক মেয়রের পাশেই
ছিলেন। মেয়র রেলমন্ত্রীকে বলেন, “আমি
তো অনেকগুলো সরালাম, এবার আপনি
সরান।”
ট্রাকে বুলডোজার আঘাত করার পরপরই
শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে হৈ চৈ শুরু করেন।
এক পর্যায়ে কয়েকজন সিটি কর্পোরেশনের
বুলডোজার এবং উচ্ছেদ অভিযানে অংশ
নেওয়া অন্যান্য যন্ত্রে ইট ছুড়তে শুরু করেন।
এসময় হামলা থেকে বাঁচতে বুলডোজার এবং
উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নেওয়া অন্যান্য
যন্ত্রের চালকরা দ্রুত ঘটনাস্থল ছাড়তে
থাকেন।
পুলিশ পরিস্থিতি সামলাতে কয়েক রাউন্ড
গুলি ছুড়লে শ্রমিক জসিম উদ্দিন (৪০) আহত
হন।
তখন নিরাপত্তার জন্য রেলমন্ত্রী এবং মেয়র
আনিসুলকে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড
ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের কার্যালয়ে
সরিয়ে নেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর রেলমন্ত্রী
চলে গেলেও মেয়র সেখানেই বসে থাকেন।
এ সময় শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে মেয়র
‘অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন’ বলে টেলিভিশনগুলো
খবর দেখাতে থাকে।
এ সময় জসিমের মারা যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে
পড়লে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিক্ষোভ শুরু
করেন এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর
ছুড়তে থাকেন। শ্রমিকরা পুলিশের একটি
গাড়ি এবং সিটি কর্পোরেশনের একটি
পিকআপ ভ্যান ভাংচুর করেন।
পুলিশ শ্রমিকদের ধাওয়া দিলে তারা
তেজগাঁও সাত রাস্তা মোড়ে অবস্থান নেয়
এবং সেখানে থাকা চ্যানেল আই এর একটি
গাড়ি ভাংচুর করে। সাত রাস্তা সড়কটিও
অবরোধ করে শ্রমিকরা।
বিকাল পৌনে ৫টা পর্যন্ত শ্রমিকরা
ট্রাকস্ট্যান্ডের সামনের রাস্তার দুই পাশে
কয়েকটি ট্রাক আড়াআড়িভাবে ফেলে
রাখে। রাস্তায় টায়ারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে
বিক্ষোভ করতে থাকে।
শ্রমিকরা আনিসুলের বিরুদ্ধে স্লোগান
দিচ্ছিল এবং বলছিল- ‘মেয়র আনিসুলকে বের
হতে দেব না’।
এক ঘণ্টা পর বেলা ২টা ৪০ মিনিটের দিকে
কয়েকটি টিভি ক্যামেরাসহ সাংবাদিকরা
ড্রাইভার্স ইউনিয়নের কার্যালয়ে গেলে
গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন মেয়র।
তিনি বলেন, “কয়েকজন মানুষের স্লোগানে
ভয় পেয়ে যাব; এমনটি ভাবার কিছু নেই।
নগরবাসী যাতে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে
পারে সেই কাজ করছি। কেউ উত্তেজিত
করলেন আর আমি আমার লোক নিয়ে দৌড়ে
চলে গেলাম; না এটা হবে না।”
তিনি বলেন, “কয়েকজন মানুষের স্লোগানে
ভয় পেয়ে যাব- এমন ভাবার কিছু নেই।
নগরবাসী যাতে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে
পারে সেই কাজ করছি। কেউ উত্তেজিত
করলেন আর আমি আমার লোক নিয়ে দৌঁড়ে
চলে গেলাম; না এটা হবে না।”
আসলে কী ঘটেছে জানতে চাইলে মেয়র
বলেন, “সমস্যা কিছুই হয়নি। কেউ একজন
ইটাইটি করেছে।…পুলিশ কাউকে ইট
ছোড়েনি। যেটা হচ্ছে এটা অনভিপ্রেত।”
আনিসুল বলেন, ট্রাক মালিক, কাউন্সিলরসহ
‘সবাই’ তার সঙ্গে আছেন। নির্দেশনা মেনে
অনেকেই ট্রাক সরিয়ে নিয়েছেন। যারা
সরায়নি তাদের বিরুদ্ধেই এ অভিযান।
“আইন আইনের মতো চলবে ভাই। আপনি কী
এমন হয়ে গেলেন যে সবাই সরিয়ে নেওয়ার
পরও আপনি আপনার ভাঙা ট্রাক সরাবেন
না?”
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পর শ্রমিক
ইউনিয়নের কার্যালয়েই বসে থাকেন মেয়র।
বাইরে শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলার মাঝেই
পাশের একটি মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা
আসে- “মেয়র শ্রমিকদের দাবি মেনে
নিয়েছেন।”
মাইকের ঘোষণায় বলা হয়, পুলিশের গুলিতে
আহত শ্রমিকের চিকিৎসার ভার নেবেন
মেয়র। পাশাপাশি বিকল্প ট্রাকস্ট্যান্ড না
হওয়ার আগে বর্তমান স্ট্যান্ড থেকে ট্রাক
সরাতে চাপও দেওয়া হবে না।
এই ঘোষণার পর শ্রমিকরা অনেকটা শান্ত
হয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর চালক সমিতির
কার্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে হ্যান্ডমাইকে
শ্রমিকদের উদ্দেশে কথা বলতে শুরু করেন
মেয়র।
তিনি বলেন, নিজের জন্য তিনি এই
ট্রাকস্ট্যান্ড সরানোর কাজ করছেন না।
অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে জনগণের
চলাফেরা নির্বিঘ্ন করতে। এ বিষয়ে তিনি
ভোটার ও সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের
কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
মেয়রের বক্তব্য চলাকালে শ্রমিকদের মধ্যে
আবারও উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
আনিসুল বার বার বলেন- ‘আমার কথা শুনুন,
আমার কথা শুনতে হবে’।
“এই এলাকায় আজ যে সমস্যা সেটা ছোট্ট
একটা সমস্যা। রাস্তায় ট্রাক পার্কিং না
করে ভেতরে টার্মিনাল বানাব আমরা।
চারজন মন্ত্রী আমার এই উদ্যোগের সঙ্গে
ছিলেন। রাস্তাটা ভালোভাবে ব্যবহার করা
যাচ্ছিল না। দুইমাস ধরে আমি এটা নিয়ে
কথা বলছি। মলিকপক্ষ আমাকে বলেছে
টার্মিনালের ভেতরের অংশটা যাতে তাদের
পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। সেজন্যই ভেতরের
নষ্ট অকেজো ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন
সরানো হচ্ছে।
“যারা এই জায়গা অবৈধভাবে দখল করে
আছেন, আপনাদের সবার সুবিধার জন্য
টার্মিনালের ভেতরে বছরের পর বছর ধরে
পড়ে থাকা গাড়িগুলো সরানো হচ্ছে, আমার
সুবিধার জন্য নয়।”
বক্তব্য শেষ করার আগে মেয়র বলেন, “তাহলে
আমরা ঠিক করলাম এই জায়গায় যেসব গাড়ি
আছে এগুলো ভেতরে থাকবে। আপনাদের
আমরা একটা ভালো ট্রাক স্ট্যান্ড উপহার
দেব।”
প্রায় পাঁচ মিনিট বক্তব্য দিয়ে বেলা পৌনে
৫টার দিকে র্যাব ও পুলিশ বেষ্টিত হয়ে
গাড়িতে উঠে ফার্মগেইটের দিকে চলে যান
মেয়র। পরে রাস্তা আটকে থাকা
শ্রমিকদেরও পুলিশ সরিয়ে দেয়।
সাংবাদিকদের উপরে হামলা
শ্রমিকরা ঘটনাস্থলে সংবাদ সংগ্রহে
যাওয়া কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর উপর হামলা
চালায়।
বিক্ষোভের ছবি তুলতে গেলে আলোকচিত্র
সাংবাদিক তানভীর আহমেদের উপরে হামলা
করেন শ্রমিকরা।
এতে তানভীরের মাথা ফেটে যায়। তার
মাথায় চারটি সেলাই লেগেছে।
শ্রমিকরা তানভীরের ক্যামেরা কেড়ে নেয়
এবং ভাংচুর করে।
এছাড়াও কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশনের
সাংবাদিক ও ক্যামেরাপার্সনের উপর
হামলা চালায় শ্রমিকরা।
সরাসরি সম্প্রচারের সময় যমুনা টেলিভিশনের
সাংবাদিক কামরুল হাসান এবং
ক্যামেরাপার্সন রুহুল আমিনের উপর হামলা
হয়।
এ সময় বিক্ষোভকারীদের বলতে শোনা যায়,
‘জসিম মারা গেছে’ এটা খবরে কেন বলা
হচ্ছে না।
“তোরা মেয়রের দালালি করতে এসেছিস। সব
সাংবাদিককে মেরে বের করে দিব,” বলা হয়
শ্রমিকদের মধ্য থেকে।
একই পরিস্থিতিতে পড়েন দীপ্ত
টেলিভিশনের একজন সাংবাদিক। কয়েকজন
সাংবাদিককে ঘাড় ধরে বের করে দিতেও
দেখা যায়।
শেয়ার করুন