দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন সরকারের সিংহভাগ এমপি মন্ত্রী
গণঅভ্যূত্থানে ছাত্র জনতার চাপের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগের পর একে একে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সরকারের সিংহভাগ এমপি মন্ত্রী। ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর গত ১৪ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত ২৭ দিনে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ৯০ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও রাজনৈতিক নেতা। এছাড়া বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছে অন্তত ১০ জন মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালীদের।শাহজালাল বিমানবন্দরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশত্যাগ করা এমপি-মন্ত্রীরা ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, চীন ও দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। অনেকেই নিজে যেতে না পারলেও নিরাপদে পাঠিয়ে দিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের। এছাড়াও দেশত্যাগের উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরে এসেও পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ফিরে গেছেন কমপক্ষে ২৫ জন মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতা ও দুর্নীতিগ্রস্থ সরকারি কর্মকর্তা। পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সোমবার দুপুরে। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও এদিন রাতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে। সে রাতে দেশ ত্যাগ করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। রাত ২টা ৩৫ মিনিটে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সে (এমএইচ-১৯৭) মালয়েশিয়া পালিয়ে যান সাবেক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। এছাড়াও সোমবার ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ। তার আগের দিন রোববার রাতে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। একইদিন সকালে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন শেখ হাসিনার আত্মীয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে বলে জানা গেছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও। এদিকে প্রধানমন্ত্রী ৫ আগস্ট দেশত্যাগ করলেও এমপি মন্ত্রীদের দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে আরও আগে থেকে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৪ জুলাই টার্কিশ এয়ারলাইন্সে দেশ ছাড়েন নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ নজরুল ইসলাম বাবু। একইদিন বেলা ২টায় থাই এয়ারওয়েজের টিজি-৩২২ ফ্লাইটে ব্যাংকক যান কুষ্টিয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. কামরুল আরেফিন। একই বিমানে ব্যাংকক যান সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মানিকগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য দেওয়ান জাহিদ আহমেদ মালেক। পর দিন ১৫ জুলাই সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ-৪৪৭ ফ্লাইটে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। একই ফ্লাইটে পালিয়ে যান দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক, টাঙ্গাইল-৫ আসনের সংসদ সদস্য মো. সানোয়ার হোসাইন ও নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল। সেদিন সকালে বিমান বাংলাদেশের বিজি-৩৯১ ফ্লাইটে কলকাতা পাড়ি জমান ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য মশিউর রহমান মোল্লা সজল। ১৬ জুলাই দুপুরে এমিরেটাস এয়ারলাইন্সে (ইকে-৫৮৩) দুবাই চলে যান সাবেক রেলমন্ত্রী ও কুমিল্লা-১১ আসনের এমপি মুজিবুল হক। একইদিন বাংলাদেশ বিমান বিজি-৩০৮ ফ্লাইটে ম্যানচেস্টারের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা, বিজি-৩১৫ ফ্লাইটে মালয়েশিয়া যান সাবেক গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী, নোয়াখালী-২ আসনের এমপি মোরশেদ আলম। ১৭ জুলাই রাত আড়াইটায় ক্যাথে প্যাসেফিক এয়ারলাইন্সে (সিএক্স-৬৬২) হংকংয়ের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য ফায়জুর রহমান। একই রাতে ১১টা ৫০ মিনিটে চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সে (সিজেড-৩৯১) চীনের গুয়াংজুর উদ্দেশে দেশ ছাড়েন কুমিল্লা-৮ আসনের আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন। রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে (এসকিউ-৪৪৭) সিঙ্গাপুর পালান ময়মনসিংহ-৮ আসনের মাহমুদুল হাসান সুমন। ১৮ জুলাই সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৫৮৪ ফ্লাইটে সিঙ্গাপুরে যান সাতক্ষীরা-৩ আসনের এমপি ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী এএফএম রুহুল হক। ২০ জুলাই বেলা ১২টা ৫৫ মিনিটে শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সে (ইএল-১৯০) দেশ ছাড়েন বিসিবির প্রেসিডেন্ট, ক্রীড়ামন্ত্রী ও কিশোরগঞ্জ-৬ আসনের এমপি নাজমুল হাসান পাপন গত। ২১ জুলাই রাত ১১টা ৪০ মিনিটে দেশ ছাড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের এমপি সৈয়দ একেএম একরামুজ্জামন, ২২ জুলাই বিজি ৫৮৪ যোগে সিঙ্গাপুর যান নোয়াখালী-২ আসনের এমপি মোরশেদ আলম, ২৫ জুলাই বেলা ১২টা ১০ মিনিটে ব্যাংককের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন কুমিল্লা-৫ আসনের এমপি এ এম তাহের। ওইদিন দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে ব্যাংককে যান ময়মনসিংহ-৭ আসনের এবিএম আনিসুজ্জামান। বিকাল ৬টা ১০ মিনিটে এমিরেটাস এয়ারলাইন্সে করে কানাডার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন সংরক্ষিত নারী আসনের নীলুফার আনজুম। সন্ধ্যা ৭টা ৪৮ মিনিটে এমিরেটাস এয়ারলাইন্সে করে কানাডা পালান অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খান। ২৬ জুলাই ভোর ৫টা ২০ মিনিটে কাতার এয়ারলাইন্সে (কিউআর-৬৪৩) গ্রিসে পালান কুমিল্লা-৪ আসনের আবুল কালাম আজাদ। ২৭ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এমিরেটাস এয়ারলাইন্সে ইকে-৫৮৭ ফ্লাইটে দুবাইয়ের উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। ২৮ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায় ইউএস-বাংলার বিএস-৩০৭ ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর যান কুমিল্লা-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর আলম। ২৯ জুলাই বেলা ১১টা ১০ মিনিটে এমিরেটাসে (ইকে-৫৮৩) তেহরান যান সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। ওইদিন বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে নভোএয়ারে কলকাতা যান যশোর-৩ আসনের কাজী নাবিল আহমেদ। একইদিন বিকাল ৫টা ৫০ মিনিটে বিমানের বিজি-৩৩৭ ফ্লাইটে মদিনা যান বরগুনা-৫ আসনের মো. মজিবুর রহমান মজনু। ৩০ জুলাই ২টা ৪০ মিনিটে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সে (এমএইচ-১৯৭) ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন পটুয়াখালী-৩ আসনের এসএম শাহাজাদা। ৩১ জুলাই বেলা ২টায় এমিরেটাস এয়ারলাইন্সে (ইকে-৫৮৫) নিউইয়র্ক যান ঢাকা-১৮ আসনের খসরু চৌধুরী। একই দিন দুপুর ১টা ১৬ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৩৯৭ ফ্লাইটে দিল্লি পালান শরীয়তপুর-৩ আসনের নাহিম রাজ্জাক। সেদিন চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সে (সিএস-৩৯২) চীনের গুয়াংজু যান কুমিল্লা-৮ আসনের আবু জাফর মো. শফিউদ্দিন। ২ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টা ২৩ মিনিটে টার্কিশ এয়ারের টিকে-৭১৩ ফ্লাইটে ইস্তাম্বুল যান ঝিনাইদহ-২ আসনের নাসের শাহরিয়ার জাহিদী। এদিন রাত ১০টা ৫০ মিনিটে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে (বিএস-৩০৭ ফ্লাইটে) সিঙ্গাপুর যান সংরক্ষিত মহিলা আসনের পারুল আক্তার। ৩ আগস্ট দেশ ছাড়েন ঢাকা-৪ আসনের এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। ৪ আগস্ট বেলা ১২টায় বাংলাদেশ বিমানে (বিজি-৩৯৭) ঢাকা ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক সচিব নেত্রকোনা-৪ আসনের সাজ্জাদুল হাসান। এছাড়াও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। এদিকে সরকার পতনের একদিন পর থেকে দেশের সবগুলো বিমানবন্দরে কড়াকড়ি আরোপ করে ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্টগুলোতে হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয়, মহানগর ও জেলা কমিটির নেতাদের নাম উল্লেখ করে তালিকা পাঠানো হয়। দেশত্যাগ নিষেধাজ্ঞার এ তালিকায় হাসিনা সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, জাতীয় সংসদের এমপি, সংসদীয় কমিটিগুলোর সভাপতি এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা দলবাজ কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করা হয়। যার প্রেক্ষিতে সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালানোর সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক হন সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। একইদিন হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে দেশত্যাগের সময় আলোচিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ চৌধুরীকে আটক করা হয়। আটক করা হয় ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত ও ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদকেও। দেশ ছেড়ে পালানোর পাশাপাশি দেশ ত্যাগের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের বেশির ভাগ প্রভাবশালী নেতা এবং এমপি-মন্ত্রীরা। দলের সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরাও গা-ঢাকা দিয়েছেন। এখনো দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-মন্ত্রী। চট্টগ্রাম-৩ সন্দ্বীপ আসনের সাবেক এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা সপরিবারে দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া পালানোর জন্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়েও ছাত্র-জনতার দৌড়ানি খেয়ে ফিরে আসেন। দ্বিতীয় দফা কলকাতা যাওয়া চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। দেশ ছেড়ে পালানোর তালিকা থেকে বাদ যাননি ঢাকার দুই দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলররাও। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর থেকে মেয়র, প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলররা লাপাত্তা। ফলে সিটির সেবা কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। এছাড়া মশক নিধণ কার্যক্রম, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও অন্যান্য নাগরিক সেবা জাতীয় কাজগুলোতেও ছন্দপতন ঘটেছে। দুই সিটির ১৭২ কাউন্সিলরের মধ্যে ১৮ জন বিএনপিপন্থি। ওই ১৮ জন ছাড়া অন্য কোনো কাউন্সিলর অফিস করছেন না। ঢাকার দুই মেয়র ছাড়াও সারাদেশের প্রায় সবকটি সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরাও দেশত্যাগ ও আত্মরক্ষার্থে আত্মগোপনে রয়েছেন। যার ফলে স্থানীয় সরকারের দৈনন্দিন কাজগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন