জার্মানিতে মুসলিমদের উপর সহিংস আক্রমণ বেড়েছে
২০১৭ সালের প্রথম তিন মাসে জার্মানিতে মুসলিমদের উপর দু'টি সহিংস আক্রমণের ঘটনা ঘটে৷ কিন্তু তার পরের তিন মাসে ঐ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬-তে – এমনটাই জানা গেছে একটি জার্মান পত্রিকার বিবরণে৷
সংসদে বাম গোষ্ঠীর একটি তথাকথিত ‘ছোট প্রশ্নের’ জবাবে ফেডারাল সরকারের তরফ থেকে যে উত্তর দেওয়া হয়, এই পরিসংখ্যান তারই অঙ্গ৷ প্রায় সর্বক্ষেত্রেই অপরাধীরা চরম দক্ষিণপন্থি মহলের সদস্য এবং তাদের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বলে ‘নয়ে অসনাব্র্যুকার সাইটুং’-এর বিবরণে প্রকাশ৷
২০১৭ সালের প্রথম তিন মাসে মোট ২০০ ইসলাম বিদ্বেষ প্রণোদিত ঘটনা ঘটেছিল; তার পরের তিন মাসে মুসলিমদের অথবা তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে উপরাধমূলক গতিবিধির ঘটনা ঘটেছে ১৯২টি – অর্থাৎ প্রথম কোয়ার্টারের তুলনায় মোটামুটি একই পর্যায়ে রয়েছে৷ কর্তৃপক্ষ সদ্য এ বছর থেকে ‘ইসলামবিদ্বেষি অপরাধমূলক কার্যকলাপের’ পরিসংখ্যান রাখতে শুরু করেছেন; সেই কারণে ২০১৬ সালে ইসলামবিদ্বেষি ঘটনার কোনো তুলনামূলক পরিসংখ্যান নেই৷
নিজেকে কি জার্মান মনে করেন?
জার্মানির বিলেফিল্ডে থাকেন মরোক্কান বংশোদ্ভূত আয়া৷ গত মার্চে বার্লিনে অনুষ্ঠিত হলো ‘ইয়ং ইসলাম কনফারেন্স ২০১৭’৷ তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল – নিজেকে কি জার্মান মনে করেন? জবাবে ১৮ বছর বয়সি এই তরুণী বলেন, ‘‘আমি নিজেকে যতটা মরোক্কান মনে করি, তার চেয়ে বেশি জার্মান মনে করি৷ জার্মান সংস্কৃতির মাঝেই বেড়ে উঠেছি আমি৷ এর (জার্মান সংস্কৃতির) সঙ্গে যোগাযোগ আমার অন্য দেশের (মরক্বো) চেয়ে অনেক বেশি৷’’
ইউরোপে কি ইসলামীকরণ চলছে?
২২ বছর বয়সি মার্টিন থাকেন ফ্লেনসবুর্গে৷ ইউরোপে কি ইসলামীকরণ চলছে? – এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘না, ইউরোপে অনেক সংস্কৃতি এসে মিলছে৷আমার মনে হয়, ইউরোপ এ মুহূর্তে বেদনাদায়ক কিছু শিক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ ব্রেক্সিট এর একটা উদাহরণ৷ কিন্তু তথ্য এবং পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ইউরোপে মোটেই ইসলামীকরণ চলছে না৷ এটা পুরোপুরি বাজে কথা৷’’
আপনার কাছে সংহতির মানে কী?
ফলকান বললেন, ‘‘আমার কাছে এর মূল কথা হলো, কোথাও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকা বা না থাকার অনুভূতি৷ শরণার্থীদের অনেককে এমন অনেক প্রশ্নই শুনতে হয় যা থেকে বোঝা যায় যে, আপনি আসলে এ সমাজের বাইরের কেউ৷ ছোটবেলায় এ বিষয়টি আমার খুবই খারাপ লাগত৷ মনে হতো, কোথায় আছি, কী কাজ করছি– এসব ছাপিয়ে সবসময় আমি যেন শুধুই একজন বহিরাগত ’’
মুসলিম আর অমুসলিমদের সম্পর্কোন্নয়নে কী কী করা যেতে পারে?
‘ইয়ং ইসলাম কনফারেন্স ২০১৭’-এর সংলাপের শিরোনাম ছিল ‘রিপেয়ারিং ডায়ালগ’৷ হানা-র কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘‘মুসলিম আর অমুসলিমদের সম্পর্ক মেরামতের জন্য কী করা দরকার?’’ হানা বললেন, ‘‘বড় সমস্যা হলো, এখানে একজন আরেকজনের বিষয়ে যত কথা বলে, একজন আরেকজনের সঙ্গে ততটা বলে না৷ আরেকজনের কাছে গিয়েই কিন্তু জানতে চাওয়া যায়, ‘‘তুমি কেন হেডস্কার্ফ পরো?’’ আমরা যেন এভাবে জানার আগ্রহ প্রকাশ করতে শিখিইনি৷’’
মুসলমানদের মিডিয়া যেভাবে তুলে ধরে
ডুইসবুর্গের মার্ভ-এর কাছ থেকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘যখন নির্দিষ্ট একটা বিষয়ের দিকেই পুরো গুরুত্ব দিয়ে মুসলিমদের তুলে ধরা হয়, তখন খুব খারাপ লাগে৷ ধরা যাক, আমি হেডস্কার্ফ পরেছি৷ এর মানে তো এই নয় যে, আমি খুব গরিব৷ আমার তো এর বাইরেও অনেক কিছু আছে৷ আমি যে ডুইসব্যুর্গের মানুষ হিসেবে গর্বিত সেটাও তো খুব গুরুত্বপূর্ণ৷’’
মুসলিমবিরোধী ‘হেটস্পিচ’ বা ভুয়া খবর রুখতে কী করণীয়?
কোলনের ২৫ বছর বয়সি তরুণ আহমেদ মনে করেন, ‘‘সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হেটস্পিচ বা ভুয়া খবরের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি দরকার সরাসরি কথা বলা৷ এসব নিয়ে আলোচনা করতে আমি সবসময় প্রস্তুত৷ বিশেষ করে ফেসবুকে যে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করার সাহস থাকা উচিত৷ তুরস্ক নিয়ে বিতর্কে অংশ নেয়ার জন্য আমি সম্প্রতি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রি-অ্যাক্টিভেট করেছি৷’’
শরণার্থীবিরোধী পেগিডা বা এএফডি সম্পর্কে ভাবনা
১৯ বছর বয়সি আয়লিন বললেন, ‘‘এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না৷এসব লোকের সঙ্গে কথা বলার কোনো মানে হয় না৷ কিছু লোক কখনোই মনমানসিকতা বদলাতে চায় না৷ এএফডি মনে করে যে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি ঠিক৷ পেগিডাও তাই মনে করে৷ অথচ তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বড় একটা অংশই কিন্তু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ তবে আমার মনে হয়, এ মুহূর্তে এসবের একটা হুজুগ চলছে, একসময় সবার শুভবু্দ্ধির উদয় হবে৷’’
ইসলাম কি জার্মানির অংশ?
পল বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই৷ জার্মানি এমন এক ভৌগোলিক এলাকা, যেখানে একটিই সমাজের বসবাস এবং একটি সমাজই ক্রিয়াশীল৷ এখানে বসবাসরত প্রত্যেকটি গ্রুপই জার্মানির অংশ৷ জার্মানিতে বাস করলে আমি জার্মানিরই অংশ এবং আমার নিজেকে ‘জার্মান’ বলার অধিকারও আছে৷ সেক্ষেত্রে আমার তো মনে হয় কারো জার্মান ভাষায় কথা বলারও দরকার নেই৷’’
ইন্টারনেটে মুসলিমদের অথবা মুসলিম উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে প্ররোচনা – তথাকথিত ‘হেট স্পিচ’ – হুমকি বা শাসানিমূলক বার্তা, রাজপথে হিজাব পরিহিত মহিলা অথবা মুসলিম পুরুষদের উপর আক্রমণ, এছাড়া মুসলিমদের বাড়ি অথবা সম্পত্তির ক্ষতিসাধন কিংবা দেয়ালে নাৎসি স্লোগান লেখাও এই ‘ইসলামবিদ্বেষি অপরাধমূলক কার্যকলাপের’ মধ্যে পড়ে৷
বামদলের স্বরাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উলা ইয়েল্পকে মন্তব্য করেছেন যে, ‘‘এখনই সতর্কতা শিথিল করা সম্ভব নয়, কেন না ইসলামবিদ্বেষি অপরাধমূলক ঘটনার সংখ্যা বিশেষ কমেনি ও মুসলিমদের উপর আক্রমণ ক্রমেই আরো সহিংস হয়ে উঠছে৷
এলএবাংলাটাইমস/আই/এলআরটি
শেয়ার করুন