শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করে সংবাদ , পত্রিকা অফিসে আগুন
চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তারের পর থেকে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে নতুন বাঁক
ইসকনের নেতা চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তারের পর থেকে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নতুন বাঁক নিতে শুরু করেছে। এই বাঁক আরও বদলে গেছে দুই দেশে একে অপারের জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনা এবং সর্বশেষ ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা। সবচেয়ে কাছের এই প্রতিবেশির আচরণে ক্ষুব্ধ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় ঐক্যমতের ডাক দিয়েছে।
একে ঘিরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত শিক্ষার্থী, বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন। ভারতের এই মনোভাবের বিরুদ্ধে দেশে এক ধরনের জনমত গঠনেরও চেষ্টা চলছে। বুধবার মিরপুর সেনানিবাসে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্সের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করছে। এই পরিস্থিতি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোকাবিলা করতে হবে।
একই দিনে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকে ড. ইউনূস বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশকে ধামাচাপা দিতে চক্রান্ত করছে একটি মহল। তাদের মিথ্যা প্রমাণে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশে কোনো মতপার্থক্য নেই। ৫ আগস্টের আগের ঐক্য বহাল।’ ঐক্য রজায় রাখার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরো বিশ্বকে জানাতে হবে আমরা এক। আমরা যা অর্জন করেছি তা সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়। যারা আমাদের বুকের ওপর চেপে বসেছিল, তাদের তাড়িয়েছি। আমরা নিজেদের মুক্ত করেছি। পুরো বিশ্বের কাছে এটা আমাদের তুলে ধরতে হবে।’
তবে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার শেষ করে জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সব দল একমত বলে উপস্থিত দলগুলোর নেতারা সরকারকে জানিয়েছেন।
বৈঠকে যোগ দেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। এ দলে আরও ছিলেন ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
এছাড়াও বৈঠকে আসেন জামায়াতে ইসলামি, সিপিবি, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাসদ, এলডিপিসহ ১২দলীয় জোট, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাংলাদেশ জাসদ, এনডিএমসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা। এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। আর পরদিন বৃহস্পতিবার বৈঠক করেন বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে।
যুক্তরাজ্যের সতর্কতা
এদিকে বাংলাদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাজ্য। সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকির কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ভ্রমণবিষয়ক পরামর্শে এই সতর্কতা জানিয়েছে ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশন। মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর ভ্রমণ সতর্কতায় বলা হয়েছে, দেশজুড়ে শহর ও নগরে নির্বিচার সন্ত্রাসী হামলা চালানো হতে পারে। জনাকীর্ণ এলাকা, ধর্মীয় স্থাপনা ও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন জায়গায় এই হামলা হতে পারে। কিছু গোষ্ঠী এমন ব্যক্তিদের টার্গেট করেছে, যাদের ইসলাম পরিপন্থী জীবনাচরণ ও মতামত রয়েছে বলে তারা মনে করে।
সতর্কতার পরামর্শ দিয়ে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশন বলেছে, চারপাশ সম্পর্কে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে। পুলিশের স্থাপনাগুলোর আশপাশে সতর্কতা অবলম্বনে বেশি জোর দিতে হবে। জুলাই-আগস্টে সহিংসতার পর পরিস্থিতি এখনো অস্থির রয়েছে উল্লেখ করে বড় ধরনের সমাবেশ এবং পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতির জায়গাগুলো এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছে ঢাকার যুক্তরাজ্য হাইকমিশন।
যুক্তরাজ্য হাইকমিশন আরও বলেছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক মিছিল ও সমাবেশে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষও হতে পারে। এসব ঘটনায় প্রাণহানির আশঙ্কা কথা জানিয়ে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশন জানিয়েছে,সাম্প্রতিক অস্থিরতার একটি প্রভাব পুলিশের কর্মকাণ্ডের ওপর পড়েছে। দেশজুড়ে কিছু থানায় উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব থানার বেশির ভাগ সচল হয়েছে। তবে সব পুলিশ সদস্য কাজে ফেরেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাগত
বাংলাদেশের সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া অব্যাহত পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ কথা বলেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের কথিত ‘নিষ্ক্রিয়তা’র অভিযোগের ব্যাপারটি যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখছে, ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার করা এ প্রশ্নের জবাবে স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে পাঠানো এক ই-মেলে এ কথা জানানো হয়।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর সহিংসতা ও তাদের প্রতি অসহিষ্ণুতার যেকোনো ঘটনার নিন্দা জানাই এবং বাংলাদেশের সব নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া অব্যাহত পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানাই।’
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের যে ঘটনাগুলো ঘটছে সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ব্যাপারে জানতে চাইলে, স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্র ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সংগঠন (করার স্বাধীনতাকে) মৌলিক স্বাধীনতা হিসেবে সমর্থন করে। আমরা নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারসহ আমাদের সকল অংশীদারদের কাছে সেই সমর্থনের কথা জানাই।’
বাংলাদেশে ইসকনকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি ও চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন না পাওয়া প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র বলেন, ‘বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ও সংবিধানে (নাগরিকদের) যে অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তার আলোকে এ ইস্যুগুলো সমাধান করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। আমরা বাংলাদেশসহ সকল দেশকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সংগঠন করার স্বাধীনতা এবং ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য আহ্বান জানাই।’
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা তৈরি হওয়ার আলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্র কী ধরণের পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে প্রশ্ন করা হলে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের সাথেই আমাদের সম্পর্ককে গভীরভাবে মূল্য দেই। তাদের একে অপরের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারটি আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছি।’
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের কাছে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিয়ে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে দুই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যের উদ্বেগ জানানোর বিষয়টি তিনি কীভাবে দেখছেন? এ ব্যাপারে প্যাটেলে বলেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সহিংসতা হচ্ছে। তাঁরা উদ্বেগ জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য তাঁদের সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কূটনৈতিক ও নীতিগত কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেসব দেশের সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আছে, তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান একই রকম–মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট করে বলি।’
বেদান্ত প্যাটেল মনে করেন, যেকোনো ধরনের বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ হতে হবে। যেকোনো ধরনের ধরপাকড়ের ক্ষেত্রে সরকারকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে দেশগুলোর প্রতি জোর দিয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন বেদান্ত প্যাটেল।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন