চিত্রনায়ক শাহীন আলমের ‘মহানুভবতা’ নিয়ে লেখা স্ট্যাটাস ভাইরাল
বেশ কয়েক বছর কিডনি জটিলতায় ভুগে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন ঢাকাই সিনেমার চিত্রনায়ক শাহীন আলম।
রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় গত সোমবার রাত ১০টা ৫ মিনিটে এ চিত্রতারকার মৃত্যু হয়।
ইসলাম ধর্মের অনুশাসন পুরোপুরি পালন করতে শাহীন আলম রূপালি জগতকে বিদায় জানিয়েছিলেন ১২ বছর আগেই।
মৃত্যুর কয়েকমাস আগে একটি ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছিলেন এ চিত্রনায়ক।
এবার জানা গেল, তার মহৎ হৃদয়ের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
শাহীন আলমের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন কাজী মুশফিকুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। তার সেই স্ট্যাটাস রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে।
প্রয়াত এই অভিনেতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে মুশফিকুর রহমান জানান, তিনি ছাত্রজীবনে শাহীন আলমের ছেলের গৃহশিক্ষক ছিলেন। সে সময় টিউশনি করে যা পেতেন তা দিয়েই পড়ালেখার খরচ চালাতেন। সব সময়ই টানাপোড়নের মধ্য দিয়েই চলতে হতো তাকে।
ভালো ও মজাদার খাবার তেমন একটা জুটত না কপালে। বিষয়টি শাহীন আলমের নজরে পড়ে এবং তিনি কোনো কারণ ছাড়াই ছেলের গৃহশিক্ষকের জন্য যে ব্যবস্থা করেছিলেন তা কখনোই ভুলেননি এই মুশফিকুর রহমান।
এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে কাজী মুশফিকুর রহমান লিখেছেন সদ্য প্রয়াত অভিনেতা শাহীন আলমের মহানুভবতার সেই গল্প।
তার সেই স্ট্যাটাসটি পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো,
‘সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকের কথা, আমার পড়াশোনার খরচ জোগানো বাবার পক্ষে খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তখন শাহীন আলমের ছেলেকে পড়িয়ে নিজের খরচ চালাতাম। মগবাজারে ওনার বাসা ছিলো। তারপর চলে গেলেন নিকেতনের ঝকমকে ফ্ল্যাটে। আমি পরলাম মহাফাঁপরে। সেই জাহাঙ্গীরনগর থেকে আসতাম দুপুরের বাসে। আসাদগেট নেমে গুলশান-১ আসতাম ট্যাম্পুতে। তারপর হেঁটে নিকেতন। এখনকার মতো নিকেতন নয়, সবে শুরু হয়েছে বাড়ি ওঠা। সে গল্প থাক আত্মজীবনীর জন্য।’
মুশফিকুর আরও লিখেছেন, ‘যখন বাচ্চাটাকে পড়িয়েছি বেশিরভাগ দিনই দুপুরের ভাত খাওয়াটা হতো না। সেই জাহাঙ্গীরনগরে আড়াইটার বাস ধরতে ছুটতে হত। সেই জাহাঙ্গীরনগর টু নিকেতন। কাঁচা রাস্তা। মহাখালী ফ্লাইওভারের কাজ চলে। সে এক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পড়ানো শেষ করে ফিরতে হতো রাতে। যাক সে আলাপও থাক। একদিন শাহীন আলমের মা এসে দেখলেন চায়ের সঙ্গে দেওয়া গোটা কয়েক বিস্কুট এক নিমিষেই খেয়ে ফেলেছি। চরম ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত আমার সেদিকে কোনো খেয়াল ছিল না। পরদিন থেকে হঠাৎ রকমারি নাস্তা আসত। রাক্ষুসে খিদেটা মিটত। একদিন কালো স্যুট পরা শাহীন আলম সাহেব আমাকে রাতে নিকেতনের কাঁদাপানিতে ফিরতে দেখেন। আমি হন্তদন্ত হয়ে ৮টার বাস টার্গেট করে জোর কদমে হাঁটছি বলা ভুল হবে, দৌড়োচ্ছি। পরেরদিন ছেলের পড়া দেখতে আসবার ছলে অবজারভ করেন আমি সমুচা-রোল যা দেয় তা ঝাঁপিয়ে পরে খাই। পড়ানোর চেয়ে খাওয়ায় আমার আগ্রহ। তিনি কোনো কথা না বলে অন্য রুমে চলে যান।’
এরপর কাজী মুশফিকুর রহমান লিখেছেন , ‘তারপর থেকে মাস্টার্স দেয়া অবধি যতদিন ফাহিম (শাহীন আলমের ছেলে) সম্ভবত ছেলেটার নাম। পড়িয়েছি আমার জন্য বাহারি তরকারি দিয়ে ভাত আসত নাস্তা হিসেবে। রাতে ওনার চকচকে গাড়িটা বেশিরভাগ দিনই আসাদ গেট নামিয়ে দিয়ে যেত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টার বাস ধরতে। বেতনও বাড়িয়ে দিলেন না চাইতেই। এমন অসীম মমতাবান একজন মানুষকে আপনারা চিনেন একজন অভিনেতা হিসেবে, অশ্লীল ছবিও করেছেন তিনি। আপনাদের হিসেবে। আর আমি চিনি একজন অভুক্ত মানুষকে পরম মমতার ছায়ায় আশ্রয়দাতা হিসেবে। আপনাদের হিসেবে কুলোবে না। শাহীন আলম আল্লাহতায়ালা আপনাকে অনেক অনেক শান্তিতে রাখুক। আমিন।’
কাজী মুশফিকুর রহমান এখন একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। এখন আর তার ছাত্রজীবনের মতো কষ্টের জীবন নেই। তবুও শাহীন আলমের সেই মহানুভবতার কথা সবাইকে জানাতে এতটুকুনও কার্পণ্য করেননি।
প্রসঙ্গত, মঞ্চনাটকের মাধ্যমে অভিনয়ের শুরু করেন শাহীন আলম। তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘মায়ের কান্না’, যেটি ১৯৯১ সালে মুক্তি পেয়েছিল। যদিও গোয়েন্দা কাহিনি 'মাসুদ রানা' দিয়ে অভিনয় জগতে পা রাখার কথা ছিল তার। অর্থ সংকটে পড়ে বিগবাজেটের ছবিটি ৩০ শতাংশ কাজ হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। তবে 'নয়া বাইদানি' ছবিতে অভিনয়ের পর শাহীন আলমকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
তবে 'স্বপ্নের নায়ক’ ছবিতে অমর নায়ক সালমান শাহর সঙ্গে অভিনয় করে বেশি আলোচনায় আসেন এ চিত্রনায়ক।
ক্যারিয়ারে দেড়শোর বেশি ছবিতে অভিনয় করা এ চিত্রনায়কের অন্যতম ছবিগুলো হচ্ছে - অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- ঘাটের মাঝি, এক পলকে, গরিবের সংসার, তেজী, চাঁদাবাজ, প্রেম প্রতিশোধ, টাইগার, রাগ-অনুরাগ, দাগী সন্তান, বাঘা-বাঘিনী, আলিফ লায়লা, স্বপ্নের নায়ক, আঞ্জুমান, অজানা শত্রু, দেশদ্রোহী, প্রেম দিওয়ানা, আমার মা, পাগলা বাবুল, শক্তির লড়াই, দলপতি, পাপী সন্তান, ঢাকাইয়া মাস্তান, বিগবস, বাবা ও বাঘের বাচ্চা।
এলএবাংলাটাইমস/এলআরটি/ই
শেয়ার করুন