আপডেট :

        সিডনিতে হনুক্কা অনুষ্ঠানে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা, নিহত ১৬; দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় নিরাপত্তা জোরদার

        হলিউড পরিচালক রব রাইনার ও স্ত্রী মিশেল লস এঞ্জেলেসের বাড়িতে মৃত অবস্থায় উদ্ধার

        ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে গুলির ঘটনায় ‘পার্সন অব ইন্টারেস্ট’ আটক, জানিয়েছে পুলিশ

        ক্যালিফোর্নিয়ায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে উড়ে গেল বাড়ি, আহত ৬

        প্যানোরামা সিটিতে তিন গাড়ির সংঘর্ষে নিহত ৩, আহত ১

        ক্যালিফোর্নিয়ায় গ্রিন কার্ড আবেদনকারীকে সাক্ষাৎকারের সময় আটক করল আইসিই

        ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল: ভুক্তভোগীদের জন্য ৩৩.৯ বিলিয়ন ডলার সহায়তায় ট্রাম্পকে দ্রুত পদক্ষেপের আহ্বান নিউসমের

        অরেঞ্জ কাউন্টিতে বাইবেল স্টাডি নেতা গ্রেপ্তার: নাবালককে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ

        ক্যালিফোর্নিয়ায় ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতা ও শীর্ষ সদস্য গ্রেপ্তার: নিখোঁজ সদস্যের হত্যার অভিযোগ

        ট্রাম্পের চাপ উপেক্ষা করে ইন্ডিয়ানা রিপাবলিকানদের ভোটিং মানচিত্র বাতিল

        প্যাসিফিক নর্থওয়েস্টে বন্যা, হাজারো মানুষ সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি

        ক্যালিফোর্নিয়ায় অভিবাসীদের দেয়া ১৭ হাজার বাণিজ্যিক ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল

        মার্কিন ভিসামুক্ত দেশগুলোর পর্যটকদের পাঁচ বছরের সোশ্যাল মিডিয়া ইতিহাস জমা দেওয়ার প্রস্তাব

        ওয়ারেন কাউন্টির নারী ৪,২০০ ডলারের বেশি SNAP সুবিধা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার

        মার্কিন বিচার বিভাগের সিভিল রাইটস ডিভিশন ‘ধ্বংসের মুখে’—২০০’র বেশি সাবেক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ

        কেন্টাকি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গুলিতে শিক্ষার্থী নিহত, সন্দেহভাজন আটক

        যুক্তরাষ্ট্রে ১৯ দেশের অভিবাসন স্থগিত — আফগানদের জন্য অনিশ্চয়তা

        ট্রাম্প প্রশাসনে বড় পরিবর্তনের আভাস: নতুন বছরে বরখাস্ত হতে পারেন নোম, প্যাটেল ও হেগসেথ

        কোরিয়াটাউনে ভাড়াটিয়াদের গাড়ি টেনে নিয়ে পার্কিং স্থানে ঘর বানাতে চায় মালিক

        ট্রাম্প প্রশাসন জানুয়ারি থেকে ৮৫ হাজার ভিসা বাতিল করেছে: স্টেট ডিপার্টমেন্ট

নবীদের আমল ভিত্তিক বিশেষ ইবাদতের সুযোগ

নবীদের আমল ভিত্তিক বিশেষ ইবাদতের সুযোগ

আল্লাহর ইবাদতের ভিত্তি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। তারপরই রয়েছে রোজা, যাকাত ও হজ্জ। যথাযথ নিয়ম মেনে এই ইবাদতগুলোর অনুশীলনে আমরা বাধ্য। তবে নির্ধারিত পরিমাণের বাহিরেও এই ইবাদতগুলো করা যায় এবং তা করেও থাকেন অনেকেই। ইবাদতগুলোর অতিরিক্ত অনুশীলন অনেকটাই সেই আদর্শ ছাত্রের মত যে কিনা ক্লাসে নিয়মিত হওয়ার পরও বাড়িতে বসেও পড়াশোনা করে সময় নিয়ে, একাগ্রতার সাথে। শুধু পরীক্ষায় পাশ করাই এদের লক্ষ্য থাকে না বরং তাদের ভাবনায় থাকে আরও ব্যাপক সফলতা। এদের মেধাকে শানিত করতে শিক্ষকরা ইচ্ছা   করেই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জিং পরীক্ষা ও প্রশ্নের সৃষ্টি করে থাকেন। এগুলোই বিশেষায়িত পরীক্ষা, স্পেশালাইজড প্রশ্নপত্র। আল্লাহ পাকের বিশিষ্ট বান্দাদেরকে নিয়মিত উত্তীর্ণ হতে হয়েছে এ রকম বিশেষ পরীক্ষায়। এজন্যে রয়েছে বিশেষ উত্তরপত্রও তথা বিশেষ আমল ও ইবাদত।

হযরত আদম আ:-কে বিশেষ ইবাদত করতে হয়েছিল নিষিদ্ধ ফলের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় পর। এজন্যে তাঁকে পাঠ করতে হয়েছিল ‘রাব্বানা জালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওতারহা’মনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন (সূরা ৭: আয়াত ২৩ দ্রষ্টব্য)। এটা ছিল আদম আ:-এর জন্যে নিয়মিত সব ইবাদতের বাহিরে বিশেষায়িত বাড়তি ইবাদত তথা বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে বিশেষ আমল।

বিশেষ পরীক্ষা দিয়েছিলেন হযরত ইউনুস আ:-ও। সেই পরীক্ষায় পাশ করতে তাকে মাছের পেটে আটক অবস্থায় পড়তে হয়েছিল ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জালিমিন (২১: ৮৭ দ্রষ্টব্য)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন, ইউনুস আ: যদি ঐ আমলে ব্যর্থ হতেন তাহলে তাকে কিয়ামত পর্যন্ত থাকতে হতো সেই মাছের পেটে (৩৭: ১৪৩~১৪৪ দ্রষ্টব্য)।
উল্লেখ্য যে হযরত আদম আ: ও ইউনুস আ:-কে ঐ দোয়াগুলো যে কত লক্ষ বার পড়তে হয়েছিল তা জানা না গেলেও এটা সুনিশ্চিত যে নিজেদের ভুল থেকে মাফ পেতে দোয়া দুটো অতিশয় কার্যকর। বস্তুত সেটাই ছিল বিশেষ ঐ ইবাদতগুলোর মূল শিক্ষা। ধারণা করতে অসুবিধা হয় না যে তাঁদের দোয়া পাঠের সংখ্যা উহ্য রেখে দয়াময় আল্লাহ পাক বস্তুত সবিশেষ দয়া করেছেন আমাদের প্রতি নচেৎ ঐ নির্দিষ্ট সংখ্যা পর্যন্ত পাঠ করা আমাদের জন্যেও হয়তো শর্ত হয়ে যেত।
এরকম বাড়তি ইবাদত সম্মিলিত ভাবেও করা সম্ভব। ব্যাপক মানুষ অংশ নেয়ায় সেক্ষেত্রে প্রার্থনা কবুলের সম্ভাবনাও থাকে বেশী। এমন সম্মিলিত ইবাদতের অন্যতম উদাহরণ হিসেবে পবিত্র আল কোরআনে বর্ণিত হয়েছে হযরত ইউনুস আ:-এর সম্প্রদায়ের ক্ষমা প্রার্থনার ঘটনা (৩৭: ১৪৭~১৪৮ দ্রষ্টব্য)। আল্লাহ পাকের আযাবের নমুনা দেখা মাত্রই তারা বুঝতে পেরেছিল তাদের অপরাধ, অনুতপ্ত হয়েছিল সাথে সাথেই। সবাই মিলে জান বাজি রেখে কান্নাকাটি শুরু করেছিল আল্লাহ পাকের দরবারে। মহান আল্লাহ পাক কবুল করেছিলেন তাদের সেই আন্তরিক প্রার্থনা।

এটাই বস্তুত অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টির মত ব্যাপক দুর্যোগে সবাই মিলে একত্রে নামাজ পড়া ও দোয়া করার ফর্মুলা। হজ্জের সময় আরাফাতের সম্মিলিত দোয়া এবং বিভিন্ন মজলিস ও ইজতেমা শেষের মুনাজাতও এই সূত্রের মধ্যেই পড়ে, তাই নিঃসন্দেহে মূল্যবান। উল্লেখ্য যে দুনিয়াতে হযরত ইউনুস আ:-এর সম্প্রদায়ই ছিল একমাত্র পূর্ণ জাতি যারা সবাই ঈমান এনে মুসলমান জাতি ভুক্ত হয়েছিল। পবিত্র কোরআনে এই সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা এক লাখের কিছু বেশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে (৩৭: ১৪৭ দ্রষ্টব্য)। উল্লেখ্য যে আল্লাহ পাকের নবীদের সংখ্যা এবং নবীজি সা:-এর সাহাবির সংখ্যাও ছিল এক লাখের অধিক, অধিকাংশ বর্ণনা মতে তা ছিল এক লাখ চব্বিশ হাজার।

এই সংখ্যার বার বার এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারে কারণেই একে আল্লাহ পাকে অন্যতম হেকমত পূর্ণ একটা বিশেষ সংখ্যা হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এখান থেকেই এসেছে এক লাখ চব্বিশ হাজার বারে এক খতম হওয়ার সূত্র যা কিনা কালেমা শরিফ বা দোয়া ইউনুসে মত ছোট ছোট দোয়া-কালাম খতমের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ব্যাপক ভাবে। এমন খতমের অনন্য গুরুত্ব ও অসামান্য কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ ভাবে প্রমাণিত।
সম্মিলিত ইবাদতের উদাহরণ হিসেবে পবিত্র কোরআনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে হযরত ঈসা আ: ও তাঁর সাহাবিদের ইবাদত। উল্লেখ্য হযরত ঈসা আ:-এর সহযোগী হাওয়ারিরা এক পর্যায়ে জান্নাতি খাবারের আবদার করেছিল। ঈসা আ: তাদেরকে বলেছিলেন কিছু বাড়তি ইবাদত করে তারপর আল্লাহর কাছে নিজেদের মনোবাঞ্ছা জানাতে। এজন্যে তারা রোজা করেছিলেন পুরো এক মাস। অতঃপর ঈসা আ: দোয়া করেছিলেন আল্লাহর দরবারে জান্নাতি খাদ্যের জন্য এবং আল্লাহ পাক নাযিল করেছিলেন বেহেশতি খাবার (৫: ১১২~১১৫ ও সংশ্লিষ্ট তফসির দ্রষ্টব্য)।

এটাও সম্মিলিত ও সমন্বিত ইবাদতের আরেকটি অনন্য নমুনা যেখানে নিজেদের পবিত্র চাওয়া পূরণের উপায় ও পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে সাধারণ গণ-মানুষকে। এতে এটাও প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে হলে তার আগে কিছু আমল ও ইবাদত করে নেয়া জরুরী। এটা দোয়া কবুলের একটা প্রমাণিত সূত্র। এই সূত্রের ভিত্তিতেই বোধকরি যে কোন দোয়ার আগে কোরআন থেকে তেলাওয়াত এবং দরূদ পড়ার বিধান প্রচলিত হয়েছে যা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করে থাকেন আলেম-ওলামা, ইমাম-বুজুর্গ থেকে শুরু করে সাধারণ মুসল্লি পর্যন্ত সবাই। 

আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষ কিছুর চাওয়া ও পাওয়ার ক্ষেত্রে এই যে বিশেষ ইবাদতের ধারা তার মধ্যে হযরত জাকারিয়া আ: ও হযরত মুসা আ:-এর ইবাদতও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। জাকারিয়া আ:- এর ইবাদত ছিল বৃদ্ধ বয়সে পুত্র সন্তান লাভের অভাবিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আল্লাহ পাকের বিশেষ ঐ দয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও সন্তান লাভের স্মারক হিসেবে হযরত জাকারিয়া আ: আদিষ্ট হয়েছিলেন তিন দিন কারো সাথে কোন কথা না বলে একাধারে ইবাদত করার জন্য। খুব দরকারি কাজে ইশারা-ইঙ্গিতের অনুমতি থাকলেও মুখ খোলার অনুমতি ছিল না ঐ তিন দিন (৩: ৪০~৪১ দ্রষ্টব্য)। আল-কোরআনে গুরুত্বের সাথে এই ইবাদতের উল্লেখ করে আল্লাহ পাক মূলত এমন ইবাদতে উৎসাহিত করেছেন সাধারণ মানুষকে যাতে তারা নিজেদের জীবনে তা প্রয়োগ করে উপকৃত হতে পারে এবং লাভ করতে পারে আল্লাহ পাকের বিশেষ রহমত।

হযরত মুসা আ:-এর ইবাদতের ব্যাপ্তি ছিল দীর্ঘ চল্লিশ  দিন। ইবাদতটা তাঁকে করতে হয়েছিল তুর পাহাড়ের একান্ত পরিবেশে আল্লাহর কিতাব লাভের জন্য অপেক্ষমাণ অবস্থায়। উল্লেখ্য নবুওয়ত প্রাপ্তির সময় নবীজি সা:-ও একই রকম নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতের অবস্থায় ছিলেন মক্কার হেরা গুহায়। মুসা আ:-কে প্রথমে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল ত্রিশ দিন রোজা করার, পরে আরও দশ দিন বাড়িয়ে তা করা হয়েছিল পুরোপুরি চল্লিশ দিন (৭: ১৪২ দ্রষ্টব্য)। এটা চল্লিশ দিনের বিশেষায়িত বা স্পেশালাইজড ইবাদতের ফর্মুলা ও তার ব্যবহারিক উদাহরণ।

উল্লেখ্য করা আবশ্যক যে চল্লিশ সংখ্যাটা আল্লাহ পাকের অতি হেকমত পূর্ণ একটা সংখ্যা। সৃষ্টির প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই চল্লিশ বা চল্লিশের গুণিতক সংখ্যার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তাই একনাগাড়ে চল্লিশটি দিন যদি কাটানো যায় টানা নামাজ, রোজা ও দোয়া-দরূদে তাহলে তা যে কারো জন্যেই একটা ‘মাইল ফলক’ ইবাদত হতে বাধ্য, তা সেই ইবাদতকে চিল্লা বা চল্লিশা যে নামেই ডাকা হোক না কেন। এ রকম নিরবচ্ছিন্ন ‘প্যাকেজ ইবাদত’ দ্বারা মানুষের পবিত্র মনোবাঞ্ছা যে কিভাবে পূরণ হতে পারে তারই প্রত্যক্ষ প্রমাণ পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত মুসা আ:-এর ঐ চল্লিশ দিনের বিশেষ ইবাদত।
দেখা যাচ্ছে যে তিন দিন, ত্রিশ দিন বা চল্লিশ দিনের ইবাদতগুলো বস্তুতপক্ষে আল-কোরআনেরই বিশেষ নির্দেশনা (Recommendations), তবে ফরজ বা সুন্নাহ ভুক্ত ইবাদত নয়। একই ভাবে বিভিন্ন দোয়া-কালেমা পাঠে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বার এবং ফাতেহার মত সূরা পাঠে চল্লিশ সংখ্যা ভিত্তিক লক্ষ্য স্থির করাও পবিত্র কোরআনেরই দর্শন ভুক্ত তাই অবশ্যই তা মানুষের কল্যাণে প্রয়োগযোগ্য। ইবাদতের এই বিশাল পরিসীমা ঠিক ঠিক বুঝেছিলেন আল্লাহ-ওয়ালা বুজুর্গগণ। তাই তাঁরা জীবন জুড়ে এসব আমল করে গেছেন নিষ্ঠার সাথে। বস্তুতপক্ষে এমন এক্সক্লুসিভ ইবাদত ছাড়া বুজুর্গি লাভ করাও বোধকরি সম্ভব নয়। তাঁরা সাধারণ মানুষকেও অবশ্যই লাভবান করতে চেয়েছেন একই ভাবে। তাই হয়তো  কুলখানি-চল্লিশার মত আঞ্চলিক নাম দিয়ে স্বজন হারানোর একান্ত সময়ে আমলগুলো করার উপদেশ দিয়ে থাকবেন। এভাবে নফল ইবাদতের সুযোগ খুঁজে নেয়াও বস্তুর আল্লাহ পাকেরই নির্দেশনা (৫: ৩৫ দ্রষ্টব্য)। তবে সে সব এখন পরিণত হয়েছে শুধুই যেন মৃত্যুকালীন আনুষ্ঠানিকতায়, আমল সেখানে হয়ে পড়েছে গৌণ।

বস্তুত আপন জনের মৃত্যুই পারে মানুষকে তার জীবদ্দশায় চাক্ষুষ ভাবে পরকালকে দেখাতে। এমনকি চরম নাস্তিকও তখন ঠিকই দেখতে পায় পরোপারকে এবং মানুষ তাৎক্ষণিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারে পরম শক্তিমান আল্লাহ তা’য়ালার উপস্থিতিকে। মনের ঐ অবস্থায় যে ভাবে হৃদয় উজাড় করা কান্নার সাথে আল্লাহ পাকের ইবাদত করা সম্ভব তা অন্য সময় সম্ভব নয় কোন ভাবেই। এ রকম ইবাদত কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অত্যধিক এবং এমন সার্থক ইবাদতই দরকার আমাদের জীবনে। কারণ যে ইবাদতে আন্তরিকতা নেই তা কবুলের সম্ভাবনা খুবই কম বরং অনেক ক্ষেত্রে সেটা ক্ষতির কারণও হতে পারে (১০৭: ৪~৬ দ্রষ্টব্য)। তাই ওটাই মোক্ষম সময় সমাজ ও সংসার ভুলে একাগ্র ভাবে আল্লাহকে ডাকার, সেরা সুযোগ জাকারিয়া আ:-এর তিন দিনের ইবাদতের সূত্রকে নিজের জীবনে কার্যকর ভাবে প্রয়োগ করার। মৃতের জন্যে তিন দিনের বেশী শোক না করার যে বাধ্যবাধকতা আছে তা ঠিক রেখেই করা যায় বিধায় এটা একটা নিখাদ ইবাদত হতে পারে নিঃসন্দেহে। তবে চল্লিশ দিন ধরে শোক পালন করা সুন্নতের খেলাফ। চল্লিশ দিনের ইবাদত করতে হলে তা করতে হবে জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্মের সাথে একত্রে। এমন নফল ইবাদত নিজের সুযোগ মত করার স্বাধীনতা মানুষের আছে (৫: ৩৫ দ্রষ্টব্য)। কিন্তু ফরজ বা সুন্নাহর ক্ষেত্রে এ রকম সুযোগের কোন অবকাশ নেই, কারণ সেগুলো যথা সময়ে, যথা নিয়মে পালন করতে আমরা বাধ্য।

শুধুমাত্র আঞ্চলিক নামকরণের কারণে কুলখানি, চিল্লা বা চল্লিশার মত একনিষ্ঠ ইবাদতগুলো বাতিল বা বিদআত হতে পারে না। তেমন হলে সালাতকে নামাজ আর সিয়ামকে রোজা বলার কারণে নষ্ট হয়ে যেত আমাদের সব রোজা-নামাজ। আবার এগুলোকে বিধর্মীদের শ্রাদ্ধের সাথে তুলনা করে মুসলমানদের জন্য বাতিল বলাও বাস্তব সম্মত নয় কারণ মুসলমানদের ইবাদতের সাথে ভিন্ন ধর্মীদের কিছু কিছু উপাসনা ও ভঙ্গিমার মিল থাকলেও তার সঙ্গত কারণও আছে। কারণটা আল্লাহ পাক স্বয়ং উল্লেখ করে বলেছেন, শুরু থেকেই ধর্ম ছিল একটাই, শুধুই ইসলাম; পরবর্তীতে তা বিভক্ত হয়েছে বিবিধ স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক শত্রুতার কারণে (৩:১৯ দ্রষ্টব্য)। তাই মুসলমানরা কখনোই বিধর্মীদের অনুসরণ করে না বরং অন্য ধর্মগুলোই ইসলামকে বিকৃত করে তৈরি, তাই সেগুলো বাতিল বলে গণ্য। এছাড়াও মুসলমানদের ইবাদত কোন ভাবেই অন্যদের উপাসনার সাথে তুলনীয় হবার নয় কারণ মুসলমানদের ইবাদতে সরাসরি যুক্ত থাকে পবিত্র কোরআন যা অন্যদের কোন উপাসনাতেই থাকে না কখনো।
আবার কোরআনে সরাসরি উল্লেখ থাকার কারণে হাদিসে না পাওয়া গেলেও ইবাদত গুলোকে বাতিলের সুযোগ নেই কেননা তাতে হাদিস দিয়ে কোরআনকে চ্যালেঞ্জ করার মত ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। অথচ হাদিস সব সময়ই কোরআনের সহযোগী, কোন ভাবেই সাংঘর্ষিক হবার নয়। প্রকৃতপক্ষে আল-কোরআনে বর্ণিত বাড়তি ইবাদতগুলো নবীজি সা: ও তাঁর সাহাবিরা এমন ভাবেই করেছেন যে সেগুলোও নিয়মিতই হয়ে গিয়েছিল তাঁদের জীবনে। শুধুমাত্র জেহাদ থেকেই এমন কত শত তিন দিন বা চল্লিশ দিনের ইবাদতময় সময় যে যুক্ত হয়েছে তাঁদের জীবনে তা গুণে শেষ করা যাবে না। তাই আজকের আরামের জীবনে বসে আমাদের পক্ষে একথা বলা শোভনীয় নয় যে তাঁরা ইবাদতগুলো করেননি। আমরা যেহেতু ফরজ ইবাদতকেই বোঝা মনে করি তাই বস্তুত আদা-পানি খেয়ে খুঁজতে থাকি অতিরিক্ত যে কোন ইবাদতকে বিদআত বানানোর ফতোয়া। বড়ই আত্মঘাতী আমাদের এইসব ছল-চাতুরী।

আরও উল্লেখ্য যে নবীজির সময়টা ছিল মৃত্যুময়। এমন দিন খুব কমই ছিল যেদিন মৃত্যু হানা দেয়নি তাঁদের দুয়ারে। এতে তাঁরা পরলোককে দেখেছেন চাক্ষুষ ভাবে একেবারে চোখের সামনে এবং যথার্থ বাস্তবতার সাথে আক্ষরিক অর্থেই উপলব্ধি করেছেন যে আল্লাহ ছাড়া আদতেই মানুষের কোন বন্ধু নেই, কোন সাহায্যকারীও নেই। এরকম বোধ সম্পন্ন অন্তর আল্লাহকে একান্তে পেতে উদগ্রীব থাকে সব সময়। তাই আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে উনাদের কোন রাত-দিন ছিল না, কোন ক্লান্তি ছিল না। সে সব ইবাদতে নিজেদের নিহত সাথীদের জন্যে কিভাবে যে বুক ভাঙ্গা ক্রন্দনে সময় কেটেছে তাঁদের তা বুঝতে কারোরই কষ্ট হওয়ার কথা নয়। জীবদ্দশায় যাদের সাথে তাঁরা নিজেদের সর্বস্ব ভাগ করে নিয়েছিলেন সেই সাথী ভাইদের মৃত্যু তাঁদেরকে যে কিভাবে নাড়া দিয়ে গেছে তা বলে বুঝানো সম্ভব নয়। তেমন মমত্ব ও আন্তরিকতা দিয়ে যদি প্রতিদিন মৃত সঙ্গী-সাথী ও আত্মীয়-পরিজনের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা যায় তাহলে আয়োজন করে বিশেষ প্রার্থনা করার আর দরকার হয় না।

নবীজিও স্বয়ং প্রতি রাতে যিয়ারত করেছেন মুসলমানদের কবর, দোয়া করেছেন প্রত্যেক বিদেহী আত্মার জন্যে। উনার রাত জাগা সুদীর্ঘ নামাজগুলোও যে ছিল নিহত প্রিয় সতীর্থদের জন্য ফরিয়াদে পূর্ণ তাও বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ ঈমানদারদের প্রতি নবীজির ভালোবাসা ছিল কিংবদন্তি তুল্য যা কিনা আল্লাহ পাক স্বয়ং সাক্ষ্য দিয়েছেন পবিত্র কোরআনে, বলেছেন, তোমাদের মধ্যে রয়েছেন এমন নবী যিনি কষ্ট পান তোমাদের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলোতে। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী। তিনি মু’মিনদের প্রতি অত্যধিক স্নেহশীল ও দয়াবান (৯: ১২৮ দ্রষ্টব্য)। নবীজির মমতা থেকে বস্তুত বাদ ছিলেন না কেউই। এমনকি নিষেধাজ্ঞা না আসা পর্যন্ত তিনি দোয়া করা অব্যাহত রেখেছিলেন তাঁর পরলোকগত মুশরিক চাচার জন্যেও (৯: ১১৩ ও সংশ্লিষ্ট তফসির দ্রষ্টব্য)। তাঁর সেই সব দোয়-কালাম ও মোনাজাতগুলো সবই ছিল শুধুই পবিত্র কোরআন-ময়। কারণ তিনি অন্য কোন কালাম জানতেন না। কোরআন ছাড়া তিনি অন্য কোন বই পড়েন নি, কোন কিছু রচনাও করেননি (২৯: ৪৮ দ্রষ্টব্য)।
আসলে কোরআনে বর্ণিত দোয়া-কালাম ও ইবাদতগুলো এমন ভাবে একীভূত (Integrated) ছিল নবীজি সা: ও সাহাবিদের দৈনন্দিন ইবাদতের মধ্যে যেমন সাগরের পানিতে মিশে থাকে অন্তহীন দ্রব্যাদি। তাই সেগুলো দৃশ্যমান নয় আলাদা আলাদা ভাবে। এরকম একীভূত বিষয়ের ভেতরে একাকার হয়ে মিশে থাকা অন্যান্য বিষয়গুলোকে সাধারণত খোঁজ করে বের করতে হয়। বিষয়টা শরবতে মিশে থাকা চিনির মত যা কিনা পান করে বুঝতে হয় অথবা পানিতে একীভূত হয়ে থাকা হাইড্রোজেন-অক্সিজেনের মত যা চোখে দেখা যায় না, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বের করতে হয়। হাদিসে না থাকা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এভাবেই। কারণ নবীজি কখনো কাঁঠাল খেয়েছেন কিনা তা হাদিস ঘেঁটে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তাই কাঁঠাল যে হারাম ফল না সেটা বুঝতে বিবেচনা করতে হবে হালাল-হারামের পুরো পরিসীমা। আল্লাহ পাক বস্তুত মানুষের প্রতি অতীব দয়ালু, তাই তিনি তাঁর বিশেষ ইবাদতগুলোকে অত্যন্ত সহজ ভাবে তুলে ধরেছেন পবিত্র কোরআনে। নতুবা এত সহজে এগুলো খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতো না আমাদের পক্ষে।

সুতরাং আল-কোরআনের সুস্পষ্ট উপমা ও উদাহরণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তিন দিন, ত্রিশ দিন বা চল্লিশ দিনের ইবাদতের বিষয়ে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নেই। এসব সবই মানুষের লাভবান হওয়ার জন্য অতিরিক্ত সুযোগ ও সুবিধা বিশেষ। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইবাদতগুলো খুব সহজে ও অত্যন্ত কার্যকর ভাবে করা যায় বিধায় সময়টা সদ্ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। এমন ইবাদত থেকে উপকৃত হয়েছেন আমাদের পূর্বসূরি ঈমানদারেরা। তারা আমাদের জন্যে অনুকরণীয় কারণ মুসলমানদের পরবর্তী কোন দলই তাদের পূর্ববর্তীদের চেয়ে উত্তম নয়। তাই কুলখানি বা চল্লিশা অথবা অন্য যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এসব আসলে আল্লাহর ইবাদতেরই সুবর্ণ সুযোগ বৈ  অন্য কিছু নয়। এজন্যেই এই ‘প্যাকেজ ইবাদতের’ সুযোগগুলোকে বিদআতের নামে বিদায়ের চেষ্টা না করে সেখানে হযরত জাকারিয়া আ: ও মুসা আ:-এর আমলের অদলে সুন্নাহ ভিত্তিক ইবাদতের চর্চা নিশ্চিত করা গেলে সেটাই হবে প্রকৃত যথার্থ কাজ। কারণ মাথার ব্যথায় মাথা কেটে ফেলার কোন সুযোগ নেই, তেমন অনাচার আল্লাহ পাকের সহ্য করার কথা নয়। 


Mainul Ahsan, PHD
Clinical Assistant Professor, School of Dentistry, University of Southern California.
লেখকের বই পেতে: Search ‘Mainul Ahsan’ at ‘amazon.com’

শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত