সমাজসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাফলা: সান বার্ডিনোয় ফান্ড রাইজিং ডিনারে বক্তারা
দেশাত্মবোধ, ঐক্য ও মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী সংগঠনগুলোর সর্ববৃহৎ ফেডারেশন ‘বাংলাদেশ ইউনিটি ফেডারেশন অব লস এঞ্জেলেস (বাফলা) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লস এঞ্জেলেসে বাংলাদেশী কমিউনিটির ঐক্য-ভ্রাতৃত্ব সুদৃঢ় করা এবং প্রবাসে বাংলাদেশকে তুলে ধরার পাশাপাশি দেশে-বিদেশে নানা সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। বাফলা চ্যারিটির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাস্তবায়িত হচ্ছে বিভিন্ন মানবসেবামূলক কাজ।
এসব কাজে সহযোগিতা করছেন উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন সিটিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। যাদের নিয়ে প্রতি বছর বাফলা লস এঞ্জেলেসে একটি ফান্ড রাইজিং ডিনার করে থাকে। এছাড়া প্রবাসী অধূষিত বিভিন্ন সিটিতেও অায়োজন করা হয় এই ডিনারের। এরই ধারাবাহিকতায় গত রবিবার সান বার্ডিনো কাউন্টির ইনল্যান্ড ইম্পায়ারে অনুষ্ঠিত হয় আউট রিচ চ্যারিটি ফান্ড রাইজিং ডিনার। এতে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে মূখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাফলা চ্যারিটির কো-অর্ডিনেটর শিপার চৌধুরী। তিনি দেশ-বিদেশে বাফলার বিভিন্ন মানবসেবামূলক কার্যক্রম প্রবাসীদের মাঝে তুলে ধরেন। বাফলা চ্যারিটির সাম্প্রতিক কিছু কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, বাফলার উদ্যোগে গত বছর দেশে ৩ জন অসহায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে পূনর্বাসন করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার কাড়াবাল্লা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম। যার বাস করার মতো একটি ঘর ছিল না। গত বছর তাকে ঘর নির্মাণ বাবত ২,৫০,০০০/- (দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা) প্রদান করে বাফলা। বর্তমানে তিনি নতুন পাকা ঘরে সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন।
আরেকজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জের সিরাজ উদ্দিন। তাঁকে ২,৩০,০০০/- (দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা) ব্যয়ে একটি বিদ্যুৎ চালিত অটোরিকশা কিনে দিয়েছে বাফলা। যার আয়ে তার পরিবারে এসেছে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা। এর আগে উনি বাস করতেন একটি কলোনীতে মাত্র ১ রুমের এক ঘরে। স্ত্রী অন্যের বাসায় বুয়ার কাজ করতেন আর ১২ বছরের শিশু মেয়ে জীবিকার তাগিদে বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কাজ করত। মেয়েটি বর্তমানে স্কুলে গিয়ে লেখা পড়া করছে। এখন এই অটোরিকশার আয়ে তারা ভালো বাসায় স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করতে পারছেন।
কুষ্টিয়ার আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা আর্থিক সংকটের কারণে পরিবার চালাতে গিয়ে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ঋণ হয়ে যান। যা পরিশোধ করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বয়সের ভারে নুব্জ্য হয়ে যাওয়া এই মুক্তিযোদ্ধা নিজের শেষ সময়ে ব্যাপক চিন্তিত ছিলেন এই ঋণ নিয়ে । খবর পেয়ে তার পাশে দাঁড়ায় বাফলা। বাফলার উদ্যোগে ঐ মুক্তিযোদ্ধার দেনা শোধ করে দেওয়া হয়।
এছাড়া নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়া নওগাঁ জেলার বটতলী গ্রামের ২০টি পরিবারকে বাড়ি নির্মাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের দায়িত্ব গ্রহণ করে বাফলা। ১২ লক্ষ টাকার বিনিময়ে এই প্রকল্পটি সম্পন্ন হয়েছে। এখন এই ২০টি পরিবার নির্বিঘ্নে বসবাস করছে।
শিপার চৌধুরী আরও জানান, দেশে শিক্ষা উন্নয়নেও কাজ করছে বাফলা। বাফলা চ্যারিটির উদ্যোগে দেশের উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসহায় দরিদ্র ৫ জন শিক্ষার্থীর পড়ালেখার সম্পূর্ণ খরচ বহন করা হচ্ছে। যা তাদের ৫ বছরের অনার্স-মাস্টার্স কোর্স পর্যন্ত চালু রাখা হবে।
এছাড়াও মানিকগঞ্জে একটি প্রতিবন্দ্বী স্কুলের বাচ্চাদের এক বছরের টিফিনের জন্য টাকা প্রদান করেছে বাফলা।
বাফলা চ্যারিটির আরেকটি সমাজসেবামূলক কাজ হচ্ছে লস এঞ্জেলেসে অস্বচ্ছল প্রবাসীদের জন্য কবর ক্রয়। তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, আমাদের প্রবাসীদের কেউ মারা গেলে অনেকে কমিউনিটতে লাশ দাফনের জন্য সহযোগিতা চান- এই অবস্থায় সহায়তার জন্য বাফলা মোনরোভিয়াতে ১০টি কবর ক্রয় করেছে। যার অর্থমূল্য হচ্ছে ২৫ হাজার ডলার। আর্থিকভাবে অসচ্ছল প্রবাসীদের কেউ মারা গেলে তার জন্য বিনা মূল্যে এই করব দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অসহায় মানুষের জন্য বাফলার আরেকটি প্রজেক্ট হচ্ছে শীতবস্ত্র বিতরণ। গত বছরও দিনাজপুরের দুই জায়গায় এবং কিশোরগঞ্জে বাফলা চ্যারিটির উদ্যোগে ১২০০ কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। গত শীত মৌসুমে লস এঞ্জেলেসে সিরিয়ান রিফুজিদের জন্য সানদিয়েগো ক্যাম্পে ৩৫০টি নুতন জ্যাকেট সরবরাহ করেছে বাফলা চ্যারিটি।
বাফলার আরেকটি অনুদান হচ্ছে টেক্সাস পুলিশ ডিপার্টমেন্টের একজন ডেপুটির বিধবা স্ত্রীর জন্য। স্বামী হারিয়ে ঐ মহিলা অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। বাফলা তাকে ১ হাজার ডলার অনুদান প্রদান করেছে।
বাফলা চ্যারিটির আরেকটি প্রজেক্ট হচ্ছে লস এঞ্জেলেসে হোমলেসদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ। গত বছর হোমলেসদের জন্য বিপুল সংখ্যক উন্নত মানের জ্যাকেট বিতরণ করেছে বাফলা চ্যারিটি।
শিপার চৌধুরী বলেন, এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে মানবতার সেবায় কাজ করতে সহযোগিতা করায় আমরা বাফলা কর্তৃপক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতায় এসব জনহিতকর কাজ সম্ভব হয়েছে। আশা করি আগামীতেও এই ধারা অব্যাহ থাকবে।
স্থানীয় প্রবাসীরা বাফলার এসব মানবসেবামূলক কার্যক্রমের ভূয়শী প্রশংসা করেন। তারা বাফলাকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
ফান্ড রাইজিং ডিনারে প্রবাসীরা বলেন, বিভিন্ন অপপ্রচারের কারণে আগে বাফলা সম্পর্কে অনেকের ভুল ধারনা ছিল। কিন্তু বর্তমানে বাফলার এসব কার্যক্রম দেখে আমাদের ভুল ভেঙেছে। বিবেক জাগ্রত হয়েছে। সবাই বাফলার এসব কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে। বাফলার উপর সবার একটি আস্থা স্থাপিত হয়েছে।
অনেকে বলেন, বাফলা যে মানবসেবায় এরকম কাজ প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে তা আজকের অনুষ্ঠানে না এলে আমরা হয়ত জানতে পারতাম না। বাফলা যেভাবে দেশ এবং প্রবাসীদের সহযোগিতা করে আসছে তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
বক্তারা আরও বলেন, আমরা জানি, অন্যান্য বিভিন্ন চ্যারিটি সংগঠন সংগৃহিত অর্থের শতকরা মাত্র ২৫-৫০ ভাগ চ্যারিটির কাজে ব্যয় করে। কিন্তু বাফলা শতভাগ অর্থই চ্যারিটির কাজে ব্যয় হয়। যা অন্য সংগঠন থেকে বাফলাকে আলাদা করে রেখেছে। এছাড়া বাফলা নিজের মাতৃভূমি নিয়ে ভাবে। দেশের উন্নয়নের জন্য, মানুষের কল্যাণে কাজ করে।
বক্তারা বলেন, আমরা সবাই নিজের উপার্জনের টাকা থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারকে ইনকাম ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। ঠিক একইভাবে আর্তমানবতার সেবায় নিজের উপার্জনের ছোট্ট একটি অংশও আমরা চাইলেই ব্যয় করতে পারি। যা আমাদের পরকালে পুঁজি হয়ে দাঁড়াবে।
নিজের অর্থ মানুষের কল্যাণ এবং উপকারী খাতে খরচ করার তাগিদ দিয়ে বক্তারা বলেন, আমরা আজ অনেকেই ভালো জব করছি, ভালো ইনকাম করছি। তবে এই টাকা সঠিক কাজে লাগাতে পারলেই কেবল জীবনের সফলতা আসবে। আমরা সবাই একদিন মারা যাবো। মারা যাবার পর আমাদের জন্য শুধু নিজের ভালো কাজ ছাড়া আর কিছুই সঙ্গে যাবে না। এসব টাকা পয়সা থেকে যা আল্লাহর ওয়াস্তে মানুষের উপকারে ব্যয় করতে পারব এগুলোই আমাদের সঙ্গে যাবে। তাই বাফলার মতো মানবসেবামূলক সংগঠনগুলোকে আমাদের সহযোগিতা করা উচিৎ।
বাফলা নেতৃবৃন্দের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রবাসীরা বলেন, আমরাও দেশের মানুষের উপকারে ও মানবকল্যাণে কাজ করতে চাই । তাই প্রতিবছর বাফলা যে ফান্ড রাইজিং প্রোগ্রাম করে। তাছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ও বাফলা যদি প্রবাসীদের কাছে মেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম অবগত করেন তাহলে আমরা এসব কার্যক্রমে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারব। কারণ বছরে করলে সবাই একসাথে বেশি টাকা দিতে পারে না। আর বছরে একাধিকবার হলে অল্প অল্প করে সবাই দিলে অনেক বড় অংকের অর্থ সংগ্রহ সম্ভব হবে।
এসময় চ্যারিটির ফান্ডে প্রবাসীদের কাছ থেকে প্রায় ৮ হাজার ডলার সংগৃহীত হয়। এর আগে গত ৪ আগস্ট লস এঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত ‘বাফলা চ্যারিটি অ্যানুয়েল ফান্ড রাইজিং ডিনারে’ সংগৃহিত হয় প্রায় ৩০ হাজার ডলার। এভাবে বাফলা চ্যারিটির ফান্ডে প্রায় ৪০ হাজার ডলার দান করেন প্রবাসীরা।
সবাইকে নিয়ে ডিনার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
অনুষ্ঠানে সার্বিক সহযোগিতা করেন বাফলার সাবেক প্রেসিডেন্ট খন্দকার আলম, জসিম আশারাফী, সাবেক সেক্রেটারি আবুল হাসনাত রায়হান, লে. (অব.) জিয়া ইসলাম, বর্তমান প্রেসিডেন্ট নজরুল আলম ও সেক্রেটারি ইঞ্জিনিয়ার শহিদ আলম।
উল্লেখ্য, বাফলা একটি ট্যাক্স ফ্রি 501(c)(3) সংগঠন। বাফলা চ্যারিটিতে জাকাতের টাকাও গৃহিত হয়। আপনারা কেউ চাইলে মেইলের মাধ্যমে লসে এঞ্জেলেসে বাফলার অফিসে চেক প্রদান করতে পারেন। এছাড়াও অনলাইনে বাফলার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চ্যারিটি ফান্ডে অর্থ প্রদান করা যাবে।
এলএবাংলাটাইমস/এএল/এলআরটি
শেয়ার করুন