৩ র্যাব কর্মকর্তার লোমহর্ষক সেই জবানবন্দি
জানালাবিহীন ৭ বাই ৮ ফুটের ছোট্ট কামরা, একটি চেয়ার
আর একটিমাত্র কম্বল। ছিল না রুচিকর খাবার। বাথরুমেযেতে হলেও অপেক্ষা করতে হতো ২০-২৫ মিনিট। রাত ১১টাথেকে ভোর অবধি চলত বিভিন্ন সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদ।মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যেশেষপর্যন্ত নৃশংস ৭ খুনের ঘটনার জড়িত থাকার কথাস্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন র্যাবের সাবেক ৩কর্মকর্তা। তুলে ধরেন ঘটনার আদ্যোপান্ত। হাইকোর্টেরনির্দেশে গত বছরের ১৬ মে রাতে ঢাকার সেনানিবাস থেকেমেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও লে. কর্নেল (অব.) তারেকসাঈদকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ।তাদের আগেই অবসরে পাঠানো হয়। আর পরের দিন ১৭ মেগ্রেফতার করা হয় চাকরিচ্যুত লে. কমান্ডার এমএম রানাকে।একে একে ৩ জনই হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিলেন। সেই জবানবন্দির চৌম্বকঅংশগুলো তুলে ধরা হল।তারেক বলেছিলেন সমস্যা নেই : ৩২ দিনের রিমান্ড শেষে ১৮জুন নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কেএমমহিউদ্দীনের আদালতে দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা ধরে দেয়াজবানবন্দিতে লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদবলেছিলেন, আমি র্যাব-১১-এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর যোগদান করি। র্যাব-১১কোম্পানি কমান্ডারদের সম্মেলনে আমি নজরুলকে (প্যানেলমেয়র নজরুল ইসলাম) গ্রেফতারের নির্দেশ দিই। আমি লে.কমান্ডার রানাকে বলি, সে যেন মেজর আরিফকে এ বিষয়েসাহায্য করে। ২৭ এপ্রিল বেলা অনুমান ১১টার দিকে মেজরআরিফ আমাকে ফোন করে বলে, স্যার নজরুল আজ কোর্টেআসবে। তাকে আজ গ্রেফতার করা যাবে। তখন আমিনজরুলকে গ্রেফতারের জন্য আরিফকে অনুমতি দিই।ওইদিন আনুমানিক ২টার (দুপুর) সময় মেজর আরিফ আমাকেফোন করে বলে, স্যার টার্গেট ধরা হয়েছে। সঙ্গে আরও ৪জন আছে। সবাইকে নিয়ে নরসিংদী র্যাব ক্যাম্পে যাচ্ছি।বেলা অনুমান ৩টার সময় আরিফ আমাকে রিপোর্ট করে, সেনরসিংদী র্যাব ক্যাম্পে পৌঁছে গেছে।তারেক সাঈদ আরও বলেন, রাত ৮টার সময় আমি নজরুলেরস্ত্রী ও শ্বশুরের জন্য আমার অফিসে অপেক্ষা করছিলাম।ওই সময় মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলে, স্যারআমার লোক বদলি করতে হবে। আপনি একটি গাড়ি দেন।তখন আমি আরিফকে নরসিংদী ক্যাম্পে বিশ্রাম নিয়েএকবারেই নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পে ফিরতে বলি। তখন আরিফজানায়, সে নরসিংদী ক্যাম্পে নেই। নরসিংদী ক্যাম্পকমান্ডার সুরুজ তাকে ঠিকমতো (গ্রহণ) না করায় সে ক্যাম্পথেকে বের হয়ে গেছে। রাত ৮টার পর থেকে রাত ৯টার আগপর্যন্ত আমি নজরুলের স্ত্রী, নজরুলের শ্বশুর ও নজরুলেরআরও ১০-১২ জন লোকের সঙ্গে মিটিং করি। ওই সময়নজরুলের শ্বশুর ও স্ত্রী বলে, নূর হোসেন নজরুলকেঅপহরণ করেছে। নূর হোসেনকে গ্রেফতার করলে নজরুলকেপাওয়া যাবে। তখন আমি বলি, তদন্ত সাপেক্ষে নূরহোসেনকে গ্রেফতার করা হবে। রাত আনুমানিক ৯টার দিকেআরিফ আমাকে ফোন করে বলে, স্যার রাস্তায় পুলিশেরকড়া চেকিং চলছে। আমি বেসামরিক গাড়ি নিয়ে নারায়ণগঞ্জএলে চেকিংয়ে পড়ব। তাই আমার ক্যাম্পে ফেরার জন্যনৌকা দরকার। তখন আমি আরিফকে বলি, লে. কমান্ডাররানার সঙ্গে কথা বলে তুমি নৌকা ঠিক করে নাও।র্যাব-১১-এর সব বোট লে. কমান্ডার রানা তত্ত্বাবধানকরতেন। এরপর আমি বোটের বিষয়ে রানা এবং আরিফদুজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমন্বয় করে নিতে বলি। রাত১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে লে. কমান্ডার রানা আমার অফিসেআসে। আমি রানাকে জিজ্ঞাসা করি, আরিফ কোথায় নিতেবলেছে? রানা বলে, কাঁচপুর ব্রিজের নিচে নিতে বলেছে। রাত১১টা ১৫ মিনিটের দিকে আরিফ আমাকে ফোন করে বলে,স্যার আমি কাঁচপুর পৌঁছে গেছি। তারপর আমি আমারব্যাটালিয়ন অপারেশন কর্মকর্তা (সহকারী পুলিশ সুপার)শাহরিয়ারকে ফোন করে বলি, মেজর আরিফের গাড়ি ওব্যাটালিয়ন থেকে একটি মাইক্রোবাস নৌকাঘাটে পাঠিয়েদাও। রাত আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিটের দিকে আমিনৌকাঘাটে পৌঁছি। আমি পৌঁছার ২০-২৫ মিনিট পর মেজরআরিফ নৌকাঘাটে পৌঁছায়। ওই সময় শাহরিয়ার মেজরআরিফের গাড়ি ও একটি মাইক্রোবাস নৌকাঘাটে পাঠিয়েদেয়। তখন আরিফ বলে, স্যার আসামিদের মেরে ফেলেছি।আমি আরিফকে বলি, মেরে ফেলছ, মানে? কেন মেরেছ?আরিফ বলে, নজরুল আমাকে চিনে ফেলেছে। তাই নজরুলকেমেরে ফেলেছি। অন্যরাও দেখে ফেলেছে, তাই ভয়ে তাদেরওমেরে ফেলেছি। ওই সময় আরিফ বলে, মোট ৭ জনকেমেরেছি। আমি বলি, ৭ জন মানে? তুমি তো গ্রেফতার করেছ৫ জনকে, অন্য ২ জন কোথায় পেলে। তখন আরিফ আমাকেবলে, স্যার আমার গাড়িতে ছিল ৫ জন। পেছনে আর একটিগাড়িতে রানা স্যার ২ জনকে পাঠিয়েছেন। এ ২ জনের বিষয়েআপনাকে জানানো হয়নি। ভেবেছিলাম ক্যাম্পে এসে জানাব।এ কথা শুনে আমি আরিফের টিমের সৈনিকদের নিয়ে চিন্তিতহয়ে পড়ি। তারপর আমি সব সৈনিকের কাছ থেকে আরিফকেমোবাইল নিয়ে নিতে বলি এবং আরিফসহ তার লোকদেরগাড়িতে উঠতে বলে র্যাব হেডকোয়ার্টারে যেতে বলি। মেসেযাওয়ার পথে রাস্তায় পুলিশ আমার মাইক্রোবাস চেক করে।পরে আমার পরিচয় জানার পর পুলিশ আমাকে ছেড়ে দেয়। ২৯এপ্রিল বেলা আনুমানিক ১১টার দিকে আমি ও মেজর আরিফঅতিরিক্ত মহাপরিচালক অপারেশনের (এডিজি অপস) অফিসেযাই। তিনি মেজর আরিফ ও নূর হোসেনের মধ্যেকথোপকথনের সিডি ও লিখিত ভার্সন আমাদের দেখান। ওইসময় অতিরিক্ত মহাপরিচালক আরিফকে বিভিন্ন বিষয়েজিজ্ঞাসাবাদ করেন। এছাড়া আরিফ ও নূর হোসেনেরকথোপকথনের মধ্যে কিছু সাংকেতিক শব্দ থাকায় অতিরিক্তমহাপরিচালক স্যার আরিফকে ওই বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদকরেন। ঢাকার ফ্ল্যাটের বিষয়ে সে বলে, হ্যাঁ ঢাকায় একটিফ্ল্যাট আছে। নূর হোসেনের মাধ্যমে ফ্ল্যাটের টাকা জমাদিই। নজরুলের সঙ্গে নূর হোসেনের শত্র“তা থাকায় সোর্সহিসেবে নূর হোসেনকে ব্যবহার করি। র্যাব হেডকোয়ার্টারথেকে অতিরিক্ত মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলে বের হয়েআমি ও আরিফ বিকালে আনুমানিক ৪টার দিকে নারায়ণগঞ্জর্যাব-১১ এর হেডকোয়ার্টারে চলে আসি। ওইদিন বিকাল৫টায় আমি আরিফ ও রানা মাতৃবাহিনীতে ফেরত যাওয়ারআদেশ পাই। রাত ৮টার মধ্যে যার যার মাতৃবাহিনীতেযোগদান করি।মেজর আরিফের লোমহর্ষক বর্ণনা : তদন্ত টিম ওআদালতে দেয়া জবানবন্দিতে আরিফ হোসেন বলেছেন,তাদের সঙ্গে নূর হোসেনের ভালো সম্পর্ক ছিল। তাদেরদিয়ে এর আগেও নজরুলকে অপহরণ ও গুমের পরিকল্পনারকথা বলেছিল নূর হোসেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ র্যাব রিস্কনিতে রাজি হয়নি। তারেক সাঈদ বিষয়টির দায়িত্ব দেনআরিফের ওপর।এর মধ্যে নূর হোসেন র্যাবকে জানায়, ২৭ এপ্রিলনারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে নজরুলের জামিন শুনানিআছে। পরে আরিফ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জআদালতে চার-পাঁচজন সাদা পোশাকের র্যাব সদস্য পাঠায়।তারা নজরুলের পুরো গতিবিধি নজরে রাখে। ক্ষণে ক্ষণেমোবাইলে আরিফকে জানানো হয় সব কিছু।দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জামিন নিয়ে আদালত থেকে একটিসাদা প্রাইভেটকারে নজরুল ইসলাম বের হওয়ার পরই তাদেরগাড়ি লিংক রোড দিয়ে সাইনবোর্ড যাওয়ার পথেই ফতুল্লাস্টেডিয়ামের কাছে ময়লা ফেলার স্থানে পৌঁছার পর মেজরআরিফের নেতৃত্বে গাড়ির গতিরোধ করা হয়। নজরুলেরগাড়ির পেছনে ছিল আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ি। পরেদুটি গাড়ি থেকে সাতজনকে র্যাবের দুটি গাড়িতে তুলে নেয়া হয়অস্ত্র দেখিয়ে। গাড়িতে ওঠানোর পর তাদের প্রথমেঅচেতন হওয়ার স্প্রে করা হয় যাতে তাৎক্ষণিক জ্ঞানহারিয়ে ফেলে। সাতজনই জ্ঞান হারানোর পর তাদের বহনকরা গাড়ি র্যাবের সাদা পোশাকের লোকজন নিয়ে যায় অন্যগন্তব্যে। এর মধ্যে সাতজনকে বহন করা গাড়ি নিয়ে যাওয়াহয় নরসিংদীতে।পথের মধ্যে তাদের শরীরে আবারও অচেতন হওয়ারইনজেকশন পুশ করা হয়। এরই মধ্যে নূর হোসেনের সঙ্গেকয়েক দফা কথা হয় আরিফের। তখন নূর হোসেন বারবারহত্যার বিষয়ে কথা বলে ও চাপ দিতে থাকে। রাত ১০টার পরকাঁচপুর ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরেঅবৈধভাবে গড়ে ওঠা বালু-পাথর ব্যবসাস্থল জনমানুষ শূন্যকরার জন্য নূর হোসেনকে ফোন দেন মেজর আরিফহোসেন। তাদের বহন করা গাড়ি কাঁচপুর সেতুর নিচে আসারপথে অচেতন সাতজনের মাথা শক্ত পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়েশ্বাসরোধ করে হত্যা করে। কাঁচপুর সেতুর নিচে লাশগুলোউঠানো হয় একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। পুলিশ যাতেকোনো সন্দেহ না করে সে জন্য ওই নৌকাতে ছিলকয়েকজন র্যাব সদস্য। নৌকায় করে লাশ শীতলক্ষ্যা ওধলেশ্বরীর মোহনাতে নেয়ার পথে পেট ফুটো করে গ্যাসবের করে দেয় এবং সবার শরীর ইট দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়।এমএম রানার স্বীকারোক্তি : গত বছরের ৬ জুন সিনিয়রজুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দিনের আদালতে ১৬৪ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন র্যাব-১১ এরস্পেশাল ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানির চাকরিচ্যুত ক্যাম্পকমান্ডার অবসরে পাঠানো নৌ বাহিনীর লে. কমান্ডারএমএম রানা। তিনি বলেন, তার ওপর দায়িত্ব ছিল শুধুনজরুলকে অপহরণ করা। আর পুরো হত্যাকাণ্ডেরপরিকল্পনায় ছিল তারেক সাঈদ ও আরিফ হোসেন। কিলিংমিশনে ছিলেন রানাসহ ২৩ র্যাব সদস্য। যাদের মধ্যেসামরিক বাহিনীতে কর্মরত ২০ জন ও পুলিশ থেকে আসাতিনজন। শুধু নজরুলকে অপহরণের পরিকল্পনা থাকলেও তারসঙ্গে আরও চারজন থাকায় তাদের এবং ঘটনা প্রত্যক্ষকরায় চন্দন সরকার ও তার গাড়ির চালককে হত্যা করাহয়েছে।রানা বলেন, মূলত আমার দায়িত্ব ছিল নজরুলকে অপহরণকরা। আমি সেটাই করেছি। রানা জবানবন্দিতে হত্যার পরলাশ ইট দিয়ে বেঁধে ফেলা, নৌকায় তুলে তিন নদীরমোহনাতে ফেলে দেয়ার প্রত্যক্ষ বর্ণনা দেন।
শেয়ার করুন