রিকশা চালিয়ে লেখাপড়া করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
ঘড়িতে সময় রাত প্রায় নয়টা। রাজশাহী নগরের
নিউমার্কেট এলাকা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরদর্শন বিভাগের শিক্ষক আনিসুজ্জামান রিকশায়উঠবেন। পাশ থেকে একজন রিকশাওয়ালা ডাক দেন,‘স্যার আসেন, কোথায় যাবেন?’ রিকশায় উঠতেগিয়ে তিনি থমকে দাঁড়ান। নিজের চোখকে বিশ্বাসকরতে পারেন না। রিকশাওয়ালা তাঁর বিভাগেরমাস্টার্সের ছাত্র!আনিসুজ্জামান বিব্রত হচ্ছেন দেখে ছাত্রটিএগিয়ে এসে বলেন, ‘স্যার, পড়াশোনার খরচ জোগাড়করার জন্য আমি রাতে রিকশা চালাই। আজ রিকশারমালিককে জমা দেওয়ার টাকাই এখনো পাইনি। তাইডাকছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন?’এ ঘটনা ১ এপ্রিল রাতের। আনিসুজ্জামান তাঁররিকশায় উঠে সোজা প্রথম আলোর রাজশাহীকার্যালয়ে আসেন। ওই ছাত্রের নাম সানোয়ারহোসেন (২৪)। বাবার নাম আমিনুল হক। বাড়িদিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার বোয়ালদারগ্রামে। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে সানোয়ারদ্বিতীয়। এসএসসি পাস করার পর বড় বোনের বিয়েদেওয়া হয়েছে। ছোট ভাইটি এবার জেএসসিপরীক্ষা দেবে। গ্রামের বাজারে সানোয়ারেরবাবার একটি ছোট্ট চা-মিষ্টির দোকান আছে।আবাদি জমি আছে আড়াই বিঘার মতো।সানোয়ার জানালেন, ২০০৯-১০ সেশনে তিনিরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তিহন। সংসার চালাতে গিয়ে বাবা পৌনে দুই লাখটাকায় জমিগুলো বন্ধক রাখেন। এ ছাড়া চারটিবেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ঋণ নিতেহয়েছে। সেই ঋণ চার বছরে বেড়ে ১ লাখ ১৫হাজার টাকা হয়েছে। সপ্তাহে ঋণের কিস্তি দিতেহয় তিন হাজার টাকা। তার ওপর রাজশাহীতে তাঁরপড়াশোনার খরচ। বিশেষ করে মাস্টার্সে এসেবাড়ি থেকে পাঠানো টাকার পরিমাণ একবারেইকমে যায়। তাই তিনি আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলেননা। গত বছর ধরেছেন রিকশার হাতল।প্রায় প্রতিদিনই রিকশা চালান সানোয়ার। মাঝেমাঝে শরীর সায় দেয় না। সেদিন বিশ্রাম নেন।দিনে রিকশার মালিককে ৩৫ টাকা করে জমা দিতেহয়। সাধারণত রাত দুইটার পর যাত্রী পাওয়া যায়না। তবু ভোরের ট্রেনের যাত্রীর জন্য বসে থাকেনসানোয়ার। জমার টাকা বাদ দিয়ে রাতে গড়ে তাঁর৮০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। রিকশাচালানো শুরু করার আগে টিউশনি ও খণ্ডকালীনচাকরির খোঁজ করে সফল হননি সানোয়ার। অনেকচেষ্টা করে একটি টিউশনি জোগাড় করেছিলেন।কিন্তু দেখা গেল, ওই বাড়িতে যাতায়াত করতেইতাঁর আয়ের বেশ কিছু অংশ চলে যায়।সানোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের হবীবুর রহমান হলেরআবাসিক ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপ্রথম দিকে একটি মাসিক পত্রিকা বিক্রি করতেন।সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। সহপাঠী, বন্ধু ও হলেরকোনো কোনো বড় ভাই তাঁকে সহযোগিতা করেন।সানোয়ার জানান, তাঁর ২০ মাসের হলের সিট ভাড়াদুই হাজার টাকা বাকি পড়ে গেছে। হলেরডাইনিংয়ে খাওয়ার বিলও এক মাসের বাকিপড়েছে। এ মাসের শেষের দিকে মাস্টার্স পরীক্ষাশুরু হওয়ার কথা। হলের সিট ভাড়া শোধ করতে নাপারলে মাস্টার্সের ফরম পূরণের সময় হলেরছাড়পত্রও পাওয়া যাবে না। এসব নিয়ে চিন্তায়আছেন।মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সানোয়ারের বাবাবলেন, ‘অনেক ধারদেনা হয়ে গেছে। ছেলেকে সবমাসে সমান টাকা আর দিতে পারি না।’শিক্ষক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘ছেলেটিকে প্রতিদিনক্লাসে দেখি। ১০ দিন শিক্ষাসফরে একসঙ্গেছিলাম। কিন্তু কখনোই ছেলেটির এই দৈন্যের কথাবুঝতে পারিনি। তাঁকে রিকশা হাতে দেখে প্রথমেনিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি।’রাত ১০টার দিকে প্রথম আলোর রাজশাহী কার্যালয়থেকে বের হয়ে সানোয়ার আবার রিকশার হাতলধরলেন। পা রাখলেন প্যাডেলে। হলের সিট ভাড়াও ডাইনিংয়ের খাওয়ার বিল শোধ করে মাস্টার্সেরফরম পূরণের টাকাটা জোগাড় করতে হবে যে!কৃতজ্ঞতাঃ প্রথমআলো
শেয়ার করুন