২০১৫ পরবর্তী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিবিড় নেটওয়ার্ক প্রয়োজন-প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতাকে ঘিরে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে তা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক এবং দক্ষিণের দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা বিরাজ করছে। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা ক্রমাগতভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। যতই সময় গড়াচ্ছে, নতুন নতুন সহযোগিতার বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। গতকাল ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডায় দক্ষিণ-দক্ষিণ ও ত্রিমুখী সহযোগিতা : দক্ষিণের উন্নয়নে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের একসভা উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী কার্যকর দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার মাধ্যমে ২০১৫ পরবর্তী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশগুলোর তথ্য, উন্নত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি বিনিময়ে নিবিড় নেটওয়ার্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের কমিটির সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ উদ্ভাবনমূলক ও গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগিতাকে আরও এগিয়ে নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী বলেন ঢাকায় দু’দিনের যে উচ্চপর্যায়ের সভা আজ (রোববার) থেকে শুরু হচ্ছে তা দক্ষিণ-দক্ষিণ এবং ত্রিমুখী সহযোগিতার ক্ষেত্রে আরকেটি মাইলফলক হবে এবং উন্নয়ন সহযোগিতার একটি কার্যকর কৌশল হিসেবে দক্ষিণ ও উত্তরের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করবে। দক্ষিণের দেশগুলো অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও মান্ধাত্বা আমলের প্রযুক্তির মত অভিন্ন চিরন্তন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার আকাক্সক্ষা নতুন প্রেরণা পাচ্ছে। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার জাতিসংঘ কার্যালয় (ইউএনওএসএসসি) ও ইউএনডিপি’র অংশিদারিত্বে অর্থনীতি সম্পর্ক বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঢাকায় প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেলে দু’দিনব্যাপী এ সভার আয়োজন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কিভাবে দক্ষিণ-দক্ষিণ ও ত্রিমুখী সহযোগিতা আরো বৃদ্ধি করা যায় তা নিয়ে আলোচনার জন্য এতে মন্ত্রীবর্গ, ঊর্ধ্বতন কর্মকতাগণ এবং দক্ষিণ ও উত্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মীরা অংশ নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের এই বিশ্বের সকল দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য বৈশ্বিকনীতি হিসেবে ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডা এ বছর গৃহীত হতে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সভাপতিত্বে সভায় অন্যান্যের মধ্যে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা বিষয়ক ইউএনজিএ উচ্চপর্যায় কমিটির সভাপতি একে আব্দুল মোমেন এবং জাতিসংঘে গ্রুপ-৭৭’র চেয়ারম্যান কিংসলে মামাবোলো বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন ইআরডি সচিব মোহাম্মদ মেজবাহুদ্দিন। এছাড়া জাতিসংঘে উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন বিষয়ক তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কো-ফ্যাসিলেটেটর জর্জ ডব্লিউ টালবট, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা বিষয়ক জাতিসংঘে মহাসচিবের এম্বসেডরের দূত ইপিং ঝৌ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল রিন্তারো তামাকি এতে বক্তৃতা করেন। সভায় জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন ও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি স্যাম কুটেসার বার্তা পড়ে শোনানো হয়। গতমাসে ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান-আফ্রিকান শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে অংশীদারিত্ব আরো জোরদার করা এবং উভয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে অভিজ্ঞতা বিনিময়ই ছিল সম্মেলনের লক্ষ্য। শেখ হাসিনা বলেন দক্ষিণের দেশগুলো যখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের উন্নয়নে অগ্রগতি অর্জন করছে, ঠিক তখনই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ এসে দক্ষিণের দেশগুলোর স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এগুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন, আঞ্চলিক সংঘাত, সন্ত্রাসবাদ, মাদকদ্রব্য ও মানবপাচার এবং সংক্রামক রোগের বিস্তার উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন এসব নতুন নতুন হুমকি মোকাবিলার জন্য তথ্য ও উন্নতজ্ঞান, সঠিক পূর্বাভাস ব্যবস্থা, দুর্যোগ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা, সবুজ প্রযুক্তি, আঞ্চলিক সংযোগ, জ্বালানি দক্ষতা, ডিজিটাইজেশন এবং সর্বোপরি অধিকহারে উন্নয়ন সহযোগিতা বিনিময় বিষয়ে নিবিড় নেটওয়ার্ক স্থাপন প্রয়োজন। উত্তরের দেশগুলো এসব উদ্ভূত হুমকি মোকাবিলায় দক্ষিণের সাথে যোগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গত কয়েকবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিবরণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত কয়েকবছর ধরে ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশ ৬ দশমিক ২ শতাংশ হারে জিডিপি অর্জন করেছে। মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১৪ ডলারে। দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৮ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার আরো ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন আমরা মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছি। মেয়েদের দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিনাবেতনে শিক্ষার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে। সারাদেশের প্রায় ১৩ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন বৃত্তি কার্যক্রমের আওতায় আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন প্রায় শতভাগ শিশু বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ বছর হয়েছে। আমরা এমডিজি ১ ২ ৩ ৪ ৫ ও ৬ অর্জন করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ তহবিল দিয়ে উপকূল এলাকায় বনায়ন, বাঁধ নির্মাণ, সাইক্লোন প্রতিরোধক বাড়িঘর এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়-কাম-সাইক্লোন আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণসহ বিভিন্ন অভিযোজন এবং প্রশমনমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দারিদ্র্য নিরসনে আমার সরকার নিজস্ব উদ্ভাবিত সমাধানের উপর বিশ্বাসী। আমাদের উদ্ভাবিত মোবাইল ব্যাংকিং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। আমাদের এই প্রযুক্তি দক্ষিণের বেশকিছু দেশে গ্রহণ করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন আমরা দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে আরও সহযোগিতা চাই। আমাদের দেশে উদ্ভাবিত লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধানের জাত জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে দক্ষিণে একটি সর্বোত্তম সমাধানের নজির। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, উচ্চশিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, এফডিআই, পূঁজিবাজার উন্নয়ন, বিশ্ববাজারের জন্য মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইত্যাদি বিষয়ে আমরা দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে আরও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে চাই। তবে সম্পদের সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধা, দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা, অকার্যকর আইনি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধের মতো সমস্যার কারণে দক্ষিণের দেশগুলোর পক্ষে এককভাবে এসব ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন উত্তরের সহযোগিতা এসব বাধার অনেকাংশই দূর করতে পারে। গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য দক্ষিণের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত সেন্টার অব এঞ্জিলেন্স দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার গুণগত সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেন্টার অব এঞ্জিলেন্স কর্তৃক উদ্ভাবিত উন্নয়ন সমাধান এবং জ্ঞানসমূহ যাতে সাশ্রয়ীমূল্যের এবং বিনিময়যোগ্য হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, নির্দিষ্ট দেশের চাহিদা এবং অবস্থা অনুযায়ী উন্নয়ন সমাধানগুলোকে উপযোগী করে তুলতে হবে। এই সভা আয়োজনের জন্য প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা বিষয়ক অফিস এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন দক্ষিণের দেশগুলোর প্রতিষ্ঠান অথবা সেন্টার্স অব এঞ্জিলেন্স ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার অধীনে জরুরি অগ্রসর জ্ঞান এবং সক্ষমতা বাড়াতে পারে যা দক্ষিণের জন্য খুবই প্রয়োজন। শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন এই সভা থেকে প্রাপ্ত সুপারিশমালা ‘উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন বিষয়ক তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন দক্ষিণের দেশগুলো তাদের উন্নয়নে অর্থ যোগানের জন্য উপায় খুঁজবে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে উত্তরের ধনী দেশগুলো যে উন্নয়ন সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা যেন কোনভাবেই ব্যহত না হয়।
শেয়ার করুন