নতুন জীবনের প্রস্তুতি ছিটমহলের মানুষের
কুড়িগ্রাম দাশিয়ারছড়া ছিটমহলের একটি চায়ের দোকান। কর্ম-চাঞ্চল্যহীন এক স্থবির জীবন চিত্র। ছিটমহলের বেশিরভাগ মানুষের আয়ের উৎস কৃষিকাজ।
তাই বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় তাদের কোন কাজ থাকে না। তবে সাম্প্রতিক এক ঘটনা বদলে দিয়েছে তাদের জীবন-গতি। চায়ের দোকানে বসে সেটা নিয়েই চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
চার দশকেরও বেশি সময় পর স্থল সীমান্ত চুক্তি বিল ভারতের পার্লামেন্টে পাশ হওয়ার পর ছিটমহলের বাসিন্দারা এখন এক মুক্ত জীবনের স্বাদ অনুভব করার পানে চেয়ে আছেন। স্পষ্ট ভাবে ধরা দেয়-তাদের চোখে-মুখের আনন্দ ।
ছিটমহলের বাসিন্দা মোজাফর হোসেন বলছিলেন “ বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পাইলে যেমন লাগে আমাদের তেমন লাগছে। আনন্দে চোখে পানি এসে যায়”।
সব নাগরিক সুবিধার প্রতীক্ষায় ছিটমহলের মানুষ
প্রায় দুহাজার একর আয়তনের এই দাশিয়ারছড়া ছিটমহলটি কুড়িগ্রামের ভিতরে থাকা সবচেয়ে বড় ছিটমহল। তবে কোনরকমের শিক্ষা, চিকিৎসা, বা কর্মসংস্থানের সুযোগ এখানে নেই।
সড়ক যোগাযোগের বেহাল দশা। এখানকার অনেক মানুষ ভুয়া ঠিকানা দিয়ে পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে। তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন চাকরিবাকরি করেছেন ।
তবে সে সবকিছু হচ্ছে ভুল ঠিকানা ব্যবহার করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলছিলেন তিনি ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে বাংলাদেশের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এম.এ পাশ করেছেন।
অনেকেই পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বাংলাদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে
এখন ছোট একটি চাকরি করছেন। তিনি চান তার মত আরো যারা একই ভাবে পড়াশোনা করেছেন তাদের সনদ যেন এখন বাংলাদেশ সরকার বাতিল না করে।
সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ভিতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল, বাংলাদেশেরই থাকবে। আর ভারতের ভিতরে বাংলাদেশের ৫১ টি ছিটমহল থাকবে ভারতের সাথে।
তবে ছিটমহলগুলোতে বসবাসকারী মানুষেরা কোন দেশের নাগরিক হবেন সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তারা পাবেন। বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ছিটমহলের বেশির ভাগ মানুষ থাকতে চান বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে।
আর এখন তারা অপেক্ষায় রয়েছেন দেশটির নাগরিক হিসেবে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার। মোফাজেল হোসেন নামের একজন বলেন “এখানে আমার জন্ম, আমি বাংলাদেশ থেকে সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছি, এখান থেকে আমি কোথাও যেতে চাইনা”।
আরেকজন বলছিলেন “বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাইলেও আমাদের জমি ছাড়া আর কিছু নেই। আমরা অতি দ্রুত এই জায়গাকে কুড়িগ্রামের একটা ইউনিয়ন করে এখানে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, প্রশাসন করার আবেদন জানাচ্ছি”।
ভারতে যেতে চান অনেকে
তবে ছিটমহলগুলোর অনেকে আবার ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে চলে যেতে চান। এদের কেও কেও কর্মসংস্থানের জন্য ইতিমধ্যে ভারতে রয়েছেন, আবার অনেকের আত্মীয় পরিজন ভারতে থাকায় এখন তারা সেখানে চলে যাওয়া প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ।
যেসব ছিটমহল বাসীরা ভারতে চলে যেতে চান, তাদের জন্য ভারতের পার্লামেন্টে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ভারত সরকার।
চেয়ারম্যান নির্বাচন করে নিজেদের সমস্যা মেটান তারা
তবে সেই পুনর্বাসন প্যাকেজের বিস্তারিত জানার পরেই তারা পারি দেবেন ভারতের উদ্দেশ্যে। এই ছিটমহলের একজন বলছিলেন বাংলাদেশে তার যে পরিমাণ জমি আছে সম পরিমাণ জমি যদি ভারত সরকার দেই তাহরে তারা চলে যাবেন।
আবার কেও কেও মনে করছেন এটা ভারতের অংশ এবং তারা নিজেদের ভারতের নাগরিক মনে করছেন। ফলে সেখানে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
কুড়িগ্রামের আরেকটি ছিটমহল বড়গাওচুলকা
কুড়িগ্রামের ভুরঙ্গামারির উপজেলার আরেকটি ছিটমহল বড়গাওচুলকা। এখানকার এক প্রজন্ম কোন দেশের নাগরিক না হয়েই পার করছেন তাদের জীবন, তবে তাদের ছেলেমেয়েরা যে একটি দেশের নাগরিক হতে পারবেন এতেই খুশির বড়গাওচুলকার মানুষ।
মোহাম্মদ মজিবর বলছিলেন “আমাদের কোন পরিচয় ছিল না, কিন্তু এখন আমাদের ছেলে-মেয়ে, আবার তাদের ছেলেমেয়ের নাগরিকত্ব হবে এতেই আমরা খুশি”।
ছিটমহলগুলোতে নেই কোন পুলিশ-প্রশাসন। তারা নিজেরাই চেয়ারম্যান, মেম্বার নির্বাচন করে নিজেদের সমস্যার সমাধান করে আসছেন। যেন দেশের মধ্যে থেকেও- সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন এক ভূখণ্ড। তবে এখন এসব মানুষেরা দিন গুনছেন চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে, তাদের সেই বন্দি জীবনের অবসান হবে- হোক সে ভারতের নাগরিক হিসেবে অথবা বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত সীমান্ত চুক্তি বিল পাশ হওয়ার পর এক নতুন জীবনে প্রবেশ করেছে ছিটমহলের বাসিন্দারা। ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সাথে থাকায়, ছিটমহলের বেশিরভাগ বাসিন্দা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে থাকতে চান। এখন তারা অপেক্ষা করছেন দেশটির নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার। আবার ছিটমহলের অনেক বাসিন্দা ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে চলে যেতে চান, চলছে তাদেরও প্রস্তুতি।
শেয়ার করুন