ভারতেরও বাংলাদেশের কাছে চির ঋণী থাকা উচিত!
ড. মতিউর রহমান
পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, জাতি হিসেবে এটা আমাদের
জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। পৃথিবীর অনেক জাতিই স্বাধীনতার জন্য বছরের পর বছর ধরে সশস্ত্র
যুদ্ধ করছে, কিন্তু খুব কম জাতিই যুদ্ধ জয় করে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার গৌরব অর্জন করতে পেরেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত কেন ‘৭১ এ আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহায্য করেছিলো? এটা মুক্তিকামী বাঙালি
জনগোষ্ঠিকে সমর্থনের জন্য না কী অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল? এই প্রশ্নটির উত্তর যেকোন সাধারণ
জ্ঞানের অধিকারী বাংলাদেশির কাছেই অত্যন্ত সহজ। এতটাই সহজ যে, সংস্কৃতে যাকে বলা হয়
“জলবৎ তরলং” (পানির মতো তরল বা সহজ)। কিন্তু ভারতের প্রতি গদগদ বাংলাদেশের একটি
বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের দাস-মনোবৃত্তির লোকেরা এ’টি বুঝতে চায় না। কেন ভারত আমাদের
পক্ষ নিয়ে ‘৭১ এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলো? সহজ ও ১০০ শতভাগ ঐতিহাসিকভাবে
সত্য উত্তর হচ্ছে, ভারত চেয়েছিলো তার আজন্ম-শত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে দুর্বল করতে,
পকিস্তানের পূর্বাঞ্চল (বর্তমান বাংলাদেশ) এর সাথে ভারতের সুদীর্ঘ সীমান্তকে শত্রুমুক্ত করতে।
পাকিস্তানীদের অন্যায়-অত্যাচার আর অগণতান্ত্রিকতায় অতিষ্ঠ হয়ে আমরাই স্বাধীনতা ঘোষণা করে
ভারতকে এই সুযোগ করে দিয়েছিলাম। আমরাই ‘৭১ এ পাকিস্তানের গলায় ছুরি বসিয়ে দিয়ে
ভারতকে বলেছিলাম “একটু ঠেলা দাও”, আর ভারত মহা আনন্দে তাই করলো। ব্যস, খতম
পাকিস্তান! ভারতের আজন্ম-শত্রু পাকিস্তানের শরীর দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলো।
এতে ভারতের লাভ হলো অপরিসীম।
১. পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল (বর্তমান বাংলাদেশ) এর সাথে ভারতের প্রায় ৪,৫০০ কিলোমিটারের
স্থল-সীমান্ত রাতারাতি শত্রুমুক্ত হয়ে গেলো। বঙ্গোপসাগর এলাকা তাদের জন্য শত্রুমুক্ত হলো। এটা
যে কতবড় একটা স্বস্তি তা একমাত্র সদা শত্রু-বেষ্টিত রাষ্ট্র (যেমন, ইসরাইল/প্যালেস্টাইন,
ইউক্রেইন/রাশিয়া, ইত্যাদি) হাড়ে হাড়ে টের পায়। ফলে, ভারতের এই বর্ডার রক্ষার জন্য তাদের
সামরিক খরচ আগের চেয়ে বছরে হাজার হাজার কোটি রূপি কমে গেলো যা, তা’রা এখন ব্যয়
করতে পারছে চীনের সাথে তাদের অন্য সীমান্তকে সুদৃঢ় করার জন্য, কিংবা তাদের রাষ্ট্রের
উন্নয়নমূলক কাজের জন্য।
২. ভারত বাংলাদেশের ১৬ কোটি লোকের একটা বিশাল বাজার পেয়ে গেলো অনায়াসে। এতে ভারত
বছরে লাখ লাখ কোটি রূপির মুনাফা পেয়ে যাচ্ছে, চাঙ্গা হচ্ছে তার অর্থনীতি। বাংলাদেশ এখন ভারতে
বৈদেশিক মূদ্রা প্রেরণকারী একটি শীর্ষ দেশ। ভারত তার নিজের স্বার্থেই ‘৭১ এ আমাদের হয়ে
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলো, শুধু আমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দেবার জন্য নয়।
৩. বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা আদায় করে ভারত দ্রুত ও সহজ যোগাযোগের মাধ্যমে
তার সশস্ত্র সংগ্রামরত পূর্বাঞ্চলীয় ‘সেভেন সিস্টার’ রাজ্যগুলোকে ভালভাবেই ম্যানেজ করতে পারবে।
কিন্তু যা’রা মনে করেন যে, শুধু আমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দেবার জন্য ভারত উতলা হয়ে
পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করেছিলো, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে দেখা যেতে পারে, পৃথিবীতে তো বহু
দেশইতো স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে কিংবা এখনো করছে, কিংবা গৃহযুদ্ধের মধ্যে আছে, তাদেরকে
সাহায্য করার জন্য ভারত উতলা হয়ে ওঠে না কেনো, ওদের হয়ে ভারত যুদ্ধ ঘোষণা দেয় না
কেনো? ভারতের নিজ দেশের অনেক জাতি-গোষ্ঠিইতো দীর্ঘদিন যাবৎ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে।
ভারত কি ‘সেভেন সিস্টার’রাজ্যগুলোর স্বাধীনতার দাবি মেনে নিয়েছে? জাতিসংঘ প্রস্তাব অনুযায়ী
কাশ্মীরের জনগনের আত্ননিয়ন্ত্রণের দাবি যাচাইয়ে গণভোটে সম্মতি দিয়েও কি ভারত গণভোট
অনুষ্ঠান করেছে? ভারতীয় দখলদারিত্বের প্রতিবাদে ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর জ্বলছে ৬৮ বছর ধরে।
উপ-মহাদেশের সব অশান্তির মূলে যে কাশ্মীরীদের আত্ননিয়ন্ত্রণের দাবি, সেটাকে কি ভারত সমাধান
করেছ না কেন?
এই উপমহাদেশ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হবার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের
শত্রু। তা’রা একাধিক বার পরস্পরের বিরুদ্ধে সর্বগ্রাসী যুদ্ধও করেছে। কিন্তু কেহ কা’রে হারাতে নাহি
পারে, সমানে সমান। তবুও ভারত সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, কিভাবে পাকিস্তানকে ঘায়েল
করা যায়। একেবারেই সাপে-নেউলে সম্পর্ক উভয়ের মধ্যে। আমরা যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করি,
তখন ভারত দেখলো এই তাদের জন্য একটা মহা ‘মওকা’। শত্রু পাকিস্তানকে ভেঙে দেবার সেই
‘মওকা’ আমরাই ভারতের হাতে তুলে দিয়েছি। সেজন্য ভারতেরই আমাদের কাছে চির ঋণী থাকা
উচিত। আমাদেরকে স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তা দিয়েছে, তাই আমরাও ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এই
কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা উচিত উভয় পক্ষ থেকেই, কেবল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি নয়।
উভয়েরই এতে চিরস্থায়ী লাভ হয়েছে। তাই একশ্রেনীর ভারত-প্রেমী বাংলাদেশীদেরকে স্মরণ করিয়ে
দিতে চাই- আত্মমর্যাদা নিয়ে চিন্তা করতে শিখুন, নিজ রাষ্ট্রকে হেয় করবেন না, স্বীকার করুন
ভারতকেও চির ঋণী থাকা উচিত বাংলাদেশের কাছে।
বাংলাদেশের স্বার্থ – কংগ্রেস ভার্সাস বিজেপি
মোদির আগে ১৯৯৬ সালে দেব গৌড়া এবং তারও আগে ১৯৭৭ সালে জনতা দলের নেতা
মোরারজি দেশাই যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন দুই দফা বাংলাদেশের সাথে গঙ্গার পানি
বন্টন চুক্তি হয়। এখন স্থল সীমানা চুক্তির (এলবিএ) সময়ও বিজেপি ক্ষমতায়। দেখা যাচ্ছে, কংগ্রেস
যখন ক্ষমতায় থাকে তখন ভারত সরকার আমাদেরকে শুধুই মূলা দেখায়, আর যা কিছু করার তা
অ-কংগ্রেসী সরকারই করে থাকে। তারপরেও কংগ্রেসের প্রতি আওয়ামী লীগের এই অন্ধ লেজুড়বৃত্তি
প্রশ্ন জাগায়!
কেউ যদি যুক্তি দেখাতে চান যে, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারতের কংগ্রেস সরকার মুক্তিযুদ্ধে
আমাদের সমর্থণ দিয়েছে এবং ‘৭১ এ পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে
সাহায্য করেছে। তার উত্তরে শুধু একটাই কথা – ঐ সময় ভারতের যে দলই ক্ষমতায় থাকতো
তারাই এটাই করতো। কারণ পাকিস্তানের আজন্ম-শত্রু ভারত এটা তাদের জাতীয় স্বার্থেই করতো।
পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার মওকা ভারতের যে কোন সরকারই সেই সুযোগ অবশ্যই নিত। যেমন
করে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রধান প্রতিদ্বন্দী সোভিয়েট ইউনিয়নকে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে মদদ
দিয়েছিলো।
দেখা যাক, ‘বিগ ব্রাদার’ থেকে ‘বড় ভাই’ এর দাবিদার এবার ভারতের বিজেপি সরকার বাংলাদেশের
ন্যায্য দাবি পূরণে এবং ন্যায্য অধিকার প্রদানে কতটা আন্তরিক!
মক্কেল নিয়ে টানাটানি!
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকার এমন
লজ্জাস্করভাবে মোদি বন্দনা করতে শুরু করেছে যা দেখলে মনে হয় – আসছে বুঝি এক মহারাজা
তার পৈত্রিক কলোনীতে নিজের উৎসব করতে…।আর সবকূল হারানো বিএনপি চাচ্ছে কিভাবে
মোদির একটু সান্নিধ্য পাওয়া যায়। ভারতকে বাংলাদেশের সবকিছু দিয়ে তুষ্ট করার জন্য যে রকম
ন্যাক্যারজনক এবং অশ্লীল প্রতিযোগিতা হয়েছে তা দেখে মনে হয়, যেন এক মক্কেলকে নিয়ে দুই
পক্ষের টানাটানি। এর মধ্যে বিএনপিরটা একেবারেই মাত্রাতিরিক্ত! মনে হয় মোদি তাদেরকে ক্ষমতায়
বসিয়ে দেবে! (সরি, এর চেয়ে ভাল উপমা এই মুহূর্তে পেলাম না!)কিন্ত মোদির বক্তৃতায় ও বক্তব্যে
যা বোঝা গেল, ভারতের জাতীয় স্বার্থে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগই মোদির কাছে এগিয়ে!
ড. মতিউর রহমান: অধ্যাপক, অস্টিন কমিউনিটি কলেজ, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র।
শেয়ার করুন