বাংলাদেশে রাজস্ব বিভাগে চাকরি হলেই কোটিপতি!
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের
(ডিএনসিসি) রেভিনিউ সুপারভাইজার মো. আব্দুল খালেক
দীর্ঘ সময় গুলশান সার্কেলে
কর আদায়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন
করেছেন। বর্তমানে
তিনি মিরপুর অঞ্চল-২-এ কর্মরত। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী
হলেও আব্দুল খালেক ইতিমধ্যে
ঢাকায় তিনটি বাড়ি, দুটি
গাড়িসহ কোটি টাকার ব্যাংক
ব্যালান্সের মালিক হয়েছেন; যদিও
তিনি মাসে বেতন পান
১৮ হাজার টাকা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের
(ডিএসসিসি) বাজার শাখা-৩-এর কর কর্মকর্তা
(চলতি দায়িত্বে) আলীম আল রাজির
মাসিক বেতন ২২ হাজার
টাকা। অথচ
মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় তিনি
একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং সাভারে ১০
কাঠা জমি কিনেছেন। অফিসে যাওয়া-আসা
করেন টয়োটা এলিয়ন গাড়িতে
চড়ে। ব্যাংকেও
রয়েছে কোটি টাকা। আবার ডিএসসিসির কর
কর্মকর্তা (অঞ্চল-১) মো.
শাহজাহান আলী নিজের দায়িত্বের
বাইরে করপোরেশনের সহকারী সচিব (সংস্থাপন-১) ও কর
কর্মকর্তার (বাজার শাখা-২)
দায়িত্ব তাঁর কবজায় রেখেছেন। গুরুত্বপূর্ণ
তিনটি পদে থেকে এ
কর্মকর্তাও হয়েছেন কোটি কোটি
টাকার মালিক। তাঁর মাসিক বেতন ২৫
হাজার টাকা।
শুধু এই তিনজন নন,
দুই করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগে এমন
অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যাঁরা চাকরি নিয়ে
কোটিপতির খাতায় নাম লিখিয়েছেন। অবৈধ
সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়ায় সম্প্রতি
আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন
কমিশন (দুদক)। তদন্তকাজ
শুরু করেছে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক
দুর্নীতি তদন্ত টিম। উত্তর ও দক্ষিণ
সিটি করপোরেশনের আয়ের বেশির ভাগ
আসে রাজস্ব বিভাগ মাধ্যমে। এ
বিভাগ করপোরেশনের রাজস্ব আদায় ও
আরোপ, নতুন হোল্ডিং নম্বর
ইস্যু, নিজস্ব সম্পত্তি থেকে
রাজস্ব আদায়, ট্রেড লাইসেন্স
ইস্যু ও নবায়ন, রিকশা-ভ্যানের লাইসেন্স ইস্যু, মার্কেট বরাদ্দ
ও দোকান থেকে রাজস্ব
আদায়, প্রমোদ কর আদায়
ও সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু
অভিযোগ রয়েছে, রাজস্ব আদায়ের
প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চরম অনিয়ম আর
দুর্নীতি করেন। বহুতল ভবনের আয়তন গোপন
করে বর্গফুট কম দেখানো, প্রকৃত
সময় উল্লেখ না করা,
বরাদ্দহীন শত শত দোকান
থেকে মাসোয়ারা নেওয়া, এলাকাভিত্তিক বর্গফুট
মূল্য গোপন করা এবং
শতাধিক বহুতল বাণিজ্যিক ভবনকে
আবাসিক হিসেবে দেখানোর মতো
কাজ করা হচ্ছে। এভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
শত শত কোটি টাকা
নিজের পকেটে নিয়ে করপোরেশনকে
পঙ্গু করে দিচ্ছে। ফলে কয়েক বছর
আগের স্বয়ংসম্পূর্ণ সিটি করপোরেশন এখন
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমশিম
খাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই
করপোরেশনের অধীনে প্রায় ১০
লাখ হোল্ডিং রয়েছে। কিন্তু ডিএসসিসিতে দাপ্তরিকভাবে এক লাখ ৪৩
হাজার ও ডিএনসিসিতে এক
লাখ ৬০ হাজার হোল্ডিং
আছে। প্রায়
২০ বছরের আগে নির্ধারণ
করা হারেই এসব হোল্ডিংয়ের
ওপর ট্যাক্স আদায় করা হচ্ছে। ওই
ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়েছিল কর
কর্মকর্তাদের সুপারিশেই। পরে
তা অনুমোদন দেয় কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিন ঘুরে হোল্ডিং ট্যাক্স
নির্ধারণের কথা থাকলেও কর
কর্মকর্তারা বাস্তবের তুলনায় অর্ধেক হারেও
কর নির্ধারণ করেননি। এর মাধ্যমে মূলত শুরু থেকেই
রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা কৌশলে একটি অনিয়মের
সুযোগ করে রেখেছেন। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তিরা নামকরা হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,
শপিং মল, বহুতলবিশিষ্ট বাণিজ্যিক
ভবনের বিপুল পরিমাণ হোল্ডিং
ট্যাক্স কৌশলে ফাঁকি দিয়ে
নিজেরা কোটিপতি হচ্ছেন। মাঝেমধ্যে
এসব ঘটনা ধরা পড়লেও
তেমন শাস্তি হয় না।
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, আব্দুল
খালেক মিরপুরে বদলি হওয়ার আগে
ডিএনসিসির গুলশানের আঞ্চলিক কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তাঁর ছয়তলাবিশিষ্ট দুটি,
পাঁচতলাবিশিষ্ট একটি বাড়ি এবং
দুটি গাড়ি রয়েছে। তিনটি বাড়িই করেছেন
নিজের নামে। উত্তর বাড্ডার মিস্ত্রিটোলা এলাকায় নজর মাহমুদ
রোডে তাঁর ছয়তলা বাড়ি
দুটির নম্বর হলো শ-৯৩/১ ও
শ-১১০। উত্তর বাড্ডা সাঁতারকুল রোডে
আলীর মোড়ে পাঁচতলা বাড়িটির
নম্বর ২৮৭। তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নম্বর ঢাকা
মেট্রো-গ-২৭-৯৩১৯,
পারিবারিক গাড়ি নম্বর ঢাকা
মেট্রো-গ-৩১-০২৪৬। পারিবারিক
গাড়িটির নিবন্ধন তাঁর স্ত্রীর নামে। যদিও
তাঁর স্ত্রী কোনো চাকরি
বা ব্যবসা করেন না। বাড়ি-গাড়ির বাইরেও ডিএনসিসির
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আব্দুল খালেকের নিজের
ও পরিবারের সদস্যদের নামে ব্যাংকে কোটি
টাকা আছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আব্দুল
খালেকের মতো ডিএনসিসির রাজস্ব
বিভাগে কর্মরত বেশির ভাগ
কর্মকর্তা-কর্মচারীরই ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি
ও ব্যাংকে বিপুল অর্থ রয়েছে। তাঁদের
মধ্যে রয়েছেন কর কর্মকর্তা
(গুলশান) লিয়াকত আলী, কর
কর্মকর্তা (অঞ্চল-১) মো.
নাসির উদ্দিন, উপকর কর্মকর্তা (অঞ্চল-৩) আলী আকবর,
উপকর কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান হেলাল, উপকর কর্মকর্তা
(অঞ্চল-৪) হেদায়েত উল্লাহ
ও রেভিনিউ সুপারভাইজার (অঞ্চল-৪) মো.
মাসুদুর রহমান। একজন উপকর কর্মকর্তার মাসিক
বেতন ২২ হাজার টাকা।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে
রেভিনিউ সুপারভাইজার আব্দুল খালেকের ব্যক্তিগত
মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন
করলেও তিনি ওপাশ থেকে
কোনো সাড়া দেননি। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মোবাইলে
এসএমএস পাঠানো হলেও জবাব
আসেনি।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, উপকর
কর্মকর্তা আলীম আল রাজি
রাজস্ব বাজার শাখা-৩-এর কর কর্মকর্তা
হিসেবে চলতি দায়িত্বে রয়েছেন। রাজধানীর
মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় তাঁর
নিজের নামে একটি বিলাসবহুল
ফ্ল্যাট ও সাভারে ১০
কাঠা জমি রয়েছে। নতুন গাড়ি কিনেছেন,
ব্যাংকেও জমা রয়েছে বিপুল
অর্থ। গত
সোমবার যোগাযোগ
করা হলে নিজের এসব
সম্পদের কথা স্বীকারও করেন
তিনি। তবে
তাঁর দাবি, ফ্ল্যাট, গাড়িসহ
সব কিছু বেতনের টাকায়
করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার
শর্তে ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা জানান,
সম্প্রতি করের ১২ লাখ
টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। বঙ্গবাজার
হকার্স মার্কেট, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, শেরে
বাংলা মালেক শাহ হকার্স
মার্কেট (মুরগিপট্টি), শ্যামবাজার কাঁচাবাজার থেকে যে কর
আদায় করা হয়েছে তা
কর্তৃপক্ষ বরাবর জমা দেওয়া
হয়নি। এলাকাটি
পড়েছে আলীম আল রাজির
আওতায়। গত
৩০ জুন টাকা জমা
দেওয়ার সময় পার হয়ে
যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট দপ্তরে
এ নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন
শুরু হয়েছে। আলীম আল রাজির সঙ্গে
সহযোগী হিসেবে অর্থ আত্মসাতের
সঙ্গে রেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট (সংগ্রহকারী)
আজমত উল্লাহ শরীফ জড়িত
রয়েছেন।
তবে আলীম আল রাজি
বলেন,
'আমরা রাজস্ব যা সংগ্রহ
করি তা সাথে সাথে
জমা দিয়ে দেই। আর আমার বাড়ি-গাড়ি যা আছে
সবই বেতনের টাকায় বৈধ
উপায়ে ক্রয় করা হয়েছে।' আপনার
মাসিক বেতন তো ২২
হাজার টাকা, তাহলে বেতনের
টাকায় এত সম্পদ কিভাবে
করা সম্ভব? এ প্রশ্নের
জবাবে আলীম আল রাজি
বলেন, 'আমি চাকরি করছি
১৮ বছর ধরে। বেতন থেকে টাকা
জমিয়ে এসব করেছি।' বেতনের টাকা দিয়ে
আদৌ সম্ভব কি না-
জানতে চাইলে তিনি বলেন,
'অসম্ভবের কিছু নাই।'
ডিএসসিসির আরেক কোটিপতি কর্মকর্তা
মো. শাহজাহান আলী। বাড়ি-গাড়ির পাশাপাশি তাঁরও
ব্যাংকে অঢেল অর্থ রয়েছে। কর
কর্মকর্তার পাশাপাশি সংস্থাপন-১ শাখার সহকারী
সচিব ও অঞ্চল-১-এর কর কর্মকর্তার
পদও তাঁর দখলে। তিনি নিজেকে ডিএসসিসির
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনছার আলী
খানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলে
পরিচয় দেন। তবে এ ব্যাপারে আনছার
আলী খান বলেন, 'শাহজাহান
আলী নামে নগর ভবনে
আমার কোনো আত্মীয় নেই। কেউ
যদি পরিচয় দেয় তবে
তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার।' কিন্তু
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন,
'দুর্নীতিবাজ শাহজাহান আলীকে আনছার আলী
খান সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে উপকর কর্মকর্তা থেকে
কর কর্মকর্মতা পদে পদোন্নতি দিয়েছেন। আবার
একই কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ আরো দুটি পদের
অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছেন। এ বড় কাজ আত্মীয়
বলেই শাহজাহান আলীর পক্ষে সম্ভব
হয়েছে।'
তবে ডিএসসিসির কর কর্মকর্তা (অঞ্চল-১) শাহজাহান আলী
বলেন, 'আমি একসাথে কখনো
তিনটি দায়িত্বে ছিলাম না। এখন দুটি দায়িত্বে
আছি।'
সম্প্রতি কামরাঙ্গীরচর এলাকার ৩৫/২
কালুনগর হোল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে একটি অভিযোগ পায়
ডিএসসিসি। পরে
ঘটনার সঙ্গে জড়িত কর
কর্মকর্তা আবুল খায়ের ও
উপকর কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনকে তাৎক্ষণিকভাবে
ওএসডি করা হয়। করপোরেশনের তদন্ত কমিটি-সংশ্লিষ্ট
সূত্র জানায়, ৯ হাজার
বর্গফুট আয়তনের একটি হোল্ডিংকে
এক হাজার ৫০০ বর্গফুট
দেখিয়ে প্রতিবছর প্রায় চার লাখ
টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছেন
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আবার
ভবনটি অনেক আগে নির্মিত
হলেও সেই তথ্য গোপন
করা হয়েছে।
জানা যায়, রাজস্ব আয়
বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছে
ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি।
দুই করপোরেশনে 'ডোর টু ডোর'
হোল্ডিং নম্বর প্লেট স্থাপন
কার্যক্রম শুরুও হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রেও
উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ।
সূত্র জানায়, ডিএসসিসিতে হোল্ডিং
নম্বর প্লেট স্থাপনের কাজ
বাস্তবায়নকারী কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা
ইতিমধ্যে ৪০ হাজার গ্রাহকের
প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩৬৭
টাকা করে প্রায় দেড়
কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সেই
টাকা জমা দেওয়ার কথা
ছিল করপোরেশনে। কিন্তু
অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তারা টাকা নিয়ে
সটকে পড়েছে। ডিএনসিসির
পক্ষ থেকে হোল্ডিং জরিপ
ও নম্বর প্লেট স্থাপনের
জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রত্যাশা সমাজ উন্নয়ন সংঘ,
সুসমাজ ফাউন্ডেশন, রেডি ও ডিজিটালটেক
নামের সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্প থেকেও
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিপুল পরিমাণ অর্থ
হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ
পাওয়া যায়।
রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে
উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান
নির্বাহী বি এন এনামুল
হক বলেন, 'রাজস্ব বিভাগের
অনেক কর্মকর্তাই কোটিপতি, এমন তথ্য আমার
কানেও আসে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না পাওয়ায়
তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না।'
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য
নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড.
বদিউল আলম মজুমদার বলেন,
'সিটি করপোরেশন যে দুর্নীতির আখড়া
তা বলার অপেক্ষা রাখে
না। যেখানে
করপোরেশন ঋণগ্রস্ত, দুর্বল হয়ে পড়ছে
সেখানে কর্মকর্মতা-কর্মচারীরা কোটিপতি হচ্ছে। তবে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা
যদি অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ
করতে চায় তবে তা
অসম্ভব হবে না। আমাদের দুই করপোরেশনের
মেয়রদের ব্যাপারে আমাদের আস্থা রয়েছে,
তাঁরা দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরবেন। অন্যথায়
করপোরেশনের ঋণের বোঝা আরো
বাড়তে থাকবে।'
শেয়ার করুন