ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে এমপিপুত্র রনি
এম পি পিনু ও তার খুনি ছেলে
নিউ ইস্কাটনে জোড়া খুনের মামলায় সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনিকে একমাত্র আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। অভিযোগপত্রের ভাষ্যমতে, রনি সজ্ঞানে, ঠাণ্ডা মাথায় দু’ব্যক্তিকে খুন করেন। এ কাজে তিনি নিজের পিস্তল ব্যবহার করেছেন। সঙ্গে ছিল তিন বন্ধু। গুলি করার সময় তার মুখে ছিল জ্বলন্ত সিগারেট। ঘটনার রাতে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আলাদা স্থানে দু’দফা মদ পান করেন। রনি মদ ও বিয়ারের বিল পরিশোধ করেন সাড়ে ৯ হাজার টাকা। খুনের পর রাতে তিন বন্ধুকে তাদের বাসায় নামিয়ে দেন ওই এমপিপুত্র।
এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই দীপক কুমার দাস যুগান্তরকে বলেন, তিনি মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার মহানগর হাকিম আমিনুল হকের আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘এমপিপুত্র রনির গুলিতে নিউ ইস্কাটনে দু’জন নিরীহ ব্যক্তি মারা যান। তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগও প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।’
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ১৪ এপ্রিল রাত দেড়টার পর রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে জনকণ্ঠ ভবনের উল্টো দিকে ২২৪/১ নিউ ইস্কাটনে ট্রপিক্যাল হোমসের নির্মাণাধীন এলএমজি টাওয়ারের সামনে রাস্তার দক্ষিণ পাশ বন্ধ ছিল। রাস্তার একপাশ দিয়ে গাড়ি চলাচল করায় গভীর রাতেও যানজটের সৃষ্টি হয়। এমপিপুত্র রনির গাড়িও সেই যানজটে ৪-৫ মিনিট আটকে ছিল। তখন ড্রাইভারের বাম পাশের সিটে বসে ছিলেন রনি। তিনি গাড়ির জানালা খুলে ধূমপান করছিলেন। হঠাৎ গাড়ির বক্সে রাখা পিস্তল দিয়ে জ্যাম লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ৪-৫ রাউন্ড গুলি করেন। গুলির শব্দে তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেলে গাড়ি নিয়ে চলে যান রনি। তার ছোড়া গুলিতে রিকশাচালক হাকিম ১৫ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ভিকটিম সিএনজিচালক ইয়াকুব আলী শেখ ২৩ এপ্রিল মারা যান। গুলির পর পেছনের সিট থেকে এক বন্ধু প্রায় চিৎকার দিয়ে রনিকে প্রশ্ন করেন তিনি কী করছেন। এ সময় রনি তার বন্ধুকে ধমক দিয়ে চুপ থাকার নির্দেশ দেন বলে মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার অপর আসামি রনির গাড়িচালক ইমরান ফকিরকে হত্যার দায় থেকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এ আবেদন করেন। এ প্রসঙ্গে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আসামি ইমরান ফকিরের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগ প্রমাণ করার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এজন্য তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন করা হয়েছে। একই সঙ্গে আসামি হিসেবে ইমরানের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি সাক্ষীর জবানবন্দি হিসেবে গণ্যের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেন।
অভিযোগপত্রটি জমা দেয়ার পর এটি দেখিলাম মর্মে সত্যায়িত করেন আদালত। ১৩ আগস্ট এর গ্রহণযোগ্যতার শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে ৩৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
খুনের অভিযোগে ৩১ মে রনিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলার একমাত্র আসামি রনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। তিন দফায় মোট ১১ দিন রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। গাড়িচালক ইমরান ফকিরও কারাগারে আছেন। সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলের গুলিতে দু’জন নিরীহ ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় রমনা থানায় মামলা করেন নিহত রিকশাচালক হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম। আলোচিত এ হত্যা মামলাটি তদন্ত করেন ডিবির এসআই দীপক কুমার।
যেভাবে দুই নিরীহ ব্যক্তিকে খুন করেন এমপিপুত্র : তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, ‘আমার তদন্তকালে জানা যায় যে, ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসামি বখতিয়ার আলম রনি ১৩ এপ্রিল রাত ২১টা ৩০ মিনিটে ‘শেল-বারে’ এসে স্কাই-রোজ বিল্ডার্সের মালিক কামাল মাহমুদকে ফোন করে আসতে বলে। ফোন পেয়ে কামাল মাহমুদ রাত ২২.০০টার সময় উপস্থিত হলে তারা ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলে। কথা বলার একপর্যায়ে কামাল মাহমুদ তাদের বন্ধু জাহাঙ্গীর আলম এবং টাইগার কামালকে ফোন করে কথা বলে এবং বখতিয়ার আলম রনির সঙ্গেও তারা কথা বলে। রাত ২২টা ৩০ মিনিটের সময় জাহাঙ্গীর আলম ও টাইগার কামালও ‘শেল-বারে’ আসে। তখন রনি, জাহাঙ্গীর ও টাইগারসহ তিনজন মিলে মদ পান করে।’
অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, “মদ্যপান শেষে রাত ২৩টা ৩০ মিনিটের দিকে ‘শেল-বার’ বন্ধ হয়ে গেলে আসামি বখতিয়ার আলম রনি জাহাঙ্গীর আলমকে বলে, ‘জাহাঙ্গীর আমি তোমার কাছে কখনও কিছু খাইতে চাই নাই। আজকে তুমি আমাকে হোটেল সোনারগাঁওতে মদ খাওয়াও। তারপর ১৪ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টার সময় আসামি রনির ব্যবহৃত প্রাডো কালো রংয়ের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৬২৩৯) করে আসামি বখতিয়ার আলম রনি, কামাল মাহমুদ, জাহাঙ্গীর ও টাইগার কামাল হোটেল সোনারগাঁওয়ে যায়। সেখানে আসামি রনি, মাহমুদ, জাহাঙ্গীর ও টাইগার কামালরা ৯ হাজার ৫০০ টাকার মদ ও বিয়ার পান করে। আসামি বখতিয়ার আলম রনি তার ক্রেডিট কার্ড ভাঙিয়ে হোটেল সোনারগাঁওয়ে মদ ও বিয়ারের বিল পরিশোধ করে রাত ১টা ৩০ মিনিটের সময়।”
গভীর রাতে হোটেল সোনারগাঁও থেকে বের হওয়ার পর সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলে যা করেছেন তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে অভিযোগপত্রে। ওই রাতের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে রনির তিন বন্ধু জাহাঙ্গীর, টাইগার কামাল ও কামাল মাহমুদ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন। পাশাপাশি রনির গাড়িচালক ইমরান ফকিরের ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতেও ফুটে উঠেছে, রনি কীভাবে গুলি করে নিরীহ দু’জন ব্যক্তিকে খুন করে বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, জবানবন্দিতে কামাল মাহমুদ উল্লেখ করেন, যখন রনি গুলি করে তখন তিনি স্বাভাবিক ছিলেন। কেন গুলি করলেন এমন প্রশ্ন করলে কামালকে ধমক দেন রনি।
অভিযোগপত্রে এসআই দীপক উল্লেখ করেছেন, বিল পরিশোধের পর রাত ১টা ৩০ মিনিটের দিকে হোটেল সোনারগাঁও থেকে বের হন এমপিপুত্র রনি। তার প্রাডো গাড়িতে কামাল মাহমুদ, জাহাঙ্গীর আলম ও টাইগার কামালকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য রওনা দেন। প্রথমে বাংলামোটর হয়ে মগবাজারের ডাক্তার গলির গ্র্যান্ড প্লাজার সামনে জাহাঙ্গীর আলমকে নামিয়ে দেন। এরপর গাড়ি ফের বাংলামোটর যাওয়ার পথে জনকণ্ঠ ভবনের সামনে জ্যামে পড়ে রনির গাড়ি। জ্যাম লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ৪-৫ রাউন্ড গুলি করেন। এতেই দু’জন মারা যান।
খুন করার পর কীভাবে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন এমপিপুত্র রনি এ ব্যাপারে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘গুলি করে গাড়ি নিয়ে আসামি রনি ঘটনাস্থলের পাশে ৪/এ ইস্কাটন প্লাজায় কামাল মাহমুদকে নামিয়ে দেয়। এরপর হাতিরপুলের টাইগার কামালকেও তার বাসায় পৌঁছে দেয় রনি। এরপর বখতিয়ার আলম রনি গাড়ি নিয়ে তার ধানমণ্ডির বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।’
রনির বিরুদ্ধে জোড়া খুনের অভিযোগ প্রমাণিত : সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলের বিরুদ্ধে জোড়া খুনের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির এসআই দীপক। অভিযোগপত্রে তিনি বলেছেন, ‘হত্যায় ব্যবহৃত রনির পিস্তল ও তাজা গুলি জব্দ করি। জব্দকৃত পিস্তল বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মতামত প্রদানের জন্য সিআইডিতে পাঠাই এবং মতামত সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করি। আর মামলার ঘটনাসংক্রান্ত জ্ঞাত প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে তাদের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করি। রনির নামে লাইসেন্সকৃত সব পিস্তল ও শটগানের লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করি। মামলার তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, সাক্ষীদের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি, বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং ময়নাতদন্ত রিপোর্টের আলোকে আসামি বখতিয়ার আলম রনির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’
আলামত ১৫টি : জোড়া খুনের মামলার অভিযোগপত্রে ১৫টি আলামত জব্দ দেখানো হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম নিহত রিকশাচালক হাকিমের নীল রংয়ের চেক লুঙ্গি, এক টুকরা রক্তমিশ্রিত গুলির অংশ, নিহত সিএনজিচালক ইয়াকুব আলীর চেক লুঙ্গি, একটি কালো ও সিলভার রংয়ের বিদেশী পিস্তল, একটি কালো রংয়ের পিস্তলের ম্যাগাজিন, ২১টি তাজা গুলিসহ ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ আলামত। এছাড়াও অভিযোগপত্রে রনিসহ উল্লিখিত চার বন্ধুর মোবাইলের কললিস্ট জব্দ তালিকা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
শেয়ার করুন