কথিত মুক্তমনাদের ব্লগ ছাড়ার হিড়িক
নিলয় খুন হওয়ার পর অনলাইনে লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছেন অসংখ্য মুক্তমনা লেখক। তাদের কেউ কেউ ঘোষণা দিয়ে বস্নগ ছাড়লেও অনেকেই আবার সরে গেছেন নীরবে। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের অনেকেই তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ব্যক্তিগত প্রোফাইল ও ছবি মুছে ফেলছেন ।
অভিজিৎ রায় খুনের প্রতিবাদে অনলাইনে ঝড় তোলা বস্নগার রাহাত হাসান গত বুধবার আকস্মিক তার বস্নগ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। মুছে ফেলেছেন নিজের ফেসবুকও। শুধু তাই নয়, মুক্তমনা এই বস্নগার তার মোবাইল ও ব্যক্তিগত কম্পিউটারের ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।
বস্নগে ঘোষণা দিয়ে নিজের অ্যাকাউন্ট গুটিয়ে নিয়েছেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এমাদুল হক নিরব। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী এ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, আতঙ্কিত অভিভাবকদের চাপে তিনি বস্নগ থেকে সরে যাচ্ছেন। সামহোয়্যার ইন বস্নগের মুক্তমনা বস্নগার গিয়াস উদ্দিন, পাপ্পু বাঙালির অ্যাকাউন্টও ডি-অ্যাকটিভ। তাদের মুঠোফোনও গত কয়েকদিন ধরে বন্ধ রয়েছে।
শুধু রাহাত, নিরব, গিয়াস কিংবা পাপ্পুই নন_ গত ৭ আগস্ট নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয় খুন হওয়ার পর অনলাইনে লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছেন অসংখ্য মুক্তমনা লেখক। তাদের কেউ কেউ ঘোষণা দিয়ে বস্নগ ছাড়লেও অনেকেই আবার সরে গেছেন নীরবে। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের অনেকেই তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পারসোনাল প্রোফাইল ও ছবি মুছে ফেলছেন। পাল্টেছেন বাসাবাড়ি, মুঠোফোন নাম্বার, এমনকি কর্মস্থলও। পুরনো অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়ে নতুন নামে বস্নগে লিখতে শুরু করা বস্নগারদের তালিকাও এখন দীর্ঘ।
তবে মুক্তমনা বস্নগারদের প্রায় কেউই তাদের আকস্মিক প্রস্থান প্রসঙ্গে খোলাখুলি কোনো কথা বলতে চাননি। এমনকি তাদের সরে যাওয়ার বিষয়টিও গোপন রাখতে চাইছেন অনেকেই। ফলে আতঙ্ক আর লুকোচুরির খেলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠা 'বস্নগ সংস্কৃতিতে' বড় ধরনের ধস নেমেছে।
অনলাইনে সক্রিয় থাকা বস্নগারদের অভিযোগ, একের পর এক বস্নগার হত্যা এবং খুনিদের নানামুখী হুমকি-ধমকিতে মুক্তমনা লেখকরা বছর দুয়েক ধরে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এর ওপর বস্নগারদের 'সীমালংঘন' না করতে আইজিপির পরামর্শ এবং ফেসবুক ও বস্নগে ধর্ম অবমাননা করে লিখলে গ্রেপ্তারের যে হুশিয়ারি দিয়েছে সরকার তাতে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।
তাদের ভাষ্য, বস্নগার হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার চেয়ে সরকার জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলেই বেশি তৎপর। তাই তাদের নিরাপত্তা এখন আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। তবে মুক্তমনা লেখকদের জন্য বর্তমানে যে ভয়ংকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এর খেসারত আগামীতে সরকারকেই দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন মুক্তমনা বস্নগাররা।
এদিকে ডিবিসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, মুক্তমনাদের বস্নগ ছাড়ার হিড়িকের তথ্যটি সঠিক নয়। তবে তাদের নজরদারির কারণে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে উস্কানিমূলক লেখালেখি অনেকটা কমেছে। এতে মুক্তমনা বস্নগার ও মৌলবাদীদের মধ্যকার উত্তপ্ত সম্পর্ক ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। মুক্তমনা বস্নগাররা ধর্মীয় আইডলোজি নিয়ে অসংযত পোস্ট দেয়া বন্ধ করে দিলে ভীতিকর পরিস্থিতির অবসান হবে বলে মন্তব্য করেন গোয়েন্দারা।
তবে গোয়েন্দাদের এসব অনুমান পুরোপুরি ভিত্তিহীন ও উদ্ভট বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তমনা বস্নগারদের অনেকেই। তারা জানান, শুধু বস্নগাররাই নন, তাদের পরিবারের অন্য সদস্যরা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন। সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে তাই যে যার মতো করে পথ খুঁজে নিচ্ছেন। রাজধানীর এক এলাকা থেকে বাসা পাল্টে অন্য এলাকায় সরে যাওয়ার পরও মৌলবাদীদের হুমকি অব্যাহত থাকায় বিপুলসংখ্যক বস্নগার গ্রামে চলে গেছেন বলে দাবি করেন তারা।
এদিকে বিশিষ্টজনদের আশঙ্কা, বস্নগার হত্যা নিয়ে নোংরা রাজনীতি বন্ধ না হলে 'বস্নগ সাংস্কৃতি' পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও চরম অবনতি ঘটবে। যে জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে সরকার বিশেষ ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে এ কৌশলই একসময় গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়াবে। বিভিন্ন সময় বস্নগারদের ওপর হামলা হলেও সেগুলোর বিচারের অগ্রগতি না হওয়ার বিষয়টিকেও অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজনরা।
তাদের ভাষ্য, বস্নগাররা দেশের শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠছে। যে কাজগুলো করা প্রয়োজন ছিল শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের; তাদের সুবিধাবাদী চরিত্র, মেরুদ-হীনতার দায় নিজেদের কাঁধে তুলে বস্নগাররা এখন সবার সামনে দাঁড়াচ্ছে। তাই বস্নগাররাই আগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে একপর্যায়ে তা সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়বে।
সুধীজন প্রতিনিধিদের অনেকেই এ পরিস্থিতির জন্য সরকারের পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও সমানভাবে দায়ী করেন। তারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থে মৌলবাদকে তোয়াজ করার কারণে এ ধরনের হামলার ঘটনা একের পর এক ঘটছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, সমাজে বহু মতবাদ ও আদর্শ থাকবে- এটাই সমাজের সৌন্দর্য। এক্ষেত্রে বিশেষ একটি গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া বা তাদের হত্যা করা সমাজের জন্য সুখকর নয়। এটা জঙ্গি রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে এটি কাম্য নয়। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এর মূল্য সবাইকে দিতে হবে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রে বহুত্ববাদের অস্তিত্ব সৃষ্টিকর্তাও পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল জগতে মতপ্রকাশকারী বা বস্নগারদের হত্যার দায় সরকারের ওপর বর্তায়। সরকারকেই তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। পাশাপাশি সামাজিকভাবেও নানা উদ্যোগ নিতে হবে।
অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, বস্নগাররাও একটি 'দর্শন' মেইনটেইন করে। তাদের সেই দর্শনের প্রতি সম্মান দেখানোর দায়িত্ব সবার। কেউ যদি উল্টো সন্ত্রাসী কর্মকা-ের আশ্রয় নেয় তবে তাকে দমনে সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়কে কাজ করতে হবে।
ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ মনে করেন, একের পর এক বস্নগার হত্যা মুক্তবুদ্ধি চর্চার ওপর চরম আঘাত। এটা চলতে থাকলে মুক্তমনাদের সংখ্যা কমে যাবে এবং দেশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
কবি সামাদ আরো মনে করেন, বস্নগারদের ওপর যেভাবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে তাতে সরকারের পক্ষে মোকাবেলা করা বেশ কঠিন। তাই বিষয়টি নিরসনে সরকারের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সামাজিক উদ্যোগ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাধীনচেতার নামে বস্নগারদের ঔদ্ধত্য বন্ধ করতে হবে।
শেয়ার করুন