বাড্ডায় খুনোখুনি নেপথ্যে আট গ্রুপ
জমি দখল, খাল ভরাট, বালুমহাল দখল, মাছের ঘের দখল, ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ঝুট ব্যবসা, কোরবানির হাটের নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে রাজধানীর বাড্ডা এলাকা। এসব অপরাধের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কবজায় রাখছে সরকার দলের সমর্থক সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী। হত্যাসহ অনেক মামলার আসামি এসব নেতাই এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক। তাঁদের পেছনে আছে শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ প্রভাবশালী মহলের মদদ। ক্ষমতার কেন্দ্রের যোগাযোগ বেপরোয়া করে তুলেছে একেকটি গ্রুপকে। একই দলের সমর্থক হলেও স্বার্থের দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষকে হত্যা করতেও তারা পিছপা হয় না। কালের কণ্ঠ'র অনুসন্ধানে বাড্ডা এলাকাজুড়ে অপরাধের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এমন আটটি গ্রুপের তথ্য মিলেছে। এসব গ্রুপের বিরোধেই একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে।
গত এক দশকে বাড্ডায় আধিপত্যের বিরোধে দুই ডজন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যার মধ্যে গত চার মাসেই খুন হয়েছে ৯ জন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার মধ্যবাড্ডার আদর্শনগরে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান গামা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা শামছু মোল্লাসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে নিজ দলের আরেক পক্ষ 'বাউল সুমন গ্রুপ' জড়িত বলে তথ্য মিলেছে। গোয়েন্দা পুলিশ বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ফারুক হোসেন মিলন ও যুবলীগের কর্মী নুর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের জের ধরে মিলনের পরিকল্পনায়ই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, তিন খুনে জড়িত আটজনের নাম জানতে পেরেছে পুলিশ। তদন্তের স্বার্থে অন্য আসামিদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে আসামিদের গ্রেপ্তারে ব্যাপক অভিযান চলছে। তিনি আরো বলেন, 'ক্ষমতার বিরোধও এসব খুনের অন্যতম কারণ। হত্যাকারী কে বা কোন দলের, তা বিবেচনা না করেই আমরা অভিযান পরিচালনা করছি।'
এদিকে স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাড্ডা এলাকায় নিহত গামা ও বাউল সুমনের গ্রুপ ছাড়াও ছয়টি গ্রুপের সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ডালিম-মাহবুব গ্রুপ। আছে বাড্ডা থানা যুবলীগের আহ্বায়ক মো. কাওসার গ্রুপ, বাড্ডা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, জাহাঙ্গীর-আলমগীর গ্রুপ, ফরহাদ গ্রুপ। একসময় বাড্ডায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল যুবলীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলের। ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক মিল্কি হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। এলাকায় না থাকলেও তাঁর গ্রুপের দাপট রয়েছে এখনো। শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের নামেও এখানে চাঁদাবাজি হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি গামার দেওয়া তথ্যে অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হন বাউল সুমন। জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এ ঘটনার পর থেকে আদর্শনগর মোল্লাপাড়ার স্টার গার্মেন্টের ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন গামা। স্বামীর মৃত্যু এবং ব্যবসা হারিয়ে তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সুমনের স্ত্রী আফরোজা আক্তার স্মৃতি। ক্ষিপ্ত হন আওয়ামী লীগ নেতা মিলন, সহযোগী যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর, উজ্জ্বল, বাড্ডা থানা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক জুনায়েদ হোসেন জুয়েল, সোহেল রানা, ছাত্রলীগ নেতা দীপু, বিজয়, মামুন, নয়ন ওরফে ডন ও রনিসহ কয়েকজন। তাদের পরিকল্পনায়ই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, এক সংসদ সদস্য এবং এক সাবেক সংসদ সদস্যের অনুসারী হিসেবে কাজ করছে আটটি গ্রুপ। নিহত গামা ছিলেন সাবেক মন্ত্রীর গ্রুপের। আর বাউল সুমনের অনুসারীদের যোগসূত্র রয়েছে সংসদ সদস্যের সঙ্গে। গ্রেপ্তারকৃত মিলনও সাবেক মন্ত্রী গ্রুপের। একইভাবে অন্য গ্রুপগুলোও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজনের মদদে।
জানতে চাইলে বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওসমান গনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একশ্রেণির লোকজন এলাকাকে অশান্ত করে তুলেছে। আমি দায়িত্ব নিয়েছি তিন মাস, এরই মধ্যে চার-পাঁচটি খুন হয়েছে। দলে হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। তারা যে কী করছে, তা আমাদের কেউ বলে না। আগে কোনো বিরোধ শুনি না, হঠাৎ দেখি মার্ডার। আমরা দলের হাইকমান্ড ও প্রশাসনকে এ ব্যাপারে জানিয়েছি।'
সূত্র জানায়, ডালিম, মাহবুব ও বাউল সুমন ছিলেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি মুকুলের সহযোগী। একসময় তাঁরা আওয়ামী লীগে যোগ দেন। একইভাবে দলে যোগ দেন জয়নালও। বাড্ডা থানার পাশে জয়নালের একটি অফিস আছে, যেখান থেকে পুলিশের ওয়াকিটকি, হাতকড়া ও পোশাক উদ্ধার করা হয়। জয়নাল পুরো এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানায় একটি সূত্র। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ অন্তত ১০টি মামলা আছে। বাড্ডা এলাকার আতঙ্ক জাহাঙ্গীর ও আলমগীর অন্য দল থেকে এসে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
জানা গেছে, গত ৩ মে বাড্ডা জাগরণী সংসদ ক্লাবে আড্ডা দেওয়ার সময় গুলি করে হত্যা করা হয় থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মোফাজ্জল হোসেন রায়হানকে। ছাত্রলীগের বাড্ডা থানার সভাপতি বাবু, সাগর, বাড্ডা থানা যুবলীগের কাওসার, স্বেচ্ছাসেবক লীগের জয়নাল, দিপু, তানভীর, অভিসহ কয়েকজনের সঙ্গে আধিপত্যের বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। আফতাবনগরে কোরবানির পশুর হাটের ইজারায় গামার সঙ্গে ভাগে অংশ নেন রায়হানও। হাটের কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই হত্যা করা হয় তাঁকে। এ কারণে গামা ও রায়হান খুনের সাজুয্য খুঁজছে স্থানীয় অনেকে। সূত্র জানায়, হাটের কারণেই যুবলীগ নেতা কাওসারের গ্রুপ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জাহাঙ্গীর ও জয়নালের গ্রুপেরও চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন গামা।
২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর হোসেন মার্কেটের সামনে চাঁদার দাবিতে গুলি করে হত্যা করা হয় মোহাম্মদ মিলন নামে এক নির্মাণ শ্রমিককে। পরদিন স্থানীয় সন্ত্রাসী মনিরুল ইসলাম ওরফে সোহাগ পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। গ্রেপ্তার করা হয় আরিফ ও জুয়েল নামের দুই সন্ত্রাসীকে। গামা হত্যায়ও সন্দেহভাজন জুয়েল সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পেয়েছে।
গত ৮ জানুয়ারি আনন্দনগরে আলমগীর ও জয়নাল গ্রুপের গোলাগুলির সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আমির হোসেন নামের একজন। গত বছরের ২৯ অক্টোবর দক্ষিণ বাড্ডার জাগরণী সংসদের পেছনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন সিটি করপোরেশনের কর্মচারী দেলোয়ার। গত ১৬ মে বাড্ডায় দুলাল হোসেন নামের এক পুলিশ সোর্সকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যার অভিযোগ উঠেছে সন্ত্রাসী জয়নাল গ্রুপের বিরুদ্ধে। গত ১৮ মার্চ মধ্যবাড্ডার কুমিল্লাপাড়ায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে ফেলে এক নিরাপত্তা প্রহরীকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এর আগে ২০০১ সালে বাড্ডায় আধিপত্যের বিরোধে হিরন-সুমন হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর দিনদুপুরে গুলি ও বোমা ছুড়ে হত্যা করা হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মামুনকে। এই খুনে জাহাঙ্গীর ও তাঁর ভাই আলমগীরের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে। গত ১০ বছরে বাড্ডায় প্রভাব-প্রতিপত্তির বিরোধে আরো খুন হন সাইদুর, মাসুম, আলা, রুবেল, তাইজুল এবং আফতাবনগরের কাজলসহ কয়েকজন।
শেয়ার করুন