"আমার ফাঁসি হয়ে গেলেই ভালো অইতো"-জজ মিয়া
‘আমার কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয় না। বলে পরের সরকার ক্ষমতায় আইলে তুমি আবার জেলে যাইবা। টাকার অভাবে বোনটারও বিয়ে দিতে পারি না, এত কষ্টে আছি যে মনে হয় আমার ফাঁসি হয়ে গেলেই ভালো অইতো’- মনের ক্ষোভ ও দুঃখ ঝেড়ে যুগান্তরের কাছে কথাগুলো বললেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সেই আলোচিত চরিত্র জজ মিয়া। যাকে নিয়ে সিআইডির তিন কর্মকর্তা সাজিয়ে ছিলেন ‘জজ মিয়া নাটক’। হতদরিদ্র জজ মিয়া একুশে আগস্ট মামলায় জড়িয়ে পড়ার পর ভিটেমাটি ছাড়া হন। গ্রামের জমিজিরাত বিক্রি করে এখন ভাড়া থাকেন নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায়। সঙ্গে থাকেন তার বৃদ্ধা মা জোবেদা খাতুন ও বোন খোরশেদা।
জজ মিয়া বলেন, ‘আমি আপনাদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বারবার অনুরোধ করছি, আমার দিকে একটু তাকানোর জন্য। আমার কোনো ঠিকানা নেই। আমি কি এই দেশের নাগরিক না। আমিতো তার জন্যই মামলা খাইছি। প্রধানমন্ত্রী কত মানুষের দিকে তাকায় কিন্তু আমার দিকে একটু তাকায় না। আমি আপনাদের মাধ্যমে আবারও অনুরোধ করি আমার দিকে একটু তাকানোর জন্য।’
জজ মিয়া একরকম আত্মগোপনেই থেকেই দিন পার করেন। কারও সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ করেন না। পরিচয়ও দিতে চান না। যেখানে থাকেন সেখানকার মানুষের কাছেও পরিচয় দিতে চান না। রেন্ট-এ-কারের একটি ভাড়া মাইক্রোবাস চালান তিনি। নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার বীরকোর্ট গ্রাম থেকে ৫ বছর আগে ঢাকা আসেন তিনি। পৈতৃক ভিটার ৭ শতাংশ জমি বিক্রি করে দিয়ে গ্রাম ছেড়ে এসে আর যাননি। গ্রামের মানুষ তার কোনো ঠিকানাও জানে না। ঢাকায় এসে বেকার জজ মিয়া গাড়ি চালকের চাকরি নেন দেশ টিভিতে। অধিক পরিশ্রম ও অল্প বেতনের কারণে সেই চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন দুই বছর আগে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনড হামলার পর ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য কল্পিত নাটক সাজায় সিআইডি। ২০০৫ সালের ৯ জুন নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় জজ মিয়াকে। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বানিয়ে সিআইডি ওই সময়কার তিন কর্মকর্তা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে জজ মিয়ার কাছ থেকে। বিনিময়ে তার মাকে প্রতিমাসে সংসার খরচের জন্য দুই হাজার টাকা করে দিত বলেও অভিযোগ করেন তার মা। সেই নাটকের নেপথ্য কারিগর ছিলেন সিআইডির ওই সময়কার বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিক ও আবদুর রশীদ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ফাঁস হয় আসল ঘটনা। ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জেল থেকে ছাড়া পান জজ মিয়া। বিনা অপরাধে তার জীবন থেকে হারিয়ে যায় চারটি বছর।
জজ মিয়া গ্রেফতারের পর সংসারে নেমে আসে চরম অর্থকষ্ট। অর্ধাহার-অনাহারে জীবন কাটে তার বৃদ্ধা মা, এক বোন ও অপর তিন ভাইয়ের। মা জোবেদা খাতুন গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি বলেন, ছেলের এই অবস্থায় আমার সংসার ছারখার হয়ে গেছে। আজও সেই ক্ষতি পূরণ হয় নাই।
বুধবার (১৯ আগস্ট) সকালে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় যুগান্তরকে সাক্ষাৎকার দেন জজ মিয়া। তিনি বলেন, ‘আপনারা আমারে এই পর্যন্ত বাঁচাইয়া আনছেন। কিন্তু বেঁচে কী হবে এখন আমি ধুঁকে ধুঁকে মরছি। এই মামলায় আমার ফাঁসি হয়ে গেলেই ভালো হতো। দেশে এমন কোনো মানুষ নাই যে, আমাকে চিনে না। আমি যেখানেই চাকরির জন্য যাই, সবাই আমাকে চিনে ফেলে। তাই চাকরি হয় না। লোকজন ভয়ে চাকরি দিতে চায় না। এখন বাধ্য হয়ে ভাড়া গাড়ি চালাই। ঢাকা শহরে খাই আর না খাই ঘরভাড়া আগে দেয়া লাগে। এই মামলায় আমার ভিটামাটি সবশেষ। আমার এখন ভিক্ষুকের চাইতেও খারাপ অবস্থা। জেলে থাকতে আমার মা আমার সঙ্গে ঢাকায় এসে দেখা করতেন। আদালতে যেতেন অনুমতির জন্য। সেখান থেকে অনুমতি পেলে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করতেন। এভাবে টাকার জন্য জমিজমা সব বিক্রি করে দেন মা।
জজ মিয়া বলেন, ‘এখন আমার কোনো ঠিকান নেই। বোনটার বয়স ২১ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু বিয়ে দিতে পারি না। বিয়ের জন্য সবাই ঠিকানা চায়। আগে সে একটি হাসপাতালে নার্সের চাকরি করত। আমার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে তার চাকরিটাও চলে গেছে। তাকে নিয়েও চরম কষ্টে আছি এখন। টাকার অভাবে বোনের বিয়ে দিতে পারছি না।’
বিয়ে করেননি কেন জানতে চাইলে জজ মিয়া বলেন, ‘আমার পরিচয় পেলে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয় না। সবাই বলে আবার পরের সরকার ক্ষমতায় আসলে তোমারে ওই মামলায় ধরব। তুমি জেলে যাবা, তোমার ফাঁসি হয়ে যাবে। এই অবস্থায় আমি আধামরা হয়ে বাঁইচা আছি। আপনারা আমাকে বাঁচার মতো বাঁচার সুযোগ দেন।’
জজ মিয়া আরও জানান, তার মায়ের শরীরের অবস্থাও ভালো নয়। বয়সের কারণে নানা রোগে ধরছে। ভাইয়েরা মাঝেমধ্যে মাকে কিছু টাকা-পয়সা দেয়। তাদের ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। ভাইয়েরা বলে, জায়গা-সম্পদ সব তোমার জন্য নষ্ট করছে। এখন আমরা ছেলেমেয়ে নিয়া কোনো রকম বাঁইচা আছি।
রেন্ট-এ কারের গাড়ি চালানোর আগে জজ মিয়া দেশ টিভির গাড়ি চালাতেন। চাকরি কেন ছাড়লেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেশ টিভি আমাকে মাসে সাত হাজার টাকা বেতন দিত। এই টাকায় নিজে চলব না বাড়িভাড়া দিব। রেন্ট-এ কারের বাজার আগের মতো নাই। একটা ননএসি নোহা গাড়ি চালাই। এটায় তেমন ভাড়াও পাওয়া যায় না। এই গাড়ির মালিকও আমার মতো ড্রাইভার। সে সব জানে। সে আমারে বলেছে, এটা দিয়া আমিও চলব, তুমিও চল।’
হামলার দিন কোথায় ছিলেন, কি করতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমি গাড়ি চালাতাম না। আমি শাপলা চত্বর এলাকায় ফলের ব্যবসা করতাম। মাঝে মাঝে স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকায় পোস্টার বিক্রি করতাম। ২-৩ মাস পর পর বাড়িতে যেতাম। ঘটনার ৭-৮ মাস পর আমারে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আমারে গ্রামের চৌকিদার অ্যারেস্ট করছে। চৌকিদার আমাদের বাড়িতে এসে বলেন, তোমার নামে থানায় মামলা আছে। থানা থেকে কবির দারোগা আসতেছে। তুমি এখানে বস। এরপর সেনবাগ থানার কবির দারোগা এসে আমাকে হ্যান্ডকাপ লাগায়। আমার এলাকার জামাল মেম্বার তাকে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে? কিন্তু দারোগা কোনো জবাব দেয়নি। থানায় নেয়ার পর কবির দারোগা বলে, তোমার নামে এখানে কোনো মামলা নাই। ঢাকা থেকে এসপি রশিদ (সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশিদ) আসতেছেন। ঢাকায় তোমার নামে বড় মামলা আছে।
জজ মিয়া বলেন, রাতে এসপি রশিদ থানায় গিয়ে বলে কই জজ মিয়া কই। লকাপের ভেতর থেকে আমাকে বের করে আনা হয়। একটা নতুন গামছা কিনে এনে আমার চোখ বেঁধে ফেলা হয়। থানার সব স্টাফ বের করে দিয়ে আমারে কয়েক জন লোককে দেখিয়ে বলে এদের তুই চিনস। আমি বলি না চিনি না। তখন এসপি রশিদ বলে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা কইরা পালাইয়া আছস। আমি বলি ওইদিন আমি ঘটনার সময় বাড়িতে বাবুলের চা দোকানে ছিলাম। টেলিভিশনে দেখে এলাকার লোকজনের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করছি। সেখানে শিক্ষক, গ্রামের মুরুব্বিরা সবাই ছিলেন। আপনারা তাদের জিজ্ঞাসা করেন। রশিদ সাব আমাকে বলে, আমরা যা বলি তাই হবে। পরে পুলিশ আমারে ব্যাপক মারধর করে। একপর্যায়ে বলে যে, আমাদের কথা না শুনলে তোরে ক্রসফায়ারে দিব। আর কথা শুনলে তোরে বাঁচাইয়া রাখব। মাইরের চোটে আমার হাতের হাড্ডি ভেঙে যায়। এরপর তারা আমারে সেনবাগ থানা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। এরপর ক্রসফায়ারে মারার ভয় দেখিয়ে তারা যা শিখিয়ে দেয় সেগুলো কোর্টে বলতে বলে।
এদিকে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ভিন্নখাতে প্রভাবিত করার জজ মিয়া নাটকের রূপকার সিআইডির সাবেক ওই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়েছে। তারা বর্তমানে জামিনে আছেন এবং আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।
জজ মিয়া উপাখ্যান: ঘটনার ১০ মাসের মাথায় ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়াকে আটক করে সিআইডি। গ্রেফতারের পর ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়ার কাছ থেকে সিআইডি সাজানো জবানবন্দি নেয়।
এই জজ মিয়াকে দিয়েই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে তদন্তের নামে ‘আষাঢ়ে গল্প’ ফাদেন মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি আবদুর রশিদ ও তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন। সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনিও এই সাজানো ছকে কথিত তদন্তকে এগিয়ে নিয়ে যান। এ গল্প সাজানোর ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তাদের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন বলে পরবর্তীকালে তদন্তে জানা যায়।
আদালতে দেয়া সেই সাজানো জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, ‘তিনি আগে কখনো গ্রেনেড দেখেননি। গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। আর বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ ও মুকুল।’ এ সাজানো গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটা। উল্লিখিত সন্ত্রাসীদের বেশির ভাগ চারদলীয় জোট সরকারের সময় ভারতে পালিয়ে যায়।
এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৬ সালের আগস্টে এ নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দেন জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন। তিনি বলেন, জজ মিয়াকে গ্রেফতারের পর থেকেই সিআইডি তার পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছিল। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন তিনি। বিএনপি সরকার ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিষয়টি পুনঃতদন্ত করলে প্রকৃত কাহিনী বেড়িয়ে আসে।
সুত্রঃ যুগান্তর
শেয়ার করুন