রংপুরে নিখোঁজের ৭ মাস পর জামায়াত নেতাকে গ্রেফতার দেখালো পুলিশ
নিখোঁজের প্রায় সাত মাস পর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও জামায়াতের যুব ইউনিটের সভাপতি আব্দুল বাছেত মারজানকে বাসে পেট্রোলবোমা হামলা, আল্লামা সাঈদীর রায়ের দিন সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাসহ ১৪টি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ।
আজ বুধবার ভোরে তাকে উপজেলার গড়রের মাথা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।
তবে পরিবারের অভিযোগ সাত মাস আগে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তারা বাছেতের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে।
মিঠাপুকুর থানার অফিসার ইনচার্জ হুমায়ুন কবির জানান, বুধবার রাতে জামায়াত নেতা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল বাছেত মারজানকে মিঠাপুকুরের গড়ের মাথা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে চলতি বছর ১৪ জানুয়ারি দিবাগত রাতে মিঠাপুকুরের জায়গীর বাতাসন এলাকায় বাসে পেট্রোলবোমা হামলা করে ছয়জনকে হত্যা, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা সাঈদীর ফাঁসির রায়ের দিন সংঘর্ষে সাতজন হত্যাসহ ১৪টি নাশকতার মামলা আছে।
ওসি জানান, আব্দুল বাছেত মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি। তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলার ওয়ারেন্ট আছে। ছয়টিতে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। তিনটি মামলার শুনানি চলছে। আজ দুপুরে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
তবে তার স্ত্রী রোকাইয়া খানম লুকি জানান, আব্দুল বাছেত মারজান মিঠাপুকুরের সব শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে জনপ্রিয় নেতা। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ বছর ১ ফেব্রুয়ারি তিনি উপজেলা পরিষদের কাজে ঢাকা গিয়ে মোহাম্দপুরের তাজমহল রোডে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেন। ওই দিনই আত্মীয়ের বাসা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে আটক করা হয়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন।
রোকাইয়া খানম বলেন, আব্দুল বাছেতের সন্ধানের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদ সম্মেলনসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে চিঠি দিয়ে তাকে থানায় সোপর্দ কিংবা নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেয়ার দাবি জানোনো হয়। অবশেষে আল্লাহ সহায় হয়েছেন। পুলিশ বুধবার রাতে নাটকীয়ভাকে তাকে গ্রেফতার দেখিয়েছে। এসময় আব্দুল বাছেতের নিঃর্শত মুক্তি দাবি করেন তিনি।
রোকাইয়া খানম জানান, গত ১ ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে ৫টার দিকে তিনি ফোন পান। সাদা পোশাকের কয়েকজন আইনশৃংখলাবাহিনীর লোক আব্দুল বাছেতকে আটক করে নিয়ে গেছে। তারা উপস্থিত লোকজনদের পরিচয় দিয়েছেন ডিবির লোক।
প্রত্যক্ষদর্শী বাসার মালিক তাজুল ইসলামের স্ত্রী লিউজি বেগম জানান, ঘটনার দিন ভোরে বাড়ির দারোয়ানকে সাথে নিয়ে ৫/৬ জন লোক প্রথমে তার বাসায় নক করে। তার স্বামী দরজা খুলে দিলে তারা বলেন, ‘আমরা ডিবি পুলিশের লোক। আপনার মেহমান কোথায়। তার নামে মামলা আছে। এরপর তারা মারজান ভাইকে আটক করে নিয়ে যায়।’
ওই সময়ে ওই বাসায় কর্তব্যরত দাড়োয়ান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনি ফজরের নামাজের জন্য ওজু করবেন ঠিক এমন সময় ৫/৬ জন লোক গেটে আসে। তাদের পরিচয় জানতে চাইলে বলেন গেস্ট। তখন আমি তাদের বলি এতো সকালে গেস্ট যাওয়ার নিয়ম নেই। তখন তারা ডিবি পুলিশ পরিচয় দেন ও পরিচয়পত্র দেখান এবং আমাকে নিয়ে উপরে যান। সেখানে গিয়ে তারা মোবাইল ট্রেকিং করে ঘরে প্রবেশ করে ওই মেহমানকে (মারজান) আটক করে নিয়ে যায়। তবে এসময় তারা মারজানের সাথে কোন খারাপ আচরণ করে নাই।
মারজানের স্ত্রী রোকাইয়া খান লুকি আরো বলেন, আমার স্বামীকে ডিবি পরিচয়ে নিয়ে যাওয়ার পর আমি প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেয়া কিংবা আদালতে সোপর্দ করার দাবি জানাই। গত ৫ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমার স্বামীকে আদালতে সোপর্দ করার দাবি জানাই। বিভিন্ন জায়গায় লিখিত আবেদন করি। মিডিয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। অবশেষে সাত মাস পর তাকে থানায় সোপর্দ করা হলো। এজন্য প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই।
লুকি বলেন, ‘আমার স্বামী কোনোদিন কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। তিনি মিঠাপুকুরের আপামর জনসাধারণের বন্ধু। মিঠাপুকুরের সব শ্রেণী পেশার, রাজনৈতিক দলের মানুষ তার সাক্ষী। তিনি এক লাখ ছয় হাজার ভোট পেয়ে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। আমার স্বামী হিসেবে বলছি না, আপনারা মাঠে যাছাই করে দেখুন, ওর দ্বারা কোনো ধরনের খারাপ কাজ করা সম্ভব কি-না। ও কখনই কোনো খারাপ কাজ করতে পারে না। করে নাই। করবেও না। ও শুধু মানুষের কল্যাণ চেয়েছে। উপকার করেছে। নিজের ক্ষতি করে হলেও মানুষের উপকার করেছে। আমার স্বামী মিঠাপুকুরের আপামর জনগণের বন্ধু। কাছের বন্ধু। আমাদের সময় না দিয়ে ও জনগণকে সময় দিতো। তাদের কি করলে ভালো হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করতো। কিন্তু সেই মানুষটা সাত মাস ধরে নিখোঁজ। ডিবি পরিচয়ে তুলে যাওয়া হলো। আর কোনো খোঁজ খবর নাই। ও কোথায় আছে। কিভাবে আছে। বেঁচে আছে না তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা কিছুই জানি না। দুটি মাসুম বাচ্চা। তারা শুধু আব্বু আব্বু বলে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ওরা আমার কাছে যখন জানতে চয় কখন আসবে আব্বু। কেন ওরা আব্বুকে নিয়ে গেলো। কেন আব্বু বাড়িতে আসে না। আমাদের পড়ালেখা খাওয়া দাওয়ার খোঁজ নিচ্ছে না। আব্বু আব্বু বলে ওরা চিৎকার করছে। কিন্তু আমি নিরোত্তর। আমি ওদের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারি না। ওদেরকে আমি সামলাতে পারছি না। ঘরের বাইরে কোনো আওয়াজ হলেই ওরা ছুটে যায়। বলে আব্বু এসেছে। কিন্তু না। এই পৃথিবীতে এখন আমার বেঁচে থাকাটাই অনর্থক হয়ে গিয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘মারজান না থাকায় ব্যবসাটাও বন্ধ হয়ে আছে। অনেক টাকা লোকসান আর ব্যাংক ঋণের মুখোমুখি আমরা। ওই ব্যবসার অর্থ দিয়েই ও সংসার চালাতো। জনগণের সেবা করতো। আমি ভেবেছিলাম মারজান কখনও তার অবুঝ সন্তান দুটিকে আদর করবার, তাদের দেখভাল করার কোনো সুযোগ পাবে কি-না। আমার কাছে বেঁচে থেকেও মরে যাওয়ার সমান ছিল।’
আব্দুল বাছেত মারজানের মেয়ে ইসমাত ওয়ারা সাবিহা বলেন, ‘আমার পিতা একজন জননেতা। জনগণকে নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকতেন। যেটুকু সময় পেতেন, সেটুকুতেই আমাদের তিনি আদরে আদরে ভরিয়ে রাখতেন। তার সাথে আমার অনেক স্মৃতি বলে কাঁদতে থাকে অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া সাবিহা।
আব্দুল বাছেত মারজানের শিশু সন্তান হাসিন তাজমিন বলেন, ওরা কেন আমার আব্বুকে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল। কেন আব্বুকে সাত মাস পর দেখলাম। তবুও তিনি জেলে। আমাকে আদর করতে পারলেন না। আমকে গোসল করিয়ে দিতে পারলেন না। স্কুল ড্রেস পরিয়ে দিতে পারলেন না। চকলেট কিনে দিলেন না। আমি তো আব্বু ছাড়া ঘুমাতে পারি না।
শেয়ার করুন