জাসদকে নিয়ে ঝড়ের নেপথ্যে জাসদের ভুমিকা কি?
আওয়ামী লীগ সরকার এবং আওয়ামী লীগ ১৫ আগস্ট উপলক্ষে সমগ্র আগস্ট মাসকেই শোকের মাস হিসেবে পালন করলেন। প্রতিবছরই আওয়ামী লীগ ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস অথবা আগস্ট মাসকে শোকের মাস হিসেবে পালন করে থাকে। কিন্তু এবার এই শোকের মাসে আওয়ামী লীগের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নেতার মুখ থেকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সম্পর্কে এমন সব আক্রমণাত্মক উক্তি এবং মন্তব্য বেরিয়ে আসে যেগুলো আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু একটি ইংরেজি দৈনিকের রিপোর্ট মোতাবেক গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু জাসদের ব্যাপারেই নয়, অন্যান্য ইস্যুতেও আওয়ামী লীগের কতিপয় মন্ত্রী এবং নেতার বক্তব্যে লাগাম টেনে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। ধারণা করা যায় যে, প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশের পর জাসদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের তীব্র প্রচারণায় হয়তো ইতি ঘটবে। কিন্তু এই কয়েক দিনে যা ঘটে গেল সেটির পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপঐ খবরে প্রকাশ, গত বুধবার আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। এসব নেতার মধ্যে ছিলেন মাহবুবুল আলম হানিফ, আবদুর রাজ্জাক, ফারুক খান এবং সাবের হোসেন চৌধুরী। এই অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, বিতর্কিত বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বিরত থাকা উচিৎ। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককালে ক্রসফায়ার, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, আমেরিকা কর্তৃক বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধাদানে অস্বীকৃতি এবং আওয়ামী লীগ ও যুব লীগ নেতৃবৃন্দের অপকর্ম সম্পর্কে এক শ্রেণীর আওয়ামী লীগ নেতা প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিলেন। এছাড়া ১৪ দলের অন্যতম শরিক দল জাসদকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পথ সুগম করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
চিত্রঃ লন্ডনে ইনুর উপর হামলা
এ ব্যাপারে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, তার দল এবং মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের উচিৎ, বিভিন্ন ইস্যুতে এক সুরে কথা বলা। একই ইস্যুতে একেকজন একেক রকম কথা বলায় বিভ্রান্তি ও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে অন্যেরা এই অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।বিভিন্ন ইস্যুতে যারা বৈরী মন্তব্য করেছেন তারা হলেন- শেখ সেলিম, মাহবুবুল আলম হানিফ, ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বাহাউদ্দিন নাসিম, ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপস প্রমুখ। ব্যারিস্টার তাপস র্যাবের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে বলেন। সুরঞ্জিত বাবু গ্যাস এবং বিদ্যুৎ মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করেন। শেখ সেলিম, হানিফ, তাজুল ইসলাম এবং আসাদুজ্জামান খান কামাল বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর এসব নেতার ক্ষোভের আগুনে ছাই ঢেলে দেওয়া হলো কি না, সেটি এখন দেখার বিষয়। কিন্তু কেন হঠাৎ জাসদের বিরুদ্ধে বিষোদগার?দল নিরপেক্ষ শিক্ষিত সমাজ ভেবে পাচ্ছেন না যে, ৪০ বছর পর জাসদকে নিয়ে আওয়ামী লীগের এক শ্রেণীর নেতার এই আক্রমণ কেন? এখানে সবচেয়ে বড় স্ববিরোধিতার বিষয় এই যে, মাহবুবুল আলম হানিফ এবং অন্যেরা শুধু জাসদ নয়, সমস্ত বামপন্থী দল এবং নেতার বিরুদ্ধে অনুরূপ বক্তব্য দিয়েছেন। এই পটভূমিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন একটি মূল্যবান কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, জাসদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতারা সশস্ত্র তৎপরতা এবং শেখ মুজিবের পতনের পথ প্রশস্ত করার যে অভিযোগ করেছেন সেগুলো সবই ঠিক। তা হলে সেইসব ব্যক্তিকে নিয়ে আবার মন্ত্রিসভা গঠন কেন? এসব অভিযোগের পরেও তারা মন্ত্রী থাকেন কীভাবে?হঠাৎ করে জাসদ এবং বামপন্থীদের বিরুদ্ধে এই বিষোদগার কেন, সে প্রশ্ন এখন সুধী সমাজ এবং রাজনৈতিক মহলে উত্তপ্ত রাজনীতির টপিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।২০১৯ সালের আগেই নির্বাচন?বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, নির্ধারিত সময়ের আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালের আগেই একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আন্তর্জাতিক মহল সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। কারণ তারা মনে করে যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল একতরফা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমস্ত বিরোধী দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তাই সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। বিদেশিদের কাছে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য সরকার নাকি নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা-ভাবনা করছে। কিন্তু সেই নির্বাচনে যাতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়া যায় সেটি নিশ্চিত না হয়ে সরকার ইলেকশন দিবে না। সরকার নাকি এ রকম চিন্তা-ভাবনা করছে যে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে বেগম জিয়াসহ অনেক সিনিয়র বিএনপি নেতার বিচর আদালতে সম্পন্ন হবে এবং বিচারে দ-প্রাপ্ত হলে তারা নির্বাচনের অযোগ্য হয়ে যাবেন। সে ক্ষেত্রে বর্তমান মহাজোটেরই একটি অংশ অর্থাৎ ইনুর জাসদ, মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, দিলিপ বড়–য়ার সাম্যবাদী দল এবং এরশাদের জাতীয় পার্টিকে কিছু আসন দিয়ে বিরোধী দলে রাখা হবে। সেটির মহড়া হিসেবে বামপন্থী মন্ত্রীদের কেবিনেট থেকে সরানো হবে। তাদের পরবর্তী নির্বাচনে জিতিয়ে এনে তাদের দিয়েই বিরোধী দল গঠন করা হবে। সেজন্যই অর্থাৎ কমিউনিস্টদের ড্রপ করার জন্যই জাসদ ও গণবাহিনীর নেতা হাসানুল হক ইনু এবং অন্যান্য বামপন্থী নেতার বিরুদ্ধে সরকারি দল থেকেই মারাত্মক সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে।তাহলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কেন?প্রশ্ন উঠেছে যে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বামপন্থীদের যদি ক্যাবিনেটের বাইরে রাখার চিন্তা-ভাবনা হয়ে থাকে তা হলে জাসদের বিরুদ্ধে সমালোচনার যে ঝড় উঠেছিল সেটিকে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হলো কেন? এ সম্পর্কে পর্যবেক্ষক মহল বলেন যে, সরকার চায় একটি অনুগত বিরোধী দল। এদের অবস্থান হবে মৎস্য কন্যার মতো। অর্ধেক মাছ, অর্ধেক মানবী। এখন সেই ভূমিকাটিই পালন করছে জাতীয় পার্টি। এরশাদ মাঝে মাঝেই সরকারের বিরুদ্ধে টক-ঝাল-মিষ্টি ছাড়েন। কিন্তু সরকার সেটিকে শার্টের ময়লা ঝাড়ার মতো আঙ্গুল দিয়ে টুকে ফেলে দেয়। জাসদ তথা বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বক্তব্যের মাধ্যমে আসলে তাদের কাছে একটি বার্তা দেওয়া হলো। পরবর্তী পর্যায়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ কথাও ঠিক যে, শাসক দল আওয়ামী লীগের মধ্যেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার সেই অস্থিরতারই আংশিক প্রকাশ মাত্র।
শেয়ার করুন