আজ বিএনপির ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে বিএনপি
বিএনপির ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। এই ৩৭ বছরের ইতিহাসে এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে দেশের অন্যতম প্রধান এই রাজনৈতিক দলটি। দীর্ঘ নয় বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলায় জর্জরিত। হাজার হাজার নেতাকর্মী ঘরবাড়ি ছাড়া। মুক্তি পাওয়ার পরও শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন 'ঘরমুখো' হয়ে আছেন, আবার অনেকে আত্মগোপন থেকে বের হওয়ারই সাহস করছেন না। নেতাকর্মীদের যখন এই অবস্থা, সে মুহূর্তে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপর ঝুলছে 'সাজা'র খড়গ। আর এ অবস্থার মধ্যেও নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও সন্দেহ-অবিশ্বাসের কারণে সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত দলটি।
এরশাদ সরকারের আমলে দলে দফায় দফায় বড় ধরনের ভাঙনের মুখে পড়লেও বিএনপি আজকের মতো এমন বৈরী পরিস্থিতির মুখে পড়েনি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নেতাকর্মীদের আন্দোলন তাকে আপসহীন নেত্রীর ইমেজ এনে দেয়। আর '৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি আসে ক্ষমতায়। '৯৬ সালে ক্ষমতা হারিয়ে সাময়িক অসুবিধার মধ্যে পড়লেও বিপর্যয় শব্দটি ছিল না আশপাশে। এরপর ২০০১ সালে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর আবার ঘুরে দাঁড়ায় বিএনপি। কিন্তু ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবির পরও বিরোধী দলে থেকে মন্দের ভালো সময় কাটায় দলটি। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি এখন সরকারেও নেই, নেই বিরোধী দলেও। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের একবছর পূর্তিতে ফের সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করে দলের কয়েক লক্ষাধিক নেতাকর্মী এখন মামলার জালে আটকা। নির্বাচনের পর বিভিন্ন স্থানে 'বন্দুকযুদ্ধে' একের পর এক নেতাকর্মী নিহত হওয়ায় দলটির তৃণমূলে দেখা দিয়েছে নতুন আতঙ্ক। অন্যদিকে বিএনপির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলন শক্ত হাতে মোকাবেলা করে সরকার পরিচালনা করছে। সব মিলিয়ে যত দিন যাচ্ছে কঠিন অবস্থা থেকে আরো কঠিনতর হচ্ছে।
বিএনপি সূত্রমতে, দুই দফা আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে নেতাদের নির্দোষ প্রমাণ করা, দল পুনর্গঠন, দেশি ও আন্তর্জাতিক শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা এবং সর্বোপরি আন্দোলন করে দাবি আদায়ের কৌশল ঠিক করেছিল বিএনপি, কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কৌশল এবং প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিএনপি কোনো ধরনের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারছে না। একের পর এক বিপর্যয়ের সম্মুক্ষীন হতে হচ্ছে দলটিকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেকদের মতে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর নানা ঘটনাচক্রে খালেদা জিয়ার দলের হাল ধরা, দল ভাঙা-গড়ার খেলার মধ্যদিয়ে দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, '৯৬ সালে নির্বাচনে ক্ষমতা হারিয়ে আবারো বিরোধী দলে যাওয়া, ২০০১ সালে ক্ষমতায় গিয়ে গলায় জামায়াতের কলঙ্কের ঢোল, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদকে ছায়াদান, অবাধ লুটপাটসহ নানা অভিযোগের পর ক্ষমতা হারানো, ১/১১ সরকারের সময় দলে ভাঙন, ছেলেদের বাধ্য হয়ে নির্বাসনে পাঠানো, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়পরবর্তী সময়ে দলের নেতাকর্মীদের হামলা-মামলা নির্যাতন এবং নিজের ৪০ বছরের ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি হারিয়েও খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে বর্তমান সময়ের মতো এতটা চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়নি। আর নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ের জন্য দুই দফা আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে শুরু হয়েছে মহাবিপর্যয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলা গতি-প্রকৃতি নতুন দিকে মোড় নেয়ায় এবং তার সাজা হওয়ার আশঙ্কা থেকে দলে বিপর্যয় মাথাচাড়া দিয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ৫টি মামলা বর্তমান বিচারিক অবস্থা দলকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। এছাড়া নাশকতার মামলাসহ অন্য মামলাগুলো নিয়েও সাজা
আতঙ্ক রয়েছে। খালেদা জিয়া ছাড়াও দলের সিনিয়র এবং মধ্যসারির অনেক নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে শত শত মামলা। এ মামলাগুলোতে অনেক নেতার দ্রুত সময়ের মধ্যে সাজা হতে পারে এমন আশঙ্কা করছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।
এদিকে মামলা ছাড়াও দলে ভাঙন ঠেকানো নিয়েও আছে বিএনপিতে দুশ্চিন্তা। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে, বিএনপিতে সুবিধাবাদী অনেক নেতা আছেন যারা বিগত সময় এর প্রমাণও রেখেছেন। ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য অনেকে দফায় দফায় দল পরিবর্তন করতে এবং শর্ত সাপেক্ষে আপস করতে দ্বিধা করেনি। বাহ্যিকভাবে দলের পক্ষ থেকে ভাঙন নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই বলে জানানো হলেও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টি নিয়ে খালেদা জিয়া চিন্তিত বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।
বিএনপি সূত্রমতে, ভাঙন নিয়ে এই দুশ্চিন্তার পাশাপাশি যোগ হয়েছে দলের চেন অব কমান্ড ভেঙে পড়া এবং স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে না পারার বিষয়টি। দুই দফা আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর খালেদা নিজেই দল পুনর্গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু ৫ মাসে পুনর্গঠনের কাজ শুরুই হয়নি বললেই চলে। কাজের মধ্যে শুধু ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ের সব কমিটি করার নির্দেশনা দিয়ে সংশ্লিষ্ট নেতাদের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে তৃণমূলকে চাঙ্গা করতে উদ্যোগ নিলেও কেন্দ্রীয় বিএনপিকে চাঙ্গা করতে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিএনপি। তবে ঢাকা মহানগর বিএনপির থানা এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটি গঠনও চলছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। কিন্তু যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে ঢেলে সাজানোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে দলকে তৎপর করার মতো কোনো খবর নেতাকর্মীদের নেই। তাই কেন্দ্রীয় রাজনীতি অনেকটা স্থবির হয়ে আছে।
দলের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিপর্যস্ত অবস্থার কারণে আপাতত বড় কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি। তবে সংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আর সাফল্য পেতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, নেতাকর্মীদের মুক্তি করা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্পর্ক উন্নয়ন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন নির্বাচনের দাবিতে চলছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে গিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা নতুন নির্বাচনের ব্যাপারে জনমত গড়ে তুলছেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সরকারকে ম্যানেজ করতেও তৈরি হচ্ছে নানা কর্মপন্থা। দলের সিনিয়র এক নেতা জানান, আপাতত আর আন্দোলন নয়। এখন চলবে আন্তর্জাতিক গেইম। এ জন্য কাজ শুরু হয়েছে। আশা করি, চূড়ান্ত বিজয় হবে।
৩৭ বছরের সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি চলছে কিনা জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, বিএনপি কঠিন সময় পার করছে_ এটা ঠিক। তবে সাংগঠনিকভাবে না যতটা, তার চেয়ে বেশি সরকারের রোষানলের কারণে। হামলা-মামলা চালিয়ে সরকার বিএনপিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। নির্যাতন ও এত হামলা-মামলার পরও দল হিসেবে আমরা সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। দল পুনর্গঠনের পর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে।
একই বিষয়ে দলের মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, কঠিন সময় চলতে তা বলা যায় নিঃসন্দেহে। তবে এখন সবচেয়ে কঠিন সময় হয়তো না। এরশাদ সরকারের সময় পরিস্থিতি এর চেয়ে কঠিন ছিল।
কেন্দ্র ছাড়া তৃণমূল নেতাকর্মীও মনে করছে এখন ইতহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে বিএনপি। তৃণমূল নেতা চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবদলের সহসভাপতি শাহ সরোয়ার হোসেন জানান, এমন কঠিন সময় আর আসেনি বিএনপির। এখন কথা বলাও কঠিন হয়ে পড়েছে। চারদিকে হতাশা। তাই ঘুরে দাঁড়াতে হলের প্রথমে তৃণমূলের হতাশা কাটানোর উদ্যোগ নিতে হবে কেন্দ্রকে।
পাহাড়সমান সংকট মোকাবেলা করে জাতীয় নির্বাচন আদায় এবং তৃণমূলকে আস্থায় এনে সংগঠন গোছানোর লক্ষ্য নিয়েই আজ ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে বিএনপি। বিগত সময়ে মতো জাঁকজমকপূর্ণভাবে এবারের কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে না। এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মাত্র একদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশের সব কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১০টায় শেরেবাংলানগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শ্রদ্ধা নিবেদন ও বিকালে কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা। এ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র, পোস্টার ও লিফলেটও প্রকাশ করা হচ্ছে।
বিএনপির ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বিষয়ে গতকাল নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন অভিযোগ করে বলেন, সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় ও উপজেলায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে সরকার বাধা দিচ্ছে। দেশের ৪০টি জেলা এবং প্রায় ৪০০টি উপজেলায় আয়োজিত কর্মসূচিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বাধা দিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার লাগাতে গিয়ে সরকার সমর্থক নেতাকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে পিটুনির শিকার হয়েছেন। শেরেবাংলানগরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধি প্রাঙ্গণে জিয়া সাংস্কৃতিক সংগঠন-জিসাস রক্তদান কর্মসূচির জন্য প্যান্ডেল করলে পুলিশ তা ভেঙে দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসীদের মঞ্চ হিসেবে এ দল গঠন করেন। ফেলে আসা ৩৭টি বছরে সংঘাত-বিক্ষোভ, জনপ্রিয়তা আর চড়াই- উতরাইয়ের পথপরিক্রমায় বিএনপি আজ দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। সাড়ে তিন দশকে সবচেয়ে বেশি সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও দল গোছানোর ব্যাপারে নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি তারা। সাংগঠনিকভাবে শক্তি অর্জনের চেয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশলকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে দলের নীতিনির্ধারকরা। উন্নয়ন-উৎপাদনের রাজনীতিকে মূল প্রতিপাদ্য ঘোষণা করে ১৯ দফা কর্মসূচির আলোকে প্রতিষ্ঠার পাঁচ মাসের মাথায় ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ২০০টি আসন লাভ করে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর একাংশের অভ্যুত্থানের এক ব্যর্থ চেষ্টায় জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া এই দলে হাল ধরেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৪ বছরের কালযাত্রায় বিএনপি ৪ দফা দেশ শাসন করে। সর্বশেষ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০০৬ সালের অক্টোবরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। ১/১১-এর পালাবদলের পর বিএনপিকে প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমান। ১/১১-এর অবসান হয়। পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংগঠনিকভাবে আরো নাজুক অবস্থা তৈরি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে কয়েক দফা আন্দোলনের ডাক দেয়া হলেও ভেতরে লেজেগোবরে অবস্থার কারণে তা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দফায় দফায় ভাঙনের মুখে পড়ে বিএনপি। প্রথমে হুদা-মতিন, দ্বিতীয়বার শাহ আজিজ, তৃতীয়বার কেএম ওবায়দুর রহমান, চতুর্থবার অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, পঞ্চমবার কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এবং ষষ্ঠবার আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি।
খালেদা জিয়ার বাণী
বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে খালেদা জিয়া বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে জনগণের ক্ষমতায়নে ভূমিকা পালন করার জন্য এ দিনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিএনপি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের যে রাজনীতি তিনি সূচনা করেছিলেন_ তা বাকশালীয় একদলীয় রাজনীতি-উত্তর সমাজ ও রাষ্ট্র জনগণের কাছে সমাদৃত হয়েছে বলে এদেশের জনগণ বারবার এ দলকে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেছে। এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে বিএনপি সর্বদা জনগণের রাজনৈতিক দল হিসেবে সব জাতীয়-রাজনৈতিক সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও প্রতিকূলতা ও রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশেও দেশের গণতন্ত্র যতবার বিপন্ন হয়েছে বা গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত এসেছে-বিএনপি সব সময় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে স্বৈরশাসন-গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির চ্যালেঞ্জকে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করেছে এবং গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছে। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অক্ষুণ্ন রেখে দেশ ও জনগণের সেবায় বিএনপি আগামী দিনগুলোতেও বলিষ্ঠ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে ইনশাআল্লাহ।
খালেদা জিয়া বলেন, আজ দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে। ৫ জানুয়ারির তামাশার নির্বাচনের পর গণতন্ত্র এখন মৃতপ্রায়। দেশবিরোধী নানা চুক্তি ও কর্মকা-ের মাধ্যমে বর্তমান সরকার জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে চলেছে। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। দেশজুড়ে গণহত্যা. গুম, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, নিপীড়ন ও নির্যাতনের মহোৎসব চলছে। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত করার জন্য নির্লজ্জ দলীয়করণের চূড়ান্ত রূপ দিতে বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ন্যস্ত করার আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী করার জন্যই এই আইন পাস করা হয়েছে। এটি পাস হওয়ার ফলে নিপীড়িত মানুষের আইনি প্রতিকার পাওয়ার শেষ ভরসাটুকুও বন্ধ হয়ে গেছে। জনপ্রশাসন আজ্ঞাবহ হওয়ার কারণেই স্থবির হয়ে পড়েছে। যাতে জনমতের প্রতিফলন না ঘটে সেজন্য গণমাধ্যমের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে জাতীয় সমপ্রচার নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি মূলত এই অবৈধ সরকার কর্তৃক মানুষের বাক, ব্যক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতাকেই অপহরণ করা। জনগণের অধিকার আদায়, তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা আবারো পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি অঙ্গীকারাবদ্ধ। জনগণের কাছ থেকে ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেয়া মৌলিক-মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন এখন জরুরি। জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মৃতপ্রায় গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করতে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের পথ প্রশস্ত করবেন।
দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানান খালেদা জিয়া। পাশাপাশি যারা ইন্তেকাল করেছেন তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন তিনি।
শেয়ার করুন