মজিনা-বরফ গলিয়ে হৃদ্যতা ফিরিয়ে আনছেন বার্নিকাট
একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত তিন বছরের ওপর ঢাকায় কাটিয়েও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাননি। কিন্তু ওই একই পদে তার উত্তরসূরি মাত্র ছয়-সাত মাসের মধ্যেই দু-দুবার দেখা করে ফেললেন সেই একই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে! প্রথমজন ড্যান ডবিস্নউ মজিনা, দ্বিতীয়জন মার্সিয়া স্টিফেন্স বস্নুম বার্নিকাট। প্রধানমন্ত্রীর নাম অবশ্যই শেখ হাসিনা।
এটা কি শুধুই কাকতালীয়? না কি ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ? না কি অন্য কোনো জটিল অঙ্ক আছে এর পেছনে? খবর বাংলা ট্রিবিউন।
দিলি্লতে পদায়িত একজন সিনিয়র মার্কিন কূটনীতিক, যিনি বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই আমেরিকার কূটনৈতিক কর্মকা-ের ওপর নজর রাখেন, তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন, এর পেছনের সব কারণই অল্প অল্প করে আছে। 'তবে কারণটা যাই হোক, ঢাকায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রদূতের নিয়মিত মতবিনিময় হচ্ছে, এটাই তো সবচেয়ে পজেটিভ ডেভেলপমেন্ট, তাই না?'_ হাসতে হাসতে যোগ করেন ওই পোড়খাওয়া কূটনীতিক।
বার্নিকাটকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানোর পেছনে আসলে আমেরিকার অনেক অঙ্ক ছিল। কারণ, ড্যান মজিনার প্রায় সোয়া তিন বছরের মেয়াদে ঢাকা আর ওয়াশিংটনের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল বললেও ভুল হবে না। তার চেয়েও খারাপ ছিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর আর মার্কিন দূতাবাসের মধ্যে সম্পর্ক। দু'পক্ষের মধ্যে একটা সময় কার্যত কোনো কমিউনিকেশনই ছিল না।
গত বছরের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের সময় মার্কিন দূতাবাস যেভাবে সেই নির্বাচনের সমালোচনা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হাসিনাও তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, রাষ্ট্রদূত মজিনা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কথাতেই বেশি প্রভাবিত হচ্ছেন। এমনকী সারাদেশে নাশকতা সৃষ্টিকারী জামায়াতের সঙ্গেও তিনি সুসম্পর্ক রেখে চলেছেন। বেশ কয়েক জামায়াত নেতাও তার সুনজরে ছিলেন। এহেন মজিনার সঙ্গে বসে তিনি যে কোনো আলাপ করতেই চাইবেন না, তাতে আর আশ্চর্য কী?
হাসিনা ও মজিনার সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেকটা পড়েছিল ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে, যখন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে যান। সেই মার্কিন সফরেই মজিনার রিপোর্টের ভিত্তিতে ওয়াশিংটন শেখ হাসিনাকে 'ফিলার' পাঠায়, 'আপনি নিজে প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে নির্বাচন হলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না ও বিরোধীরা ভোটে অংশ নিতে চাইবে না। কাজেই ভোটের সময়টুকু অন্তত আপনি সরে দাঁড়ান।' জবাবে হাসিনা সটান জানিয়ে দেন, 'কেন? আমেরিকায় ভোট হলে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে কি সরে দাঁড়াতে হয়?'
সেই প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ সামলেই শেষ পর্যন্ত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তারপরেও সেই নির্বাচন নিয়ে যাবতীয় সমালোচনা ও কটাক্ষ তিনি উপেক্ষা করে গেছেন, প্রতিবেশী ভারতের ঢালাও সমর্থনও পেয়েছেন। কিন্তু ড্যান মজিনার সঙ্গে সম্পর্কে যে পাকাপাকি তিক্ততা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তা আর দূর করা যায়নি। কারণ, ততদিনে দুজনের মধ্যে পরিষ্কার অবিশ্বাস আর সন্দেহও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মজিনা নিজে দিলি্ল গিয়ে ভারতের মন্ত্রী-আমলাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন, এটাও কিছুতে মানতে পারেননি হাসিনা।
সেই সম্পর্ক মেরামতির কঠিন দায়িত্ব নিয়েই এ বছরের জানুয়ারিতে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পদে যোগ দেন মিস বার্নিকাট। মজিনার মতো তারও আছে দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। কিন্তু দুজনের কাজ করার পদ্ধতি আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে ওবামা প্রশাসন তাকে এই পদে মনোনীত করেছিল এটা ভেবেই যে, তার পক্ষে শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত সমীকরণ গড়ে তোলাও হয়তো সহজ হবে। হাতের কাছে সুজাতা সিং বা সুষমা স্বরাজের উদাহরণ তো আছেই।
বার্নিকাটের জন্য আরো একটা বড় সুবিধা ছিল, অন্তর্বর্র্তী নির্বাচনের দাবি ছেড়ে ওয়াশিংটনও ততদিনে এই বাস্তবতা মেনে নিতে শুরু করেছে, পাঁচ বছরের মেয়াদ ফুরানোর আগে শেখ হাসিনার সরকারকে সরানো মুশকিল। মোটামুটি একই সময় নাগাদ বিএনপি-জামায়াত জোট দেশজুড়ে সহিংস আন্দোলন শুরু করে দেয়। পেট্রলবোমায় প্রাণ হারাতে থাকেন বহু নিরীহ মানুষ। সেই আন্দোলনকে সমর্থন করা আমেরিকা কেন, কোনো পশ্চিমী দেশের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। ফলে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে বিএনপি জোটের।
এই পটভূমিতেই গত ফেব্রুয়ারিতে বার্নিকাট-হাসিনার প্রথম বৈঠক হয় নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত দায়িত্ব নেয়ার মাত্র এক মাসের মধ্যেই। বরফ গলার শুরু সেই সৌজন্য সাক্ষাৎ দিয়েই। তারপর গত কয়েক মাসে দুপক্ষ আরো অনেক কাছাকাছি আসতে পেরেছে। ড্যান মজিনা যেমন একটা সময় প্রকাশ্যেই বলছিলেন_ আমেরিকা আর বাংলাদেশের সম্পর্ক মোটেই 'বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল' নয়। বার্নিকাট সে রাস্তায় একেবারেই হাঁটেননি, বরং সম্পর্ক থেকে অস্বস্তির উপাদানগুলো সরিয়ে ধীরে ধীরে সহজ করতে চেয়েছেন। আর তার পরিণতিতেই গত বুধবার হাসিনা ও বার্নিকাটের মধ্যে দ্বিতীয় বৈঠকটি সম্ভব হয়েছে, যেটা খুবই বিরল।
তাহলে কি বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কে আবার সবকিছু স্বাভাবিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে?
না, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। কারণ, এটা তো ঠিকই, বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দিতে আবারো অস্বীকার করেছে আমেরিকা। বঙ্গবন্ধুর খুনি বলে চিহ্নিত রাশেদ চৌধুরীকে ঢাকার হাতে বিচারের জন্য তুলে দেয়ার দাবিতেও তারা নিরুত্তর। কিন্তু এ রকম আরো অনেক দ্বিপক্ষীয় বিষয় আছে, যা শুধু মার্সিয়া বার্নিকাটের ওপর নির্ভর করে না। মার্কিন প্রশাসন আরো বহু ফ্যাক্টর খতিয়ে দেখেই সেসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে এমন অনেক জট রয়েও গেছে।
কিন্তু একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পক্ষে সম্পর্ক সহজ করে তোলার জন্য যেটুকু করা সম্ভব, বার্নিকাট তাতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছেন না। শেখ হাসিনাও আগের অভিমান আর ক্ষোভ ভুলে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে চাইছেন। দিলি্লস্থ ওই মার্কিন ডিপ্লোম্যাটের কথা ধার করেই তাই আবার বলতে হচ্ছে, 'এই পর্যায়ে এর চেয়ে পজেটিভ ডেভেলপমেন্ট আর কীই-বা হতে পারে?
শেয়ার করুন