গাজা সংকটে অগ্রগতি, শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ সম্পন্নের পথে
সবুজ সংকেত নেই তাই লিটন অধরা!
গাইবান্ধায় শিশু শাহাদাত হোসেন
সৌরভকে গুলিবিদ্ধ করার ঘটনায় অভিযুক্ত
সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে
গ্রেপ্তারে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে
এখনো সবুজ সংকেত মেলেনি। এই
সংকেতের অপেক্ষায় রয়েছে পুলিশ। এরই
মধ্যে এমপি লিটন বিদেশে পালিয়ে
যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে জানা গেছে।
তবে তিনি যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে
না পারেন সে জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
থেকে বিমানবন্দর, স্থলবন্দরসহ সংশ্লিষ্ট সব
স্থানে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একটি সূত্র জানায়, নিজ দল আওয়ামী
লীগের মধ্যেই এমপি লিটনকে গ্রেপ্তার
করা নিয়ে মতানৈক্য থাকায় শীর্ষ পর্যায়
থেকে সবুজ সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত
অপেক্ষা করছে পুলিশ।
সৌরভকে গুলির পর গতকাল বৃহস্পতিবার
পর্যন্ত সাত দিন পেরিয়ে গেছে। থানায়
মামলা হলেও গুলিবর্ষণকারী সংসদ সদস্য
লিটনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের তরফ থেকে
বলা হচ্ছে, পলাতক থাকায় এমপিকে খুঁজে
পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে,
এমপি লিটনকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে
পুলিশের পক্ষ থেকে অপেক্ষা করা হচ্ছে
শীর্ষ পর্যায়ের সবুজ সংকেতের।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন
কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কারো
বিরুদ্ধে মামলা হলে আসামি যাতে বিদেশে
পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য অ্যালার্ট
করে দেওয়া হয়।'
জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন
চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, সংসদের
বাইরে থেকে কোনো সংসদ সদস্যকে
গ্রেপ্তারের জন্য অনুমতির প্রয়োজন নেই।
তবে কোনো সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করতে
হলে তা স্পিকারকে অবহিত করার বিধান
রয়েছে। তিনি বলেন, সংসদ অধিবেশন
চলাকালে এবং অধিবেশনের আগে ও পরের
১৪ দিনে সংসদ সদস্য গ্রেপ্তারে একটি
আইনে নিষেধাজ্ঞা আছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান
সাংবাদিকদের বলেন, 'এমপি লিটনকে
আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যদি
তিনি আত্মসমর্পণ না করেন তাহলে তাঁকে
গ্রেপ্তার করা হবে।'
ওদিকে এমপি লিটন এখনো গ্রেপ্তার না
হওয়ায় স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও
হতাশা বাড়ছে। বিষয়টি অনিশ্চিত ও
ধোঁয়াটে থাকার কারণে প্রকাশ্যেই
লিটনের ক্যাডাররা আন্দোলনকারীদের
হুমকি দিচ্ছে। কেউ কেউ মন্তব্য করছেন,
দীর্ঘসূত্রতার মাধ্যমে বিষয়টি ধামাচাপা
দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে স্থানীয় পুলিশ
বলছে, পুরো ব্যাপারটি আইনগতভাবেই দেখা
হচ্ছে। এখানে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোনো
সুযোগ নেই।
এমপি লিটনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা
বলছে, তাদের কর্মকাণ্ডকে স্থবির করে
দিতেই লিটনের ক্যাডাররা মাঠে নেমেছে।
পুলিশ প্রভাবিত হয়ে সুন্দরগঞ্জের কোথাও
কাউকে মিছিল সমাবেশ করতে দিচ্ছে না।
অথচ ক্যাডার বাহিনী প্রকাশ্যে
মোটরসাইকেল মহড়া দিচ্ছে। কিন্তু তাদের
ব্যাপারে পুলিশ নীরব থাকছে।
এ ব্যাপারে সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি ইসরাইল
হোসেন বলেন, যেহেতু বিষয়টি মামলায়
গড়িয়েছে সে জন্য বিধিমোতাবেক
তদন্তকাজ এগিয়ে চলেছে। গ্রেপ্তারি
প্রক্রিয়াও অব্যাহত রাখা হয়েছে। তাই
এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার
স্বার্থে আন্দোলনের কোনো প্রয়োজন নেই।
সুন্দরগঞ্জের পরিবেশ শান্ত রাখার জন্যই
সবাইকে সভা সমাবেশ এবং মিছিল থেকে
বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হয়। এ
ক্ষেত্রে কারো দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার
কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
এদিকে গত বুধবার রাতে সুন্দরগঞ্জ থানা
থেকে জানানো হয়েছে, এমপি মঞ্জুরুল
ইসলাম লিটনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা
দায়ের করা হয়েছে। সর্বানন্দ ইউনিয়নের
উত্তর শাহবাজ গ্রামের এমপি লিটনের
প্রতিবেশী হাফিজার রহমান মণ্ডল নামের
এক ব্যক্তি বাদী হয়ে ওই মামলাটি দায়ের
করেন। এমপি লিটনকে এক নম্বর আসামি
করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ওই মামলা করা হয়।
বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও
লুটপাটের অভিযোগের কথা উল্লেখ করা
হয়েছে ওই মামলায়। গত ২ অক্টোবর শুক্রবার
শিশু সৌরভকে গুলি করার পর ওই দিন
সকালে বাড়ি ফেরার পথে এমপি লিটন
পিস্তলের একাধিক গুলি ছুড়ে তাঁর
লোকজনকে দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে
হাফিজারের বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। ওই
বাড়ির আসবাবপত্র, ঘরের বেড়া ও চালের
টিন খুলে নিয়ে এমপির মালিকানাধীন
আশরাফ কোল্ডস্টোরেজের মাঠে এবং কিছু
ব্যক্তির বাড়িতে সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয়।
হাফিজার মণ্ডল জানিয়েছেন, বাড়িতে
হামলার পর ঘটনাটি মোবাইল ফোনে
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসককে জানানো হয়।
জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সুন্দরগঞ্জ
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরেজমিনে
তদন্ত শেষে ওই দিন সন্ধ্যায় এমপির
হিমাগার থেকে টিন ও বিভিন্ন মালামাল
উদ্ধার করে তাঁকে ফেরত দেন। এমপি লিটন
ও তাঁর বাহিনীর তাণ্ডবে হাফিজারের
ক্ষতি হয়েছে প্রায় সোয়া তিন লাখ টাকা।
এ ব্যাপারে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তা আবদুল হাই মিল্টন জানান, তিনি
এমপি লিটনের হিমাগার থেকে হাফিজার
রহমানের বাড়ির টিন ও আসবাবপত্র
উদ্ধারের সময় উপস্থিত ছিলেন।
একটি সূত্রের দাবি, এমপি লিটন বর্তমানে
ঢাকায় অবস্থান করছেন। তাঁর সঙ্গে
আওয়ামী লীগের কারো কারো যোগাযোগ
রয়েছে। তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন
নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এ বিষয়ে
সাংবাদিকদের নজর থাকার কারণে দ্রুত
তিনি সেখানে যাচ্ছেন না। কিছু সময় পার
হওয়ার পর তিনি জামিন পেলে জনসমক্ষে
আসবেন। এর আগ পর্যন্ত তিনি আত্মগোপনেই
থাকবেন বলে সূত্র জানায়। তবে এর মধ্যে
শীর্ষ পর্যায়ের সবুজ সংকেত মিললে তাঁকে
গ্রেপ্তার করা হবে।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, এ মামলাটি
দায়েরের পর তৎপর হয়ে ওঠে লিটনের অনুগত
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা।
তারা হাফিজার মণ্ডলকে হুমকি দিতে শুরু
করে। গতকাল বৃহস্পতিবার গাইবান্ধায়
আদালত প্রাঙ্গণে মামলা প্রত্যাহারের জন্য
তাঁকে চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু মামলা
প্রত্যাহার করলে বাদীর শাস্তি হবে জানার
পর হাফিজার কোনো ধরনের আপসরফায়
যেতে রাজি হননি।
সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী
লীগের সভাপতি সমেস উদ্দিন বাবু বলেন,
হাফিজারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করা
হয়নি। জোরজবরদস্তি করে মামলা
প্রত্যাহারের চেষ্টার বিষয়টি সত্য নয়।
একটি মহল সাংবাদিকদের মিথ্যা তথ্য
দিয়েছে।
এদিকে এমপি লিটনকে গ্রেপ্তার ও
বিচারের দাবিসংবলিত পোস্টারে
পোস্টারে ছেয়ে গেছে সুন্দরগঞ্জ পৌর
শহরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা। তবে
আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে জানানো
হয়, লিটনের ক্যাডাররা বিভিন্ন জায়গা
থেকে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে।
তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম বলেন, টাকা
ছিটিয়ে, ক্যাডার নামিয়ে আন্দোলন বন্ধ
করা যাবে না। এমপিকে গ্রেপ্তার করে
দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে আন্দোলন
চলমান থাকবে। পাশাপাশি গণস্বাক্ষর
কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে।
এমপির বাড়ি নীরব : গতকাল দুপুরে
সুন্দরগঞ্জের সর্বানন্দ ইউনিয়নের উত্তর
শাহবাজ গ্রামে এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম
লিটনের বাড়ি ও সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা
গেছে, তাঁর দ্বিতল বাড়িটিতে সুনসান
নীরবতা বিরাজ করছে। নিচতলায় ও প্রধান
গেট দিয়ে গৃহপালিত পশু পরিচর্যাকারী ও
বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত দু-
তিনজন কর্মচারী আসা-যাওয়া করলেও লিটন
বা পরিবারের সদস্যরা কেউ সেখানে নেই।
লোকজনের উপস্থিতিও নেই। ক'দিন আগেও
মানুষে গম গম করতে থাকা বাড়িটি এখন
নিস্তব্ধ। কর্মচারীরা কেউ কথা বলতে
রাজি হয়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক
প্রতিবেশী জানান, ২ অক্টোবর শিশু
সৌরভকে গুলি করার ঘটনার পর থেকে
এমপি লিটন গা ঢাকা দেন। তাঁর স্ত্রী
জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম
আহ্বায়ক সৈয়দা খুরশিদা জাহান স্মৃতিও ওই
ঘটনার পর বাড়ি থেকে চলে যান।
স্থানীয় লোকজন জানায়, ওই ঘটনার পর
থেকে এমপি লিটনকে প্রকাশ্যে দেখা
যায়নি। তবে তারা জেনেছে, আশপাশের
এলাকায় দু-এক দিন থেকেই লিটন ঢাকায়
চলে যান। গতকালও মোবাইল ফোনে এমপি
লিটনকে পাওয়া যায়নি। তবে ফোনে জেলা
মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও
লিটনের স্ত্রী খুরশিদা জাহান স্মৃতি বলেন,
'সুন্দরগঞ্জ উপজেলাটি জামায়াত-শিবির
অধ্যুষিত এলাকা। ওই সব অপশক্তিকে
প্রতিহত করে আমার স্বামী জনগণের ভোটে
গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত
হয়েছেন। শিশু সৌরভের পায়ে গুলি লাগার
ঘটনায় লিটনের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী
সংস্থাগুলো কাজ করছে। কিন্তু এই ঘটনাকে
কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্ট
একটি মহল ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে।
পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা
আব্দুল্যাহ আল মামুন বলেন, আওয়ামী লীগের
পরীক্ষিত নেতাকর্মী ও প্রগতিশীল বিভিন্ন
দলের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকজন
লিটনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে
আন্দোলনে নেমেছে। তাদের জামায়াত-
শিবিরের সঙ্গে যুক্ত করার এই প্রবণতা
মেনে নেওয়া যায় না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক
কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গত
কিছুদিনে এমপি ও তাঁর আত্মীয়স্বজন যেসব
গুলির ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাতে দেশের
ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তিনি অন্যায় করেছেন;
তাঁকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা
উচিত।'
শেয়ার করুন