যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে “নো কিংস” বিক্ষোভের আগে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন
ঢাকা ও রংপুরে 'নিখোঁজ' ১২ সন্দেহভাজন
পরিবারের দাবি আটক, অস্বীকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর
'নিখোঁজ' হাসান আলী হিটলারের
পরিবারের পক্ষ থেকে আয়োজিত
সংবাদ সম্মেলনে স্ত্রী ও মায়ের
আহাজারি। ছবি : কালের কণ্ঠ
রাজধানীর গুলশানে
কূটনীতিকপাড়ায় ইতালির নাগরিক
সিজারে তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডে
সন্দেহভাজন কয়েকজনের হদিস মিলছে
না। তাদের পাঁচজনকে আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আটক
করেছেন বলে দাবি করছে স্বজনরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাদের
কোনো খোঁজ পায়নি পরিবার।
'নিখোঁজ' এই ব্যক্তিরা সবাই
রাজধানীর বাড্ডা এলাকার
বাসিন্দা। তবে তাভেল্লা হত্যা
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা
বলছেন, এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায়
এখনো কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করা
হয়নি।
অন্যদিকে রংপুরে জাপানের
নাগরিক কুনিও হোশি হত্যার ঘটনায়
স্থানীয় যুবদলের দুই নেতাকর্মী,
ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতা, এক
রিকশাচালকসহ সাতজনকে তুলে
নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সাদা
পোশাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার
সদস্যরা তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়ার পর
থেকে তাঁরা নিখোঁজ রয়েছেন বলে
অভিযোগ তুলেছে পরিবারের
লোকজন। আলাদা সংবাদ সম্মেলনে
এমন অভিযোগ তুলে তাঁদের ফিরিয়ে
দেওয়ারও দাবি জানানো হয়েছে।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তারা বলছে, কুনিও হত্যার ঘটনায় আটক
বিএনপি নেতা রাশেদ-উন-নবী খান
বিপ্লব ও কুনিওর ব্যবসায়িক অংশীদার
হুমায়ুন কবির হিরা জিজ্ঞাসাবাদে
কয়েকজনের নাম বলেছেন। পুলিশ
তাঁদের তথ্য যাচাই করে দেখছে।
মধ্য বাড্ডার বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি
তামজিদ আহম্মদ ওরফে রুবেল (২৯),
দক্ষিণ বাড্ডার বিএনপিকর্মী মো.
রাসেল চৌধুরী (৩৫), মধ্য বাড্ডার
সোহেল ওরফে ভাঙারি সোহেল (৩৫),
স্বাধীনতা সরণির শুটার জুয়েল (৩০) ও
মহানগর বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুমের
ভাই এম এ মতিনকে (৪৫) আটক করা
হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে
পরিবারের পক্ষ থেকে। তবে পুলিশ ও
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাঁদের আটক
করার অভিযোগ অস্বীকার করলেও
তাঁদের মধ্যে কয়েকজন তাভেল্লা
খুনের ঘটনায় সন্দেহভাজন বলে
জানিয়েছে গোয়েন্দা সূত্র।
চাঞ্চল্যকর তাভেল্লা খুনের মামলার
তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান ও
গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার
(ডিসি) মাহবুব আলম গতকাল কালের
কণ্ঠকে বলেন, 'এখনো কাউকে আটক বা
গ্রেপ্তার করা হয়নি। আপনারা বলতে
পারেন সন্দেহভাজনরা এবং যাদের
আমরা শনাক্ত করেছি তারা
গোয়েন্দা জালে বা নজরদারিতে
আছে। শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার
করতে পারব বলে আশা করছি।'
তাভেল্লা হত্যা মামলার তদন্ত
কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক জিহাদ
হোসেন বলেন, 'আটক বা গ্রেপ্তারের
কোনো খবর নেই। তা ছাড়া এই
তদন্তের বিষয়ে আমি কিছু বলতে
পারছি না।'
গত ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানের ৯০ নম্বর
সড়কে সিজারে তাভেল্লাকে গুলি
করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দুই যুবক
তাভেল্লাকে গুলি করে কাছেই
অপেক্ষমাণ একজনের মোটরসাইকেলে
করে পালিয়ে যায়।
জানা গেছে, তাভেল্লা খুনের
ঘটনায় সন্দেহভাজন যুবক দক্ষিণ বাড্ডার
ব-৮৯ বাসার বাসিন্দা শাহজাহান
চৌধুরীর ছেলে রাসেল চৌধুরী
স্থানীয় বিএনপির কর্মী। তাঁর বাসায়
গেলে স্বজনরা দাবি করে, ১৪ দিন
ধরে রাসেল নিখোঁজ। রাসেলের মা
আফরোজা আক্তার আভা জানান, তাঁর
স্বামী শাহজাহান চৌধুরী একটি
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী।
রাসেল আগে বিদ্যুৎ বিভাগে
ঠিকাদারি করতেন, বর্তমানে
বেকার। আফরোজা আক্তার দাবি
করে বলেন, "১০ অক্টোবর সকাল ১১টার
দিকে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে
একদল লোক এসে রাসেলকে তুলে
নিয়ে যায়। ওই সময় তারা রাসেলের
কাছে জানতে চায়, 'তোর পরনের
জিন্সের প্যান্ট, স্ট্রাইপ গেঞ্জি ও
কালো শার্ট কই?' ওই ব্যক্তিরা রাসেল
কী করে জানতে চায়। পরে 'পুলিশ'
আলমারি খুলে তল্লাশি চালায়।
একপর্যায়ে তারা রাসেলের দুই
হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দেয়। একজন
জিজ্ঞেস করে, 'তুই কোন দল করিস,
ছাত্রদল, না যুবদল?' পরে সাদা কাগজে
কিছু একটা লিখলেও তা কাউকে
পড়তে দেওয়া হয়নি। ওই কাগজে
রাসেলের বাবার স্বাক্ষর ও তাঁর
মোবাইল ফোন নম্বর নেয়।" রাসেলের
বাবা শাহজাহান চৌধুরী বলেন,
'ধরে নেওয়ার সময় তারা বলে যায়, ও
যদি অপরাধী না হয়, তাহলে ছেড়ে
দেওয়া হবে। অপরাধী হলে কোর্টে
দেওয়া হবে। এত দিন হয়ে গেল এখনো
কিছুই হয়নি। আমার ছেলে কোথায়,
কিভাবে আছে তা নিয়ে ভয়ে
আছি।'
সন্দেহভাজন হিসেবে নাম উঠে
এসেছে আরেক বিএনপিকর্মী
তামজিদ আহম্মদ ওরফে রুবেলের। তিনি
মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় তাঁর
মামা তৌহিদ মিয়ার বাসায়
থাকেন। রুবেলের গ্রামের বাড়ি
মানিকগঞ্জের বাগলি এলাকায়। তাঁর
বাবার নাম হারিস মোল্লা। রুবেলও
গত সোমবার থেকে নিখোঁজ। গত বুধবার
সন্ধ্যায় তাঁর মামা তৌহিদ মিয়া
বাড্ডা থানায় একটি সাধারণ
ডায়েরি করেন। তিনি গতকাল
কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার
ভাগিনা কোনো খারাপ কাজে
জড়িত তা শুনি নাই। সে মোবাইল ও
ইলেকট্রিক সামগ্রী মেরামতের কাজ
করত। গত সোমবার থেকে ওরে পাই না।
অনেক খুঁজছি। পরে দেখি পেপার-
পত্রিকায় নাম। তবে পুলিশ তো
আটকের কথা স্বীকার করে না।'
জানা গেছে, ঢাকা সিটি
করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের
সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপির
যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ কাইয়ুমের ছোট ভাই
এম এ মতিনও দুই দিন ধরে নিখোঁজ।
মতিনের স্ত্রী দিলরুবা মনি বলেন, গত
মঙ্গলবার রাতে এশার নামাজ শেষে
তাঁর স্বামী বাসায় ফিরছিলেন। মধ্য
বাড্ডার লিংক রোডে বাসার
সামনে পৌঁছলে আগে থেকে ওত
পেতে থাকা সাদা পোশাকের
কয়েক যুবক তাঁর গতি রোধ করে। কিছু
বুঝে ওঠার আগেই তাঁকে একটি সাদা
মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়।
দিলরুবার দাবি, এ ঘটনা দেখে
আশপাশের বাসিন্দা ও মতিনের
পরিবারের লোকজন এগিয়ে গেলে ওই
যুবকরা নিজেদের 'ডিবি পুলিশ' বলে
দাবি করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে
মতিনকে ছেড়ে দেওয়া বলে জানায়
তারা। পরে মতিনের স্বজনরা বাড্ডা
থানায় যায়। তবে এ ধরনের
অভিযানের খবর থানার পুলিশের
কাছে নেই বলে সেখান থেকে
জানানো হয়। দিলরুবা জানান,
গতকাল বিকেল পর্যন্ত তাঁর স্বামীর
খোঁজ মেলেনি। মতিন রাজনীতির
সঙ্গে যুক্ত নন, গার্মেন্ট ব্যবসা করেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়,
তাভেল্লা হত্যার ঘটনায় আরেক
সন্দেহভাজন দক্ষিণ বাড্ডার
স্বাধীনতা সরণির শিমুলতলা বাজার
এলাকার সন্ত্রাসী শুটার জুয়েল। ৯ দিন
ধরে জুয়েল নিখোঁজ বলে দাবি করছে
তাঁর স্বজনরা। জুয়েলের বাবা
সোহরাব বলেন, গত ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যায়
শিমুলতলা বাজার থেকে 'ডিবি
পুলিশ' জুয়েলকে ধরে নিয়ে যায় বলে
তিনি শুনেছেন। এরপর আর খোঁজ
মেলেনি।
আরেক সন্দেহভাজন মধ্য বাড্ডার
আদর্শনগরের ভাঙারি জিনিসপত্র
বিক্রেতা সোহেল ওরফে ভাঙারি
সোহেলের হদিস নেই চার দিন ধরে।
আদর্শনগরে ভাঙারি ব্যবসায়ী আবুল
কালাম বলেন, চার দিন ধরে
সোহেলকে দেখা যাচ্ছে না।
রংপুরে খোঁজ নেই সাতজনের : গত ৩
অক্টোবর রংপুরে জাপানি কুনিও
হোশি খুন হওয়ার পর ৪ থেকে ১৪
অক্টোবরের মধ্যে স্থানীয় যুবদলের দুই
নেতা, মৎস্যজীবী দলের নেতা
কামাল ও তাঁর এক ভাই, ছাত্রলীগের
এক সাবেক নেতা ও এক
রিকশাচালককে তুলে নেওয়া হয়েছে
বলে তাঁদের স্বজনদের অভিযোগ।
এখনো তাঁদের সন্ধান মেলেনি।
'নিখোঁজ' চারজন হলেন রংপুর মহানগর
যুবদলের সদস্য রাজীব হাসান সুমন ওরফে
মেরিল সুমন (২৮) ও নওশাদ হোসেন
রুবেল ওরফে ব্ল্যাক রুবেল (২৬), জেলা
ছাত্রলীগের সাবেক উপক্রীড়া
সম্পাদক হাসান আলী হিটলার (২৬),
রিকশাচালক মুন্নাফ এবং মুরাদ নামে
একজন।
নগরীর নিউ সেনপাড়া করনজাই
রোডের বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনে
হিটলারের মা হোসনে আরা বেগম
অভিযোগ করেন, ৫ অক্টোবর নগরীর
কাচারিবাজার এলাকা থেকে
হিটলারকে 'সাদা পোশাকধারী
পুলিশ' একটি মাইক্রোবাসে তুলে
নিয়ে যায়। হিটলারের স্ত্রী
সুলতানা পারভীন অভিযোগ করেন,
তাঁর স্বামীকে কারা তুলে নিয়ে
গেছে তা স্বীকার করছে না কেউ। এ
ঘটনায় তিনি কোতোয়ালি থানায়
একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি)
করেছেন।
গত ৭ অক্টোবর রংপুর প্রেসক্লাবে এক
সংবাদ সম্মেলনে মেরিল সুমনের
স্ত্রী সামিয়া আক্তার অভিযোগ
করেন, ৬ অক্টোবর সকালে ঠাকুরগাঁওয়ে
বাবার বাড়ি থেকে সুমনকে নিয়ে
রংপুর নগরীর শাহীপাড়ার বাড়িতে
ফিরছিলেন তিনি। দুপুর ১টায় বাস
হাজীরহাট বাসস্ট্যান্ডে থামলে
সাদা পোশাকে কয়েকজন সুমনকে
মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়।
পরিচয় জানতে চাইলে তারা আইন
প্রয়োগকারী সংস্থার লোক বলে
জানায়। এরপর র্যাব অফিস,
কোতোয়ালি থানা ও ডিবি
অফিসে খোঁজ করেও সুমনের সন্ধান
পাওয়া যায়নি। একই দিনে তাঁর সন্ধান
দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে
মানববন্ধনও করে এলাকাবাসী।
ব্ল্যাক রুবেলের বাবা আবদুল লতিফ
অভিযোগ করেন, ১০ অক্টোবর রাতে
রুবেলকে রাজশাহী শহরে তাঁর
শ্বশুরবাড়ি থেকে আইন প্রয়োগকারী
সংস্থার লোক পরিচয়ে তুলে নেওয়া
হয়। রুবেলের বাড়ি রংপুর নগরীর
জুম্মাপাড়ায়। সেই থেকে ছেলের
সন্ধান পাননি বলে জানান লতিফ।
'নিখোঁজ' মুরাদের ভাবি নূরজাহান
বেগম জানান, তাঁর স্বামী ব্যবসার
কাজে বাইরে থাকেন। সব কিছু
দেখাশোনা করেন দেবর মুরাদ। ঘটনার
সময় মুরাদ বাড়ির অদূরে গরুকে ঘাস
খাওয়াচ্ছিলেন। তখন 'পুলিশ' তাঁকে
তুলে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন,
'বাড়ির অন্য সবার মোবাইল ফোনও
নিয়ে গেছে পুলিশ। গত ১৯ দিন ধরে
মুরাদকে কোথায় রাখা হয়েছে, কী
করা হচ্ছে তার কোনো খোঁজ পাওয়া
যায়নি। থানায় খোঁজ নিয়েও কোনো
সন্ধান মেলেনি।'
পাটবাড়ী এলাকার রেললাইনের
বস্তির বাসিন্দা রিকশাচালক
মুন্নাফের মা ছকিনা বেওয়া বলেন,
'মুন্নাফকে আটক করার কারণে আমরা
খেয়ে না খেয়ে জীবন যাপন করছি।
পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে কোথায়
রাখল জানি না।' মুন্নাফকে ফিরিয়ে
দেওয়ার দাবি জানান তাঁর মা।
অভিযোগ অস্বীকার করে র্যাব-১৩
রংপুরের অধিনায়ক মেজর আবু ফারহান
করিম জানান, সাধারণত কাউকে তুলে
আনা হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে
পুলিশে সোপর্দ করা হয়। দীর্ঘদিন
আটকে রাখার বিধান নেই।
কোতোয়ালি থানার ওসি আবদুল
কাদের জিলানী বলেন, মেরিল সুমন,
ব্ল্যাক রুবেল ও হিটলার তালিকাভুক্ত
শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাঁদের নামে
থানায় হত্যা, সন্ত্রাস ও ছিনতাইয়ের
একাধিক মামলা রয়েছে।
শেয়ার করুন