সাত খুন মামলার ৯ বছর: নিহতদের পরিবার নিরাপত্তাহীনতায়
নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলার নয় বছরপূর্তি আজ (২৭ এপ্রিল) বৃহস্পতিবার। পাঁচ বছর আগে এ মামলায় ১৫ জনের ফাঁসির আদেশ হলেও আসামীদের সাজা আজও কার্যকর হয়নি। দীর্ঘদিন মামলাটি আপিল বিভাগে ঝুলে আছে।
এদিকে মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেনের লোকজন সিদ্ধিরগঞ্জে রয়েছেন বহাল তবিয়তে। যার ফলে নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারের লোকজন।
মামলার বাদি পক্ষের আইনজীবি বলছেন, এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামীপক্ষ একাকার হয়ে যাওয়ায় মামলাটি আপিল বিভাগ পার হতে পারছে না।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল, নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লা থানার লামাপাড়া থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন প্যানেল মেয়র ও ২ নাম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরন করে র্যাবের একটি দল। অপহরণের তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল নজরুল ইসলামসহ ছয় জনের এবং ১ মে সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীর নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার শান্তির চর সংলগ্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
এই ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ৪ নাম্বার ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং নয় জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজার রায় দেয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এই হত্যা মামলার রায়ের পর হাইকোর্ট ২০১৮ সালে ২২ অগাস্ট ২৬ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর মধ্যে ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। যাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয় তারা হচ্ছেন- সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, এ বি মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম।
অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। এরপর মামলাটির ব্যাপারে আপিল করা হয়। মামলাটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
অন্য ৬ জনের সঙ্গে খুন হওয়া নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নাম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম দুই ছেলে এক মেয়ে রেখে গেছেন। যখন তিনি নৃশংসভাবে খুন হন তখন বড় ছেলে তারিকুল ইসলাম নাঈম ছিল স্কুলের ছাত্র। এখন সে আই টি তে মাষ্টার্স পড়ছে অষ্ট্রেলিয়ায়। ছোট ছেলে জাহিদুল ইসলাম ফাহিম বিবিএ আর মেয়ে নাজিফা ইসলাম তানহা এইচএসসি পড়ছে।
নিহত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, ‘বড় ছেলে পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু কাজ করে। তার পাঠানো টাকা আর বাড়ি ভাড়া দিয়ে কোনো রকমে আমাদের সংসার চলে। তবে সংসার চালানোর চিন্তার চেয়েও বড় চিন্তা নিরাপত্তা নিয়ে।’
তিনি বলেন, ‘একদিকে মামলার রায় কার্যকর হচ্ছে না। অন্যদিকে নূর হোসেনের লোকজন সবই এলাকায় বহাল তবিয়তে আছে। তাদের প্রভাব কোনো অংশে কম নেই। ফলে তারা কখন কি করে এ নিয়ে আমরা চিন্তায় থাকি।’
মামলার অবস্থা সম্পর্কে বিউটি বলেন, ‘প্রায় পাঁচ বছর ধরে মামলা আপিল বিভাগে পড়ে আছে। আসামী পক্ষের লোকজনের প্রভাবে এটি শুনানির তালিকায় ওঠেনা। কবে আমরা বিচার পাবো জানি না।’
এদিকে মামলার বাদি পক্ষের আইনজীবি ও সে সময়ে জেলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি এডভোকেট শাখাওয়াৎ হোসেন জানান, আজ বৃহস্পতিবার সকালে এ মামলার রায় কার্যকর করার দাবীতে নারায়ণগঞ্জ জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গনে মানববন্ধন করেছি আমরা। সেখানে আমরা আইনজিবীরা এই মামলার রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবী জানিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ‘আপিল ডিভিশনে এ মামলা শুনানির অপেক্ষায় আছে। মামলায় আসামী পক্ষ, রাষ্ট্রপক্ষ একাকার হয়ে গেছে। আসামীরা সরকারের সুবিধাভোগি লোকের অংশ। তারা শুনানি দেরি করাচ্ছে। আসামীরা জেলে থাকলেও সিদ্ধিরগঞ্জে নূর হোসেনের লোকজন প্রভাব বিস্তার করে আছে। ফলে নিহতদের পরিবারের লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় আছে।’
এ মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেনের ছোট ভাই নুরুদ্দিন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ৪ নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর। নূর হোসেনের ভাতিজা শাহ জালাল বাদলও ৩ নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন