পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য,
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার
নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য এবং
আপত্তিকর প্রতিক্রিয়া জানানো
অব্যাহত রাখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের সঙ্গে
শিক্ষাসংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় সব
ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এ
সিদ্ধান্তের ফলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম
সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন
থেকে পাকিস্তানের কোনো
বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাডেমিক
এক্সচেঞ্জ বা সমঝোতা স্মারক সই
করবে না। বিদ্যমান চুক্তিগুলোও
স্থগিত রাখা হবে। দেশটি যদি তার
কৃতকর্মের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা
প্রার্থনা করে, তাহলেই শুধু ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় বৈঠকে বসে পরবর্তী
সিদ্ধান্ত নেবে। শহীদ বুদ্ধিজীবী
হত্যার শোকাবহ দিনটিতে গতকাল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি
সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া
হয়। পরে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন
সিদ্দিক সাংবাদিকদের জানান,
সভায় একাত্তরে বর্বরতার দায়ে
অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানির
বিচার করার জন্য ইসলামাবাদ
সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
উল্লেখ্য, একাত্তরের ২৫ মার্চ
কালরাতে অন্যান্য স্থানের মতো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ভয়ংকর
হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল
পাকিস্তানি বাহিনী। বুলেটে ঝাঁঝরা
করে দিয়েছিল শিক্ষক-
শিক্ষার্থীদের।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ
রেজাউর রহমান বলেন, ভাষা
আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাস্তায়
নেমেছিল। সেই থেকেই পাকিস্তান
বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি
বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়
বিশ্ববিদ্যালয়টি। মুক্তিযুদ্ধের শুরু ও
শেষে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নেমে
আসে চরম আঘাত। অগণিত শিক্ষক,
শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাকে হত্যা করা
হয়। কিন্তু সেই দায় দেশটি অস্বীকার
করে চলায় দীর্ঘদিন পরে হলেও
দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ও সত্য
প্রতিষ্ঠায় তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন
করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ
সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন
মুক্তিযুদ্ধসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন ও
বিশিষ্টজনরা। তাঁরা এই অনন্য
সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করে
রাষ্ট্রীয়ভাবেও পাকিস্তানের সঙ্গে
সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান
জানিয়েছেন। বাংলাদেশে এ মতের
পক্ষে দাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে
উঠছে।
ঢাবি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত :
একাত্তরের মার্চে জেনারেল
ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী
ভুট্টো বাঙালিদের দমনের অভিযান
‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করেন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর গোটা
মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতেই এ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে বয়ে যায়
পাকিস্তানি বাহিনী ও তার এ
দেশীয় দোসরদের নারকীয় তাণ্ডব।
স্বাধীনতার ঊষালগ্নে এ
বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা
বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের হত্যা করা
হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ
থেকে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে প্রথম
বুলেটের আঘাত ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে; আবার শেষ
আঘাতটিও। কিন্তু পাকিস্তান সেই
গণহত্যার দায় অস্বীকার করছে।
কাজেই দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ও
সত্য প্রতিষ্ঠা করতে সম্পর্ক ছিন্ন
করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
গতকাল সোমবার দুপুরে
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ
সিন্ডিকেট সভা ডেকে এ সিদ্ধান্ত
নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। উপাচার্য আ আ ম
স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে
সভায় প্রস্তাবটি তোলা হয়। এরপর
দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা শেষে সম্পর্ক
ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়। পরে
বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী
চৌধুরী সিনেট ভবন লাউঞ্জে সংবাদ
সম্মেলন করে এ বিষয়ে জানান
উপাচার্য। এর আগে ১ ডিসেম্বর
বিজয়ের মাসের শুরুতে
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা
চিরন্তনে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েও
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন
করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন উপাচার্য।
সিদ্ধান্ত অনুসারে, একাত্তরে
গণহত্যার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা
প্রার্থনা না করা পর্যন্ত ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের সঙ্গে
বিদ্যায়তনিক, গবেষণামূলক,
সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়াকেন্দ্রিক
সব ধরনের যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিন্ন
করছে। এখন থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে শিক্ষক কিংবা
ছাত্রছাত্রীদের কোনো
প্রতিনিধিদল পাকিস্তানে যাবে না
এবং দেশটির সঙ্গে কোনো শিক্ষা
বিনিময় কার্যক্রম পরিচালিত হবে
না।
সিন্ডিকেট সভায় স্বাধীনতাযুদ্ধের
সময় নারকীয় গণহত্যাযজ্ঞে
নেতৃত্বদানকারী চিহ্নিত ১৯৫ জন
(জীবিত/মৃত) পাকিস্তানি সেনা
কর্মকর্তার যথাযথ বিচার ও শাস্তি
প্রদান এবং দেশটির সঙ্গে
দ্বিপক্ষীয় ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন
করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের
প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ
বিষয়ে বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে
হস্তক্ষেপ করায় সার্কের সদস্যপদ
থেকে পাকিস্তানকে বহিষ্কার এবং
গণহত্যা সংঘটিত করে মিথ্যাচার
করায় জাতিসংঘের সদস্যপদ থেকে
দেশটিকে বহিষ্কারের জন্য
সংশ্লিষ্ট সংস্থা দুটিতে আনুষ্ঠানিক
অভিযোগ আনতে বাংলাদেশ
সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
পরে এক সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন,
একাত্তরে গণহত্যাকারীরা এই
ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষকদের ধরে
নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। সেই
ঘটনার প্রমাণ বিশ্ববিদ্যালয়সহ
বিশ্বের বিভিন্ন আর্কাইভে
সংরক্ষিত আছে। তবে সেই সত্যের
বিপরীতে মিথ্যাচার করছে
পাকিস্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব
সময় সত্য অনুসন্ধানে নিয়োজিত।
কাজেই এ ধরনের মিথ্যাচারের সঙ্গে
আপস সম্ভব নয়। তিনি পাকিস্তানের
সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সমঝোতা
স্মারক বা চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা
দেন। তিনি বলেন, যেসব শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা
করছে তারা কার্যক্রম চালিয়ে
যাবে। তবে নতুন করে পাকিস্তানের
কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে না
কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো
শিক্ষার্থীকে পাকিস্তানে পাঠানো
হবে না। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু
ভাষার শিক্ষা কার্যক্রম চলবে।
সিন্ডিকেট সদস্য লুত্ফর রহমান বলেন,
দেশের সব কিছুতেই ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন
করেছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানি
বাহিনী হামলা চালিয়েছে, শেষেও
হামলা হয়েছে এখানে। কিন্তু সেই
সত্য অস্বীকার করায় এ সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয়েছে। ঢাবির
ধারাবাহিকতায় অন্য
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সেদিকেই
অগ্রসর হবে। দেশের
সরকারপ্রধানকেও পাকিস্তানের
সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পরামর্শ
দেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন
করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে
জানিয়েছেন বাংলাদেশ
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
ফেডারেশনের সভাপতি ও সিন্ডিকেট
সদস্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণ
করার আহ্বান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তকে
স্বাগত জানিয়েছেন শহীদজায়া
শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। কালের
কণ্ঠকে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি
বলেন, ‘এ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে
আমি স্বাগত জানাই। ২৩ বছর শোষণের
পর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা
আমাদের ধ্বংস করে দেওয়ার সব রকম
চেষ্টা করেছে। কিন্তু ব্যর্থ হলেও
তাদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি।
আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের
বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিষোদ্গার করে
আসছে দেশটি। যুদ্ধাপরাধীদের
ন্যায়সংগত বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে
এবং গণহত্যা অস্বীকার করে ওরা
ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। তাদের সঙ্গে
সম্পর্ক রাখার আর কোনো সুযোগ নেই।
রাষ্ট্রীয়ভাবেই সম্পর্ক ছিন্ন করা
উচিত।’
এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে
গণজাগরণ মঞ্চও। মঞ্চের আহ্বায়ক
ইমরান এইচ সরকার বলেন, শুধু ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এ দেশের প্রত্যেক
মানুষ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও
সরকারের উচিত পাকিস্তানের সঙ্গে
সব সম্পর্ক ছিন্ন করা। যত দিন
পাকিস্তান তার ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য
প্রত্যাহার করে গণহত্যার দায়
স্বীকার না করে, তত দিন তাদের
সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের
সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ
ফরাসউদ্দিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা
হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন,
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তারা
তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে,
এর যৌক্তিকতা নিশ্চয়ই আছে। তবে
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন সিদ্ধান্ত
অনেক ভেবেচিন্তে নিতে হবে। কারণ
পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের
ন্যায্য হিস্যা আদায়ের বিষয়
রয়েছে।’
একাত্তরে গণহত্যার দায় অস্বীকার ও
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে মন্তব্যের
জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি
উঠেছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসেও।
গতকাল মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ
ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদ
বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে
আসা মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ,
শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী কিংবা
সাধারণ মানুষ সবার মুখেও ছিল এই
দাবি। তাঁরা বলেছেন, পাকিস্তানকে
ক্ষমা চাইতে হবে।
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে
সাম্প্রতিক ‘কটূক্তি’র জন্য
পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে বলে
দাবি করেন নৌমন্ত্রী শাহজাহান
খান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দ্বিতীয়
পর্যায়ের আন্দোলন হবে, ১৯৭১ সালে
যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে
পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল
তাদের বিচারের জন্য।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ
সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ অবশ্য
মনে করছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে
সম্পর্ক ‘অনেক আগেই’ ছিন্ন হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ওদের সঙ্গে ১৯৭১
সালেই আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে
গেছে। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই
আমরা দেশ স্বাধীন করেছি।
পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র, একে
নিয়ে ভাবার সময় আছে বলে মনে করি
না।’
গত ২২ নভেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী
বদরপ্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ
মুজাহিদ ও যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন
কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকরের পর
‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়
পাকিস্তান। এরপর ঢাকায়
পাকিস্তানি হাইকমিশনারকে ডেকে
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কড়া
প্রতিবাদ জানানো হয়। এর এক
সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানও
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত
হাইকমিশনারকে ডেকে একাত্তরে
গণহত্যার দায় অস্বীকার করে। এ
ধরনের ঘটনাকে বাংলাদেশের
অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানের
‘নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ’ আখ্যায়িত করে
দেশটির সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক
সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়ে
আসছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম,
গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন।
স্বাধীনতার স্বপ্ন ও চেতনার
সূতিকাগার বলা হয় ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়কে। বায়ান্নর ভাষা
সংগ্রাম থেকে শুরু করে একাত্তরের
মুক্তিযুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের
রয়েছে স্বর্ণোজ্জ্বল ভূমিকা ও
ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে
পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন
সার্চলাইট অভিযানে প্রথম রক্ত
ঝরেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘ
৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়
অর্জনের প্রাক্কালেও ১৪ ডিসেম্বর
রক্ত ঝরেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম পরিচয়
পাওয়া গেছে তাঁদের মধ্যে শিক্ষক
রয়েছেন ১৯ জন, ছাত্র ১০১ জন,
কর্মকর্তা একজন ও কর্মচারী ২৮ জন।
এ ছাড়া বিভিন্ন একাডেমিক ভবন,
ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের বাসভবনসহ
গোটা এলাকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত
করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।
পাকিস্তানি বাহিনীর বুলেটের
আঘাতে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী,
ইংরেজি বিভাগের জ্যোতির্ময়
গুহঠাকুরতা, দর্শন বিভাগের
গোবিন্দচন্দ্র দেব, অনুদ্বৈপায়ন
ভট্টাচার্য, আনোয়ার পাশা ও গিয়াস
উদ্দিনের মতো খ্যাতনামা
শিক্ষকদের প্রাণ দিতে হয়েছে। শুধু
শিক্ষকরাই নন, মেধাবী
শিক্ষার্থীরাও প্রাণ দিয়েছেন
অকাতরে। মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের
স্মরণে প্রতিটি হল, অনুষদে স্থাপন
করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ। হলের
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়
কেন্দ্রীয়ভাবে নিহত শিক্ষক,
শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের
স্মরণে ‘স্মৃতি চিরন্তন’ সৌধ স্থাপন
করেছে। এই স্মৃতিসৌধে ১৯৫ জন
শহীদের নাম রয়েছে।
১৯৫ পাকিস্তানি সামরিক
কর্মকর্তার বিচার দাবি
একাত্তরের অপরাধের জন্য
পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে
বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার
আহ্বান জানিয়েছে সেক্টর
কমান্ডারস ফোরাম। একই সঙ্গে সাকা
ও মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর
পাকিস্তান সরকার যে বিবৃতি
দিয়েছে তাও প্রত্যাহারের দাবি
জানানো হয়েছে। আর গণহত্যার দায়ে
অভিযুক্ত ১৯৫ পাকিস্তানি সামরিক
কর্মকর্তার বিচার এবং একাত্তরে এ
দেশের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য
ক্ষতিপূরণেরও দাবি জানিয়েছে
ফোরাম।
গতকাল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম
পাকিস্তান হাইকমিশনারের কাছে
দেওয়া প্রতিবাদলিপিতে এসব দাবি
জানিয়েছে। সকাল ১১টায়
প্রতিবাদলিপি দিতে রায়েরবাজার
বধ্যভূমি থেকে মিছিল নিয়ে রওনা হন
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের
নেতারা। দুপুর সাড়ে ১২টায় বনানী
মাঠের কাছে মিছিলটি আটকে দেন
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর
সদস্যরা। এরপর তিন সদস্যের
প্রতিনিধিদল হাইকমিশনে গিয়ে
প্রতিবাদলিপি দিয়ে আসে। তাঁদের
মধ্যে ছিলেন সেক্টর কমান্ডারস
ফোরামের চেয়ারম্যান মেজর
জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ,
সিনিয়র সহসভাপতি লে. জেনারেল
(অব.) এম হারুন অর রশিদ ও মহাসচিব
হারুন হাবীব।
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে,
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যাঁদের
অভিযুক্ত করা হচ্ছে বা যাঁরা এ
পর্যন্ত দণ্ডিত হয়েছেন তাঁরা সবাই
বাংলাদেশের নাগরিক। এ বিচারটি
অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশের নিজস্ব
আইনে। ফোরাম বলেছে, ‘আমরা
বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ এ কারণে যে,
পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়া স্পষ্টতই
আসামিদের মতকেই প্রতিফলিত করে
যাচ্ছে। এ নিয়ে পাকিস্তান
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
পুরোপুরি অযৌক্তিক এবং তা
স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ
ব্যাপারে হস্তক্ষেপ। তাই
পাকিস্তানের ওই বিবৃতি প্রত্যাহার
ও একাত্তরে নিরীহ, নিরস্ত্র
বাংলাদেশিদের ওপর চালানো
বর্বরতার জন্য পাকিস্তানকে
নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে।’
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম দাবি
জানিয়েছে, একাত্তরে যে ১৯৫ জন
পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা
গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন,
তাঁদের বিচার করতে হবে এবং
বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত
পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে
হবে।
মিছিল শুরুর আগে সেক্টর কমান্ডারস
ফোরামের সিনিয়র সহসভাপতি লে.
জেনারেল (অব.) হারুন অর রশিদ
বলেন, ১৯৭১ সালে যে বর্বরতা
সংঘটিত হয়েছিল, সেটি
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সেই
বর্বরতার বিচার শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের
মাধ্যমে এই বিচারকাজ সম্পন্ন হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, পাকিস্তান অত্যন্ত
দুঃখজনকভাবে সর্বোচ্চ আদালতের
রায়কে অবজ্ঞা করছে। যাঁদের
শাস্তি হয়েছে তাঁদের হয়ে কাজ
করছে, তাঁদের পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছে।
এতে প্রমাণিত হয়, মানবতাবিরোধী
অপরাধে অভিযুক্তরা পাকিস্তানের
দোসর।
শেয়ার করুন