সরকার বিদ্যুৎ দিলো, কিন্তু আমার মেয়ে কীভাবে বাঁচবে?
বরগুনার তালতলী উপজেলার অংকুজানপাড়া গ্রাম এখন আর সেই চিরচেনা গ্রাম নেই। যেখানে এক সময় বাতাস ছিল মুক্ত, নদী ছিল শান্ত। সেখানে আজ বিষাক্ত ধোঁয়া,ক্ষতিকর পরিবেশ ও বিপন্ন জীবন ছাড়া যেন কিছুই নেই। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে যেন এক অবিরাম অভিশাপের ছায়া পড়েছে এখানকার প্রতিটি ধূলিকণায়। এখন আর আশার আলো নয় এই ৩০৭ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদন। বরং দেখা দেয় এক ভয়ানক কালো ধোঁয়ার বিষাক্ত ছায়া, যা ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে গ্রামবাসীর জীবনকে।
তালতলী গ্রামের নূরজাহান বেগমে চোখের অশ্রু মুছে প্রতিবেদকের কাছে প্রশ্ন করেন, সরকার বিদ্যুৎ দিলো, কিন্তু আমার মেয়ে কীভাবে বাঁচবে? মায়ের কোলে শুয়ে আছে পাঁচ বছরের সামিয়া। বিভিন্ন জায়গায় লাল দাগ শরীরের চর্মরোগের কারণে। তবে ডাক্তার দেখানোর টাকা নেই।
একসময় যেখানে প্রাণবন্ত বাতাস ছিল, সেখানে এখন বিষাক্ত কয়লার ধোঁয়া দেখা দিয়েছে। এই ছোট্ট শিশু, মা, হাজারো মানুষের দিনযাপন শুধুই এক শ্বাসরুদ্ধকর যন্ত্রণা-তবে প্রশাসনের দৃষ্টি নেই কোথাও।
চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রাশাবুল আলম কল্প জানান, বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড ও পার্টিকুলেট ম্যাটারের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে ত্বক ও শ্বাসতন্ত্রে। এটি শিশুদের জন্য যেমন মারাত্মক, ঠিক তেমনি শ্বাসকষ্টে ভুগছেন বৃদ্ধরাও।
তালতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক চিকিৎসক বলেন, গত দুই মাসে চর্মরোগী ও হাঁপানির রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। শুধু মানুষই নয় বরং প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যও এতে আক্রান্ত।
একরাশ হতাশা নিয়ে মৎস্যজীবী মনিরুল ইসলাম বলেন, নদীতে আর মাছ নেই। মাছের জন্য হুমকির সৃষ্টি করছে কয়লার ধোঁয়া ও দূষিত পানি। শুধু ময়লা আর মরা মাছ উঠে কোনো জাল ফেললেই।
গ্রামে গ্রামে কৃষকরা বলছেন,ফসল আর ভালোভাবে ফলছে না। শরীর দুর্বল হয়ে গেছে দূষিত বাতাসে। খেতের ফলন কমে গেছে, গাছও মরে যাচ্ছে। আমাদের জমি আর আমাদের জীবিকা সবই হুমকির মুখে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ এন্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের শিক্ষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, এই কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ আমাদের নদী ও সাগরের পানির গুণমানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। অ্যালুমিনিয়াম, মিথেন,সালফার ডাইঅক্সাইড ও ভারী ধাতু পানিতে মিশে জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য বিপদ তৈরি করছে। মাছের জীবনচক্রও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে, উপকূলীয় অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত করতে পারে আমাদের।
প্রতিবাদী পরিবেশ কর্মী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আমাদের জীবন ও পরিবেশের কথা ভাবা হয়নি এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করার আগে। অথচ, প্রশাসন, বিশেষজ্ঞ, সাধারণ মানুষ-সবাই জানেন, এই প্রকল্পের শুরুতে বলা হয়েছিল বিদ্যুৎ আসবে, আলো ছড়াবে। কিন্তু কী মূল্য দিয়ে সেই আলো আসলো? মানুষের জীবন, শ্বাসপ্রশ্বাস, স্বাস্থ্য এবং মৎস্যজীবী ও কৃষকদের জীবিকা।
তালতলীর সমন্বয়ক মো. আরিফুর রহমান জানান, বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছি আমরা। মানববন্ধনও করেছি। কিন্তু কানে তুলছেন না প্রশাসন। পরিবেশের জন্য বিশেষ করে জলজ প্রাণী ও মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন।
সরকারের আশ্বাস, জনগণের ক্ষোভ
তালতলী আজ কাঁদছে, কিন্তু কোথায় সেই আশার আলো? রাগে ক্ষোভে বৃদ্ধ সুলতান সিকদার বলেন, বিদ্যুৎ তো আসলো, তবে জীবন তো কেউ ফেরাবে না আমাদের। কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ দিচ্ছে ঠিকই সরকার, তবে তার বিনিময়ে কেন বিসর্জন দিতে হবে আমাদের জীবন?
উন্নয়ন বা মৃত্যু?
এই প্রশ্ন যেন আজ তালতলীকে ঘিরে রেখেছে-কয়লার বিদ্যুৎ চাই, নাকি বেঁচে থাকার অধিকার? সরকার উন্নয়ন চায়, তবে যদি মানুষের স্বাস্থ্য, জীবন, এবং ভবিষ্যৎই বিলীন হয়ে যায় সেই উন্নয়নের বিনিময়ে, তাহলে সত্যিকার অর্থে সেই উন্নয়ন কি প্রগতির সূচনা হতে পারে?
এখন তালতলী গ্রামবাসী শুধু একটি শব্দেই রুদ্ধ হয়ে আছেন-বাঁচাও!
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন