"ন্যায়বিচারহীন আইন সমাজে বৈধতা পায় না"
হঠাৎ ছন্দপতন। পাসের হার কমেছে, কমেছে মোট জিপিএ ৫-এর সংখ্যা। ১০ জুলাই ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর থেকে আলোচনা-সমালোচনার শুরু। এখনও চলছে। ১১টি বোর্ডে গড়ে পাসের হার ৬৮.৪৫, জিপিএ ৫ পেয়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন (২০২২ সালে পাসের হার ৮৭.৪৪, জিপিএ ৫ পেয়েছিল দুই লাখ ৬৯ হাজার ৬০৬ জন)। শিক্ষা বোর্ড সূত্রের খবর, গত বছর পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে পরীক্ষার্থীদের ৫ নম্বর পর্যন্ত গ্রেস নম্বর দেওয়া হতো। এবার সে সুযোগ রাখা হয়নি। এতে মোট ১৯ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৩ লাখ পাস করে আর ফেল করে ৬ লাখ। তার মানে অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর এক-তৃতীয়াংশ অকৃতকার্য। এ নিয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ক্ষোভ, অসন্তোষ ও দুর্ভাবনার শেষ নেই।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে তৃতীয় বিভাগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন এমন বহু উদাহরণ আছে। আধুনিক বাংলা উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্নাতক পাস করেছিলেন ‘গ্রেস নম্বর’ নিয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট তিনি।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রহসনমূলক এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার কথা সবাই জানেন। ব্যাপক নকল (গণটোকাটুকি), পাসের উচ্চহার (শতকরা ৯০ ভাগের বেশি) ও প্রথম বিভাগের ছড়াছড়ি (এসএসসিতে ৭০ হাজার ও এইচএসসিতে ১২ হাজার প্রথম বিভাগ) গোটা জাতিকে এক নতুন ভাবনায় ফেলে দেয়। অবশ্য সরকারের কঠোর পদক্ষেপে পরীক্ষা তথা শিক্ষাব্যবস্থা দ্রুতই ছন্দে ফিরে আসতে শুরু করে। এমন কঠোরতার মাঝেই আমি ১৯৭৫ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিই। রক্ষীবাহিনীর কড়া পাহারায় অনুষ্ঠিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই খবর হয়– গ্রেস না দিলে ফল বিপর্যয় অনিবার্য। এ নিয়ে বৈঠকের পর বৈঠক; শেষ পর্যন্ত গ্রেস নম্বর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ঠিক কত বিষয়ে এবং সর্বোচ্চ ৪০ নাকি ৫০ কত নম্বর পর্যন্ত গ্রেস দেওয়া হয়েছিল, তা সঠিক আমার মনে নেই। এমন পরীক্ষার্থী সম্পর্কেও আমি জানি, যে কিনা সে বছর ইংরেজি প্রথম পত্রে ২৬, সাধারণ বিজ্ঞানে ২৫ এবং অর্থনীতিতে ১৬ নম্বর পায়। এভাবে তার প্রাপ্ত মোট নম্বর হয় ৩০৯, যেখানে পাস করতে হলে পেতে হতো প্রতি বিষয়ে ৩৩সহ মোট ৩৩০। তিনটি বিষয় বা পত্রে গ্রেস নম্বর দেওয়া ও যোগ করাতে তার মোট নম্বর হয় ৩৪১ (ইংরেজি প্রথম পত্রে ০৭, সাধারণ বিজ্ঞানে ০৮ ও অর্থনীতিতে ১৭)।
এ বছর উত্তরপত্র কড়াভাবে দেখা হয়েছে। বোর্ডসংশ্লিষ্টরাই বলেছেন, উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় কে কত নম্বর পেয়ে ফেল করল আর কে এক-দুই নম্বরের জন্য এ প্লাস বা ওপরের গ্রেডটি পেল না, সেসব বিবেচনা করা হয়নি। তারা এটিকে ‘শূন্য উদারনীতি’ ও ‘প্রকৃত ফল’ বলেও উল্লেখ করেছেন। আইন ও বিধি অনুযায়ীই সব করা হয়েছে।
তবে ন্যায় রক্ষার জন্যই তো আইন। তাই আইন রক্ষার জন্য ন্যায়কে বিসর্জন দেওয়া ঠিক না। প্রায় পৌনে দুইশ বছরের (১৮৫৮-২০২৪) ‘উদার নীতি’র ধারাবাহিকতাকে কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়া হঠাৎ করে ছুড়ে ফেলে দেওয়া, যে যা-ই বলুন, সাধারণ কিংবা সামান্য ঘটনা নয়। সরকারের এ কঠোর নীতি জানা থাকলে চিরাচরিত ‘উদার নীতি’ অনুসরণ করে বিদ্যালয়গুলো পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের পাঠাত না, নিচের শ্রেণিগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের অবলীলায় ওপরে উঠতে দেওয়া হতো না। সরকারের এ কঠোর নীতির সুফল পেল বড় বড় শহরের নামিদামি কিছু প্রতিষ্ঠান, আর বলি হলো তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া বিশেষত গ্রাম ও মফস্বল শহরের অধিকাংশ বিদ্যালয়। শিক্ষায় এ যুগ-যুগের বৈষম্য জিইয়ে রেখে গ্রেস নম্বর তুলে দেওয়ার নীতি কতটা ন্যায্য, সে প্রশ্ন এখন তোলাই যায়।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন