১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর সেনানিবাসে কী ঘটেছিল
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার। সকাল পৌনে ছয়টা বাজে। দরজার কলবেলের একটানা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।
ড্রয়িংরুমের দরজা খুলে দেখি ২য় ফিল্ডের সিও মেজর রশিদ এবং সেনাসদরের একজন স্টাফ অফিসার মেজর আমীন আহম্মেদ চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন। আমীন সিভিল ড্রেসে কিছুটা উদ্ভ্রান্ত, বিমর্ষ। শান্ত-নিরুত্তাপ গলায় রশিদ বললেন, ‘উই হ্যাভ ডান ইট। শেখ মুজিব হ্যাজ বিন কিলড।’
সদ্য ঘুম থেকে উঠে এ ধরনের ভয়াবহ সংবাদ শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় দৃষ্টিতে আমীনের দিকে তাকালাম। এঁরা দুজন বন্ধু, পিএমের কোর্সমেট এবং আমার সিনিয়র। আমীন নিশ্চুপ রইলেন। বাইরে তাকিয়ে দেখি এক গাড়ি ভর্তি আর্টিলারি সৈনিক রশিদের সঙ্গেই আমার বাসার গেট খুলে প্রবেশ করেছে। ড্রয়িংরুমের বাইরেই তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
রশিদ আদেশের সুরে বললেন, ‘আমি কমান্ডারের (কর্নেল শাফায়াত) কাছে যাচ্ছি। তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে।’ ইতিমধ্যে রাইফেলধারী দুজন সৈনিক আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে আমার ড্রয়িংরুমে ঢোকে। রশিদের নির্দেশ পেলেই তারা আমাকে গুলি করবে কিংবা বন্দী করবে, এমনটি মনে হলো। রশিদের কথা শুনে আমি হতভম্ব, বলে কী! প্রেসিডেন্টকে হত্যা করে এমনভাবে বলছে, যেন কিছুই হয়নি। আমি একটু সময় নিয়ে ধাতস্থ হওয়ার জন্য বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি ইউনিফর্ম পরে আসছি।’
দ্রুত ইউনিফর্ম পরে নিলাম। ভাবলাম এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমার প্রথম কাজ ব্রিগেড কমান্ডারকে ঘটনা সম্পর্কে জানানো। সুতরাং তাঁর কাছেই যাব। রশিদের প্রস্তাবে রাজি না হলে এরা যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। আমি একেবারেই নিরস্ত্র, বাসায় কোনো গার্ডও নেই। স্ত্রী ঘুমিয়ে আছে। তাকেও জানালাম না।
আমার বাসা সেনানিবাসের মেইন রোডের পাশেই। রাস্তার উল্টো দিকেই ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়ার বাসা। জিয়ার বাসার পেছনের রাস্তার ওপারেই ৫০ গজ দূরে কমান্ডার কর্নেল শাফায়াতের বাসা। রশিদের কথামতো বাসা থেকে বেরিয়ে আমি ও আমীন আহম্মেদ তাঁর জিপে উঠলাম। গাড়িভর্তি সৈনিকেরাও আমাদের ফলো করে।
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ব্রিগেড কমান্ডারের বাসায় পৌঁছে গেলাম। রাস্তায় কোনো জনপ্রাণী নেই, সবাই তখনো সুখনিদ্রায় বিভোর। কমান্ডারের বাসায়ও ২য় ফিল্ডের সৈনিকেরা গার্ড ডিউটি করছে। আমি কলবেল বাজাতেই ব্যাটম্যান দরজা খুলে দিল। আমরা ড্রয়িংরুমে সোফায় বসলাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যে লুঙ্গি-শার্ট পরা কর্নেল শাফায়াত ড্রয়িংরুমে এসে বললেন, ‘কী ব্যাপার?’
‘স্যার, উই হ্যাভ কিলড প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব। আমাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অ্যাকশনে যাবেন না। গেলে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে।’ বলেই কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে রশিদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মিনিট দশেকের মধ্যে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের সব অফিসার সিওর অফিসে সমবেত হলেন। সবার চোখেমুখে উত্তেজনা। একজন বললেন, তিনি সৈনিক ব্যারাকের পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময় রেডিওতে মেজর ডালিমের ঘোষণা শুনেছেন, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। কমান্ডার জিজ্ঞেস করলেন, ‘সৈনিকদের রিঅ্যাকশন কী?’ ‘তারা উল্লাসধ্বনি দিচ্ছে, আনন্দ প্রকাশ করছে,’ অফিসারের সংক্ষিপ্ত জবাব।
শাফায়াতও হতভম্ব। আমাকে ও আমীনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রশিদ এসব কী বলছে?’এমন সময় তাঁর বেডরুমে রেড ফোন বেজে ওঠে। তিনি ফোন ধরতে গেলেন। মিনিট দুয়েক পর ফিরে এসে আমাকে বললেন, ‘চিফ (জেনারেল সফিউল্লাহ) ফোন করেছেন। তিনি জানতে চাচ্ছেন কিছুক্ষণ আগে ৩২ নম্বরে প্রেসিডেন্টের বাড়িতে কারা হামলা করেছে। প্রেসিডেন্ট তাঁকে ফোর্স পাঠিয়ে উদ্ধার করতে বলেছেন। আমি কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চিফ কোনো নির্দেশ দিয়েছেন?’
‘না, উনি শুধু কাঁদছেন আর বলছেন, প্রেসিডেন্ট তাঁকে বিশ্বাস করলেন না।’ শাফায়াত বললেন।
‘স্যার, ইউনিফর্ম পরে আসুন, তাড়াতাড়ি অফিসে যাওয়া দরকার।’ আমি বললাম।
‘ওকে।’ বললেন শাফায়াত।
কয়েক মিনিট পরই আমি ও কমান্ডার বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। আমীন গেলেন তাঁর অফিসার মেসে। এত ভোরে কারও গাড়ি আসেনি। তাই পায়ে হেঁটে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। রাস্তার মোড়েই জেনারেল জিয়ার শহীদ মইনুল রোডের বাসার পূর্ব পাশের দেয়াল। শাফায়াত বলে উঠলেন, ‘চলো, জেনারেল জিয়ার বাসায় যাই, ঘটনাটি তাঁকে জানাই।’
আমরা দুজন দ্রুত হেঁটে জিয়ার বাসায় গেলাম। সেখানে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকেরা গার্ড ডিউটি করছে, সবাই আমার পরিচিত। তারা গেট খুলে দিলে আমরা দুজন দ্রুত হেঁটে জিয়ার বাসায় গেলাম। সেখানে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের বাসার ভেতরে ঢুকি।
কলবেল টিপলে জিয়া নিজেই দরজা খুলে দিলেন। তাঁর পরনে সাদা পায়জামা, সাদা হাফহাতা গেঞ্জি। শেভ করছিলেন, মুখে সাদা শেভিং ক্রিম, কাঁধে তোয়ালে। আমাদের দেখে বললেন, ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড?’
‘স্যার, প্রেসিডেন্ট হ্যাজ বিন কিলড। একটু আগে মেজর রশিদ এসে আমাকে জানিয়ে গেল।’ শাফায়াত বললেন।
‘সো হোয়াট? প্রেসিডেন্ট হ্যাজ বিন কিলড, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। উই উইল আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন। (আমরা সংবিধান মেনে চলব) গো অ্যান্ড গেট ইউর ট্রুপস রেডি।’ জিয়ার মন্তব্য। আমরা গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় জিয়াকে নেওয়ার জন্য একটি জিপ বাসায় ঢুকছিল। আমরা ড্রাইভারকে বললাম আমাদের অফিসে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ড্রাইভার রাজি হয়ে গাড়ি ঘোরাল আমাদের তুলে নেওয়ার জন্য।
চিত্রশিল্পীর অঙ্কনে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড।
জিপে উঠে আমি কমান্ডারকে পরামর্শ দিলাম অরক্ষিত ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে না গিয়ে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের সঙ্গে থাকাই আমাদের জন্য শ্রেয়। আমার বিবেচনায় এই ইউনিট আমাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। কমান্ডার রাজি হলেন। আমরা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের ২০০ গজ দূরে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের অফিস এলাকায় ঢুকে জিয়ার গাড়িটি ছেড়ে দিই। আসার পথে প্রধান সড়কে দেখা হলো আমার স্ত্রীর বড় ভাই মেজর ইকবালের সঙ্গে। তিনি ব্যক্তিগত ভক্সওয়াগন গাড়ি চালিয়ে আমার বাসার দিকে আসছিলেন। তিনিও আমাদের সঙ্গী হলেন। ইকবাল ১ম ইস্ট বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানির কমান্ডার।
১ম ইস্ট বেঙ্গলে যাওয়ার জন্য মেইন রোড থেকে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে এয়ারফোর্স হ্যাঙ্গারের সামনে আসতেই দেখতে পেলাম একটি ট্যাংক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ট্যাংকের টারেটে বসে আছেন মেজর ফারুক রহমান, ১ম ইস্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের উপ–অধিনায়ক (টুআইসি)। পরনে কালো ইউনিফর্ম, মাথায় কালো হেড গিয়ার। ট্যাংকের মেইনগানের মুখ প্রধান সড়কের দিকে।
৪৬তম ব্রিগেডের ঢাকায় অবস্থিত ৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়নের দুটি ১ম ইস্ট বেঙ্গল ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল পাশাপাশি রয়েছে। এদের বিভক্ত করেছে একটি ২০ ফুট প্রশস্ত পাকা সড়ক। ১ম ইস্ট বেঙ্গলে প্রবেশ করার সময় লক্ষ করলাম, এ সড়কের ওপরও একটি ট্যাংক অবস্থান নিয়েছে। আমাদের দুটি ব্যাটালিয়নের মাঝামাঝি ট্যাংকের আক্রমণাত্মক অবস্থান দেখে বিস্মিত হলাম, এদের মতলবটা কী?
মিনিট দশেকের মধ্যে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের সব অফিসার সিওর অফিসে সমবেত হলেন। সবার চোখেমুখে উত্তেজনা। একজন বললেন, তিনি সৈনিক ব্যারাকের পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময় রেডিওতে মেজর ডালিমের ঘোষণা শুনেছেন, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। কমান্ডার জিজ্ঞেস করলেন, ‘সৈনিকদের রিঅ্যাকশন কী?’
‘তারা উল্লাসধ্বনি দিচ্ছে, আনন্দ প্রকাশ করছে,’ অফিসারের সংক্ষিপ্ত জবাব।
কমান্ডারের নির্দেশ মোতাবেক আমি ৪৬ ব্রিগেডের সব ইউনিটকে স্ট্যান্ড টু (লোকাল ডিফেন্স এবং বাইরে মুভ করার প্রস্তুতি) অবস্থানে থাকার নির্দেশ জারি করি। অফিসকক্ষে তুমুল উত্তেজনা। মিনিটে মিনিটে টেলিফোন আসছে। কারও বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি। নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রায় এত বড় প্রলয়ংকরী ঘটনা। সিনিয়র অফিসাররা কেউ কিছু জানে না, দেশের প্রেসিডেন্ট নিহত! ব্রিগেড অফিসার মেসে আর্টিলারির কয়েকজন অফিসার বসবাস করে। সবাই বলাবলি করছে, গত রাতে নাইট ট্রেনিং ছিল, ২য় ফিল্ডের অফিসাররা সকাল নাগাদ ফিরে আসেনি।
১ম ইস্ট বেঙ্গলের সিও মেজর মতিউর, কমান্ডার ও আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি। হঠাৎ কাচ ভাঙার শব্দ শুনলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি একজন লেফটেন্যান্ট সিওর অফিসের দেয়াল থেকে রাষ্ট্রপতি মুজিবের ছবি নামিয়ে সবার সামনেই আছাড় মেরে সশব্দে ভেঙে ফেলেছে। কাচের টুকরা বারান্দায়ও ছিটকে পড়ে! সবাই তাকিয়ে দেখছে, আশ্চর্য! কেউ তাকে কিছুই বললেন না!
এমন সময় অ্যাডজুট্যান্ট এসে কমান্ডারকে জানাল, সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ টেলিফোন ধরে আছেন, ব্রিগেড কমান্ডারকে চাইছেন। কমান্ডার সিওর অফিসে ঢুকে টেলিফোনে সিজিএসের সঙ্গে কথা বললেন, নিজের অবস্থান সম্পর্কে জানালেন। বললেন, ‘স্যার, ১ম বেঙ্গলে চলে আসুন।’
মিনিট পনেরো পর সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ সিজিএস খালেদ ১ম বেঙ্গলে এসে সিওর রুমে ঢুকলেন। মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্সের কমান্ডার খালেদ, আর্টিলারি শেলের টুকরা তাঁর মাথায় আঘাত হেনেছিল। কপালে ক্ষতচিহ্ন তাঁর লম্বাটে মুখের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘকায়, সুঠামদেহী, সুদর্শন অফিসার। আসামাত্র সবাই তাঁকে ঘিরে ধরে। একই জিজ্ঞাসা, হচ্ছেটা কী? হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং? খালেদ জানালেন, ২য় ফিল্ড আর্টিলারি এবং ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের সৈনিকেরা গান ও ট্যাংক নিয়ে শহরে মুভ করেছে গত রাতে এবং সূর্যোদয়ের কিছু আগে ৩২ নম্বরে গিয়ে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে!
কর্নেল শাফায়াত সিজিএসকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ট্যাংক রেজিমেন্ট তো আপনার অধীন, আমার ইউনিট এলাকায় ট্যাংক পজিশন নিয়েছে কেন?’
‘তারা আমার নির্দেশ ছাড়াই মুভ করেছে, দে আর রেবেলস।’ খালেদ বললেন!
‘এখন আমাদের করণীয় কী?’ শাফায়াত বললেন।
খানিকক্ষণ চিন্তা করে খালেদ বললেন, ‘লেট আস বারগেইন উইথ দেম।’
এমন সময় চিফ মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর টেলিফোন এল। খালেদ ধরলেন। চিফ সিজিএসকে সেনাসদরে ডেকে পাঠালেন। উপস্থিত সবার ধারণা, এ ধরনের ক্রাইসিস মুহূর্তে ব্রিগেডিয়ার খালেদই ত্বরিত সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম। শাফায়াত খালেদকে বললেন, ‘আপনি আমাদের সঙ্গেই থাকুন। আমার ব্রিগেড স্ট্যান্ড টু অবস্থায় রয়েছে। বলুন আমরা কী করব?’
‘আমাকে যেতে দাও। আমি চিফের সঙ্গে কথা বলে আধা ঘণ্টার মধ্যেই এখানে ফিরে আসছি।’ খালেদ বেরিয়ে গেলেন।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় আমরা অপেক্ষমাণ সেনাসদরের নির্দেশের। নয়টা বেজে গেল। কোনো নির্দেশ আসেনি ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের কাছে।
সকাল নয়টার একটু পরই ১ম বেঙ্গলে একটি বড় গাড়িবহর এসে উপস্থিত হলো। সর্বাগ্রে ফ্ল্যাগ কারে চিফ সফিউল্লাহ, তারপর নেভি চিফ রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং শেষ প্রান্তে একটি এম-৩৮ হুডখোলা জিপে অবসরপ্রাপ্ত মেজর শরিফুল হক ডালিম। ডালিমের পরনে ইস্তিরিবিহীন পুরোনো ইউনিফর্ম, কাঁধে ঝোলানো ভারতে তৈরি নাইনএমএম স্টেন কারবাইন।
চিফ, ডেপুটি চিফ, নেভি চিফ ও এয়ার চিফ, ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত সিওর অফিসে ঢুকে মিনিট দশেক আলাপ করলেন। অন্যান্য অফিসার বাইরে বারান্দায়। চিফ ও অন্যরা বারান্দায় বেরিয়ে এলে সবাই জিজ্ঞেস করলেন, কী হচ্ছে? চিফ সংক্ষেপে জানালেন, ‘রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। মেজর ডালিম সেনাসদরে আমার অফিসে এসেছে কিছুক্ষণ আগে। সে বলছে খন্দকার মোশতাক নাকি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি রেডিও স্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।’ ‘এখন কী করা যায়?’ সবার দিকে তাকিয়ে বললেন সিএএস মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ।
বারান্দায় দণ্ডায়মান তিন-চারজন অফিসার, এমনকি নেভি চিফ বললেন, ‘স্যার, আপনার যাওয়া উচিত। প্লিজ সেভ দ্য সিচুয়েশন। ব্রিং থিংস আন্ডার কন্ট্রোল।’ মেজর ডালিম এগিয়ে এসে তীব্র স্বরে বলে ওঠে, ‘স্যার, তাড়াতাড়ি করুন, প্রেসিডেন্ট ইজ ওয়েটিং।’
এরপর সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর চিফত্রয় গাড়িতে উঠে রেডিও স্টেশনের দিকে যাত্রা করলেন। মেজর জেনারেল জিয়া এতক্ষণ নীরবে এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, আপনি রেডিও স্টেশনে যাচ্ছেন না?’
‘নাহ্, আমি আমার অফিসে যাচ্ছি।’ নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন জিয়া।
আমি ও কমান্ডার শাফায়াত ১ম বেঙ্গলে বসে বিভিন্ন ইউনিটের সঙ্গে টেলিফোনে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলাপ করছি। সিএএস ১ম বেঙ্গলে থাকার সময়ই শাফায়াত তাঁকে জানালেন, ১৬ ইস্ট বেঙ্গলের সিও মেজর খালেকুজ্জামান ছুটিতে রয়েছেন। ক্রাইসিস পিরিয়ডে পল্টন পরিচালনা করার জন্য একজন নিয়মিত কমান্ডিং অফিসার প্রয়োজন। চিফ বললেন, ‘কাকে চাও?’ কমান্ডার মেজর আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর নাম বললেন। চিফ সিও অফিসের ডেস্ক ক্যালেন্ডারের একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আমীন আহম্মেদ চৌধুরীকে ১৬ ইস্ট বেঙ্গলের সিওরূপে পোস্টিং দিলেন। আমীন সেটি হাতে নিয়ে জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা হলেন। ’৭২ সালে তিনি এই ইউনিট কমান্ড করেছিলেন।
আমরা একটি রেডিও আনিয়ে সংবাদ বুলেটিন শুনছিলাম। একটু পরই শুনতে পেলাম খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানেরা নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষ থেকে খন্দকার মোশতাকের প্রতি আনুগত্য ও সমর্থন ব্যক্ত করেন। বিডিআর, পুলিশপ্রধান এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মেজর আবুল হাসানও নতুন রাষ্ট্রপতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান এ সময় সরকারি কাজে বিদেশে ছিলেন।
বাহিনীপ্রধানদের আনুগত্য প্রকাশের পর প্রতিটি সেনানিবাসে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। মেজর ডালিমের রেডিও ঘোষণার কোনো প্রতিক্রিয়া কোনো সেনানিবাসে দেখা যায়নি। একমাত্র চট্টগ্রামে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কাজী গোলাম দস্তগীর চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশনে ফোন করে ডালিমের ঘোষণা প্রচার না করার নির্দেশ দেন। তবে নানা কারণে সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সদস্যরা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁরা নির্দ্বিধায় এ পরিবর্তনকে মেনে নিয়েছেন। এত বড় মাপের নেতার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সারা দেশে আওয়ামী লীগ কিংবা কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ লক্ষ করা যায়নি। রাজধানী ও জেলা শহরের আওয়ামী লীগ নেতারা আতঙ্কিত হয়ে গা ঢাকা দেন।...
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন