ফর্মুলা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণায় এসিআই
ভারত থেকে নিয়ে আসা প্রোডাক্টের বাজার ধরে রাখতে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশীয় একটি সম্ভাবনাময় কোম্পানিকে ধ্বংস করে দিয়েছে এসিআই। একজন গবেষকের উদ্ভাবিত ৩২ টি ফর্মুলা হাতিয়ে নিয়ে এ প্রতারণা করেছে এসিআই লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসিআই ফর্মুলেশনস। যার মূল হোতা খোদ এসিআই লিমিটেডেরই চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলা।
জানা যায়, ভারতের ডাবর ইন্ডিয়া লিমিটেডসহ বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির উৎপাদিত প্রোডাক্ট বাংলাদেশে বাজারজাতকরণের চুক্তি থাকায় এসিআই’র টার্গেটে পরে দেশীয় ওই কোম্পানিটি। কারণ এসিআই’র আমদানি করা প্রোডাক্টের চেয়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত প্রোডাক্ট ক্রমেই জনপ্রিয় উঠছিলো ক্রেতাদের কাছে। এতে বাজার হারাচ্ছিল বিদেশ থেকে আনা এসিআই’র প্রোডাক্টসমূহ। আর প্রোডাক্টের এই জনপ্রিয়তাই কাল হয়ে দাঁড়ায় দেশীয় কোম্পানিটির, শিকার হয় এসিআই’র চক্রান্তের।
সূত্র জানায়, প্রতারণার শিকার ওই গবেষক ড. এম এ হাকিম। যিনি নিম ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা। তার গবেষণায় উদ্ভাবিত প্রাকৃতিক প্রসাধনী, হারবাল মেডিসিন, জৈব সার ও জৈব কীটনাশক নিরাপদ স্বাস্থ্য পরিচর্যা, জৈব কৃষি উৎপাদন এবং পরিবেশ রক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছে দীর্ঘদিন। এর সম্প্রসারণ ও উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বাণিজ্যিকীকরণের জন্য তিনি নিম ল্যাবরেটরিজ নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। কোম্পানিটির মাধ্যমে ড. হাকিম তার উদ্ভাবিত নিম টুথপেস্ট, টুথ পাউডার, নিম সাবান, নিম শ্যাম্পু, ফেস ওয়াশ, নিম জৈব কীটনাশক ও সারসহ বেশ কিছু পণ্য বাজারজাত করেন। সেনাবাহিনীর সিএসডি, আড়ং, আগোরা, নন্দন, এসএস মার্টের মতো বেশ কিছু আউটলেট এবং দেশের স্বনামধন্য বিপণি বিতানে এসব পণ্য বিক্রয় হতো। এসিআই গ্রুপের মালিকানাধীন ‘স্বপ্ন’ আউটলেটেও উদ্ভাবিত পণ্য সরবরাহ করত নিম ল্যাবরেটরিজ। জনপ্রিয়তার কারণে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও কম-বেশি রফতানি হতে থাকে এসব পণ্য। কিন্তু অর্থাভাবে ব্যাপকভাবে বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে নিম ল্যাবরেটরিজ। অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠেনা বিপুল সম্ভাবনাময় দেশীয় এ কোম্পানিটি।
জানা যায়, এমন এক পরিস্থিতিতে এসিআই’র মালিকানাধীন স্বপ্ন আউটলেটে নিম পণ্য সরবরাহের সূত্র ধরে ড. হাকিমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এসিআই লিমিটেডেরই চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলা।
এক পর্যায়ে সাক্ষাৎও ঘটে তাদের। সাক্ষাতে ড. হাকিমের কাছে এসিআই মালিক জানতে চান যে, আসলে কেন ড. হাকিম এসব পণ্য ব্যাপকহারে বাজারজাত করছেন না।
এসময় ড. হাকিম নিজের আর্থিক দুর্বলতার কথা স্বীকার করেন। এবং এসিআই চেয়ারম্যান আনিস উদ দৌলাকে বলেন, আমি একজন গবেষক, ব্যবসায়ী নই। আমার কোনো ভালো সহযোগীও নেই। এবং ব্যাপকহারে বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে আমার পর্যাপ্ত অর্থও নেই।
ড. হাকিমের এই দুর্বলতার সুযোগ লুফে নেন এসিআই লিমিটেডের চেয়ারম্যান। ড. হাকিমকে এসিআই’র সঙ্গে ব্যবসা করার প্রস্তাব দেন তিনি। দুরভিসন্ধি বুঝতে না পেরে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের এমন প্রস্তাবে উৎফুল্ল হয়ে সম্মতি দেন ড. হাকিম। প্রথমেই এসিআই ফর্মুলেশনসের কাছে নিম ল্যাবরেটরিজের ৫১ শতাংশ শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু পরে ড. হাকিমকে ৭৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব দেয় এসিআই।
ড. হাকিমকে এসিআই চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে বোঝানো হয়, আপনি যেহেতু গবেষক। সেহেতু ব্যবস্থাপনা বা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে না থেকে গবেষণাক্ষেত্রেই আপনার বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। এসময় নিম ল্যাবরেটরিজের ৭৫ ভাগ শেয়ার এসিআই’র কাছে হস্তান্তরসহ কোনো ব্যবস্থাপনায় না থেকে ড. হাকিমকে গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এর বিনিময়ে প্রচুর অর্থ পাওয়া যাবে বলেও ড. হাকিমকে বোঝানো হয় এসিআই’র পক্ষ থেকে।
এসিআই চেয়ারম্যানের সুদূরপ্রসারী এই চাতুরতা বুঝতে পারেননি ড. হাকিম। সরল বিশ্বাসে, নিজের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে দেশে-বিদেশে সম্প্রসারণের লোভে এবং পর্যাপ্ত অর্থপ্রাপ্তির আশায় এসিআই ফর্মুলেশনসের কাছে নামমাত্র মূল্যে নিম ল্যাবরেটরিজের ৭৫ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তরে রাজি হয়ে যান তিনি। হস্তান্তরের পর ব্যাপকহারে উৎপাদনের কথা বলে ড. হাকিমের উদ্ভাবিত ৩২ টি ফর্মূলাসহ প্রয়োজনীয় উৎপাদন পদ্ধতি (ফ্লোচার্ট) ও গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস হাতিয়ে নেয় এসিআই। সুকৌশলে এসিআই’র অধীনে নিয়ে যাওয়া হয় নিম ল্যাবরেটরিজের অফিস, কারখানা ও উৎপাদনযন্ত্রগুলো। কারখানা স্থানান্তর করা হয় এসিআই’র শিল্প কারখানা গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে। নিম ল্যাবরেটরিজের ঠিকানা হয় এসিআই ফর্মুলেশনসের অফিসে। প্রলোভন দেখিয়ে ড. হাকিমের কাছ থেকে ব্যবস্থাপনা নিয়ে নেওয়া হয় নিম ল্যাবরেটরিজের। কনসালটেন্ট নিয়োগ দিয়ে উৎপাদন সমন্বয়, গুণগতমান রক্ষা এবং নতুন দ্রব্য সামগ্রী উদ্ভাবনের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলে ড. হাকিমকে পদত্যাগ করানো হয় নিজের প্রতিষ্ঠিত নিম ল্যাবরেটরিজের পরিচালকের পদ থেকেও। গবেষণা কর্ম চালিয়ে নিয়ে উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রাখতে সহযোগিতার আশ্বাসও দেওয়া হয় নিয়োগপত্রে।
এসিআই’র অসৎ উদ্দেশ্যের অংশ হিসেবে নিয়োগ ও সমঝোতা চুক্তিতে শর্ত জুড়ে দিয়ে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয় ড. হাকিমের মালিকানাধীন আরো ৯ টি প্রতিষ্ঠান। সেইসঙ্গে গবেষণা ও উন্নয়ন বিষয়ক কনসালটেন্ট পদে নিয়োগের অজুহাত দেখিয়ে ৫ বছরের জন্য কেড়ে নেওয়া হয় একই ধরণের কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়ার ক্ষমতা। এরপরই নিম ল্যাবরেটরিজ নিয়ে শুরু হয় এসিআই চেয়ারম্যানের সুদূরপ্রসারী অসৎ উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন। নিজ কোম্পানি পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করিয়ে, অফিস ও ফ্যাক্টরি আয়ত্বে নেওয়ার পর ড. হাকিমের সঙ্গে শুরু হয় এসিআই’র নানা রকম ছলচাতুরি। চুক্তি অনুযায়ী, ফ্রেশ ক্যাপিটাল হিসেবে কোম্পানি ফান্ডে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা জমা রাখার কথা থাকলেও জমা না দিয়ে টালবাহানা করতে থাকে এসিআই। নিম ল্যাবরেটরিজের ব্যবস্থাপনা কেড়ে নিয়ে ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর ড. হাকিমকে এর কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও কোম্পানির সবধরণের কর্মকাণ্ড থেকে নানা কূটকৌশলে বিরত রাখা হয় তাকে। ড. হাকিমের সর্বস্ব দখলে নিয়ে রহস্যজনকভাবে নিম পণ্যসামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিয়ে গড়িমসি শুরু করে এসিআই চেয়ারম্যান। ফলে প্রতিদিনই বাজার হারাতে থাকে নিম ল্যাবরেটরিজের প্রোডাক্ট। বিপুল কাস্টমার থাকা সত্ত্বেও দেশীয় এই কোম্পানিটির প্রোডাক্ট না পেয়ে বিভিন্ন আউটলেট থেকে অভিযোগ আসতে শুরু করে ড. হাকিমের কাছে। প্রোডাক্টের সরবরাহ না থাকায় নিম ল্যাবরেটরিজকে ব্ল্যাক লিস্টেড করার প্রস্তুতি নেয় আউটলেটগুলো। এরইমধ্যে নিম ল্যাবরেটরিজের উৎপাদিত প্রোডাক্টের অনুরূপ বিদেশি প্রোডাক্ট ব্যাপকহারে আমদানি করে বাজারজাত করতে থাকে এসিআই। কোনো কারণ ছাড়াই শতভাগ দেশীয় প্রযুক্তি ও কাঁচামালে উৎপাদিত আন্তর্জাতিক মানের প্রোডাক্টের উৎপাদন বন্ধ রেখে তিলে তিলে ধ্বংস করতে থাকে বিপুল সম্ভাবনাময় এই ব্র্যান্ডটিকে।
ব্যবসায়িক শর্ত ভঙ্গ করে এসিআই’র এমন কর্মকাণ্ডে হতাশ হয়ে চেয়ারম্যান আনিস উদ দৌলার সঙ্গে যোগাযোগ ও সাক্ষাতের চেষ্টা করেন ড. হাকিম। কিন্তু দেখা করা তো দূরে থাক কোনোভাবে এসিআই মালিকের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারেননি ড. হাকিম।
তারপরেও চেষ্টা অব্যাহত রাখেন ড. হাকিম। কিন্তু সাক্ষাৎ না দিয়ে কয়েক দফায় তাকে ফিরিয়ে দেন এসিআই চেয়ারম্যান। উপায়ান্তর না দেখে নিম ল্যাবরেটরিজের ২৫ শতাংশ শেয়ার হোল্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে চলতি বছরের ৬ এপ্রিল এসিআই চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি লেখেন ড. হাকিম। ওই চিঠিতে এসিআই চেয়ারম্যানকে তিনি জানান, ‘নিম ল্যাবরেটরিজের ব্যাপক চাহিদা সম্বলিত প্রোডাক্ট উৎপাদন ও বাজারজাত না করায় একদিকে যেমন ব্র্যান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অপর দিকে কোম্পানির আর্থিক ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে। চিঠিতে ড. হাকিম এসিআই চেয়ারম্যানকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে তা সমাধানের অনুরোধ জানান। কিন্তু এতেও সাড়া মেলেনা এসিআই কর্তৃপক্ষের। এ রকম কয়েক দফায় নিম ল্যাবরেটরিজের প্রোডাক্ট উৎপাদন বন্ধের কারণ জানতে চেয়ে চিঠি লিখেও এসিআই চেয়ারম্যান আনিস উদ দৌলার সাড়া পাননি ড. হাকিম। পাননি দেখাও। মেলেনি কোনো সমাধান।
ফলে গত এক বছরে তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে গেছে ব্যাপক সম্ভাবনাময় দেশীয় নিম ল্যাবরেটরিজ নামক ব্র্যান্ড। অপরদিকে
কূটকৌশলে নিজেদের হাতে নিম ল্যাবরেটরিজের ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিদেশ থেকে আরো ব্যাপকহারে ভেষজ প্রোডাক্ট এনে বাজারজাত করছে এসিআই। এসব প্রোডাক্ট আমদানি করার কারণে বিদেশে চলে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। জাপান ও মালয়েশিয়ায় নিম ল্যাবরেটরিজের প্রোডাক্ট বাজারজাতকরণের লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও দেশি প্রোডাক্ট রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
এসিআই ষড়যন্ত্র করে ড. হাকিমের উদ্ভাবিত ফর্মূলা হাতিয়ে নিয়ে প্রোডাক্ট উৎপাদন না করায় একদিকে দেশীয় শিল্প ধ্বংস হচ্ছে। অপরদিকে সম্প্রসারিত হচ্ছে বিদেশি পণ্যের বাজার। জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই ডাবর ইন্ডিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশে ভেষজ প্রোডাক্ট বাজারজাতকরণের চুক্তি রয়েছে এসিআই’র। চুক্তিতে এসিআই দেশে অনুরূপ কোনো প্রোডাক্ট উৎপাদন করতে পারবে না বলে শর্ত দেওয়া আছে। তা সত্ত্বেও নিম ল্যাবরেটরিজের ৭৫ শতাংশ শেয়ার ক্রয় ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ে উৎপাদন না করা দেশীয় পণ্যের বাজার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাংলাদেশে ডাবরের বাজার সম্প্রসারণ করতেই দেশের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি নিম ল্যাবরেটরিজকে কৌশলে ধ্বংস করেছে এসিআই।
শেয়ার করুন