শীত-সুন্দরী
যদি প্রশ্ন করি, কোন মাসে বাঙালিদের ঘরে ঘরে বিয়ের ধুম পড়ে যায়, তবে তার উত্তর হবে একটাই--- শীতকালে। হ্যাঁ, বাংলা বারো মাসের মধ্যে পৌষ ও মাঘ মাসই হল শীতকাল।
প্রতি দু'মাস অন্তর গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত--- এই ছয় ঋতুচক্রের একেক ঋতুতে এক এক রূপ ধারণ করে আমাদের দেশ। হেমন্ত যে-ই যাই-যাই করে, অমনি টুক করে চুপি চুপি ঢুকে পড়ে এই শীত-সুন্দরী।
এই ঋতু বৈচিত্র ও বিত্ত বৈভবে মুগ্ধ হয়ে একটি জনপ্রিয় গান লিখেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল--- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি / সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি...'
এই শীতেই নুতন ফসলের ম' ম' গন্ধে ভরে ওঠে বাংলার আকাশ বাতাস। তাই এই রূপময় বৈচিত্রের বর্ণনা করতে গিয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ ‘রূপসী বাংলা’য় লিখেছেন--- 'বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ / খুঁজিতে যাই না আর…' অথবা 'আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায় / হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;…'
আর বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বাংলাদেশের রূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রচনা করেছেন একের পর এক তাঁর কালোতীর্ণ কবিতা, গল্প, নাটক এবং অজস্র গান। তাঁর গানের সুরে সুরে বেজে ওঠেছে বাংলা ও বাঙালির প্রাণের সুর। যেমন তাঁর কালজয়ী ভালবাসার গান--- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবসি / চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস / আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি…', যা আজ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
তেমনই বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম তো বাংলাদেশের নদ-নদী, পাহাড় অরণ্যের প্রাকৃতিক শোভায় বিহ্বল হয়ে বিশ্ববাসীকে আমন্ত্রণই জানিয়েছেন তাঁর কবিতায়--- ‘আমার শ্যামলা বরণ বাংলা ময়ের / রূপ দেখে যা আয়রে আয়--- / গিরি দারী বনে মাঠে প্রান্তরে রূপ ছাপিয়ে যায়...'
শীত ঋতু আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। গুঁড়ো গুঁড়ো মুক্তোর কণার মতো ঝড়ে পড়া ভোরের শিশিরের স্পর্শে যেমন আমাদের দিন শুরু হয়, তেমনই শেষ হয় আবার শিশিরের স্পর্শেই। এই সময় কেউ কেউ ঘাসের ওপরে সারা রাত ধরে পড়া শিশির-কণা আলতো করে দু'হাতের তালুতে বুলিয়ে মুখে মেখে নেন।
তাই শুধু শীতকাতুরে মানুষই নয়, অধিকাংশ মানুষের কাছেই প্রিয় ঋতু হয়ে উঠেছে এই শীতকাল।
এই শীতকালকে কেউ কেউ আবার ফ্যাশনের ঋতুও বলেন। কারণ, এই শীতকালে আমাদের পোশাকআশাকেও আসে অনেক পরিবর্তন। শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচার জন্য মানুষ জন তখন গায়ে তুলে নেয় রং-বেরঙের হাল ফ্যাশানের চাদর, সোয়েটার, ব্লেজার, কোট, জাম্পার, কার্ডিগান। সে সবে নিজেকে জড়িয়ে সুন্দর থেকে আরও সুন্দর করে তোলেন। এই শীতকালে ঘাম ও তৈলাক্ত কম হওয়ার জন্য সাজগোজ করে স্বস্তিও পাওয়া যায় বেশ। কারণ, শীতের জন্য সেই সাজ গলদঘর্ম হয়ে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না। ফলে নিজের লুক পরিবর্তন করা যায় ইচ্ছেমত।
এই শীত ঋতুতেই দু'বাংলায় নবান্নের উৎসব শেষেও চলতে থাকে মানুষের মনকে উৎফুল্ল করার জন্য নানা রকম উৎসব। কার্তিকের মরা গঙ্গাকে ছাপিয়ে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে ধানে। শুরু হয় রবিশস্যের নুতন আবাদ। এর ফাঁকে ফাঁকেই চলে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক নানা উৎসবের আয়োজন।
তথ্য ও সংস্কৃতির বিভাগ শুরু করে নাট্য উৎসব, কবিতা উৎসব, গানমেলা। একমাস ব্যাপী যাত্রা উৎসব। কনকনে শীতে চাদর মুড়ি দিয়ে রাত জেগে যিনি কখনও যাত্রা দেখেননি, জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি থেকেই তিনি বঞ্চিত থেকে গেছেন।
এই শীতেই সূফি ও বাউল ভাব-দর্শনে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী মেতে ওঠেন নানা রকম আচার অনুষ্ঠানে। বিভিন্ন মরমী সাধকদের মাজার ও খানকাকে ঘিরে শুরু হয় ওরস ও মেলা। এই সময়েই হাটবাজারগুলো ভরে ওঠে সবুজ সতেজ শাকশব্জিতে। কী থাকে না সেখানে? ফুলকপি, বাঁধাকপি, কড়াইশুঁটি, মুলো, গাজর, সিম, পালংশাক।
শীতকালে চারিদিকের আবহাওয়ায় জলীয়বাষ্পের পরিমান কমে গিয়ে রুক্ষ্মতার সৃষ্টি হয়। গাছগাছালি পাতা ঝরিয়ে কেমন যেন ন্যাড়া ন্যাড়া হয়ে যায়। এই সময় সেই সব গাছপালা দেখে বয়স্ক মানুষদের মনেও বিষণ্ণতা ফুটে ওঠে, ভাবে--- আমাদেরও বুঝি ঝরে পড়ার সময় হয়ে এল। তাই এই শীতকে তুলনা করা হয় থুত্থুড়ে বুড়ির সঙ্গে।
অথচ, যেখানে রসের অভাবে গাছপালা হরিৎবর্ণ ধারণ করে, সেখানে খেজুরের রসে ভরে ওঠে গাছিদের রসের হাড়ি। কী বিশাল বৈপরিত্ব!
গ্রামেগঞ্জে, স্টেশন চত্বরে, এমনকী শহরের রাস্তাকেও খড়কুটো, ডিমের ট্রে, গাছের ডাল ভেঙে কিংবা গাড়ির বাতিল টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বহু লোককেই দল বেঁধে আগুন পোহাতে দেখা যায় যত্রতত্র। হতদরিদ্রদের এ কষ্ট উপলব্দি করেই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন এই মর্মস্পর্শী কবিতাটি--- 'হে সূর্য, তুমি তো জানো / আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব / সারারাত খড়কুটা জ্বালিয়ে / এক টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে / কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই।
তবু এই শীতই আমাদের অতি প্রিয় একটি ঋতু। এই ঋতুতেই গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, টিউলিপ, গ্ল্যাডিওলাই, জিপসির নতো রংবাহারি ফুল গাছে গাছে পাপড়ি মেলে দেয়। নেশাগ্রস্থ করে তোলে তাদের সুগন্ধ।
এখন সারা বছর পাওয়া গেলেও শীতের মরসুমের কমলালেবু, শাকআলু আর আপেলের স্বাদের জুড়ি মেলা ভার। আর যার নাম শুনলেই জিভে জল আসে, সেই টোপকুল শীত আসতে না-আসতেই যতই বাজারে আসুক না কেন, সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দেওয়ার আগে অবধি অনেকেই নিজের জিভকে সামলে রাখেন। বিশেষ করে স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা। এই সময় কুলের আচার বানিয়ে রাখারও ধুম পড়ে যায়।
তবে চোখকে নয়। তখন দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ ভরে ওঠে সর্ষে ফুলের হলুদ আভায়। মনে হয়, সারা মাঠে বুঝি হলুদ গালিচা পাতা। চোখ ফেরানো যায় না।
এটা ষোলো আনা সত্যি যে, আর কোনও মরসুমে মানুষ জনের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা এতটা বদলায় না, যতটা বদলায় এই এক শীতকালে।
প্রচণ্ড শীতেও লোকজন লেপের তলা থেকে ভোর থাকতে বেরিয়ে পড়েন, যাঁরা তরতর করে খেজুর গাছে উঠে রসের হাড়ি পেড়ে আনেন, শুধুমাত্র সেই শিউলিদের ভোররাত্রে পেড়ে আনা ভরা কলসি থেকে এক গ্লাস খেজুরের রস খাবেন বলে। সেই রস জ্বাল দিয়ে ঘন আর শক্ত করে তৈরি হয় গুড়। নলেন গুড়। তা দিয়েই তৈরি হয় শীককালীন নানান খাবারদাবার।
এই শীতের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে ডড়িয়ে আছে পিঠা-পুলির নাম। যেমন--- ভাপা পিঠা। এই পিঠা অন্য সময়েও তৈরি করা যায় ঠিকই, কিন্তু ভাপা পিঠার সেই স্বাদ শীতকাল ছাড়া কিছুতেই পাওয়া যায় না। সঙ্গে আছে চিতই পিঠা,সিদ্ধ পিঠা, পুলি পিঠা, খেজুরি পিঠা, চিল পিঠা, রস পিঠা, তেলের পিঠা, রস পিঠা, ঝাল পিঠা, পাটিসাপটা বা ক্ষীরপুলি।
সারা শীতে যাঁদের বাড়িতে পিঠা-পুলির কোনও বালাই নেই, নমো নমো করে হলেও বাংলার পরম্পরা ঐতিয্য মেনে পৌষ সংক্রান্তি আর মকর সংক্রান্তির দিন তাঁরাও কিছু না কিছু পিঠা-পুলি করেনই।
আগে শীতের মরশুমের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে ছিল ব্যাডমিন্টন খেলা। শীত আসতে না-আসতেই পাড়ায় পাড়ায় ব্যাডমিন্টন কোর্ট কাটার ধুম পড়ে যেত। তবে সৌরভ গাঙ্গুলি লর্ডসের মাঠে সেঞ্চুরি করার পর সেই ব্যাটমিন্টন কী ভাবে যেন আস্তে আস্তে ব্রাত্য হয়ে গেল। তার জায়গা পুরোপুরি দখল করে নিল ক্রিকেট।
শীতকালে মাঝে মধ্যে সুর্যিমামা তো দেখাই দেন না। কুয়াশার চাদরে যেন ঢেকে থাকে পুরো গ্রাম-শহর।
প্রবাদ আছে--- ‘এক মাঘে শীত যায় না'। এখানে শীত কিন্তু বিপদের অনুষঙ্গ। আবার বিপরীত ভাবের প্রবচনও আছে—‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’। খেজুরের রস, পাটালি গুড়, কোঁচাভর্তি মুড়ি-মুড়কি, পিঠা-পায়েস, গমের ক্ষেতে পাখি-তাড়ানো, লেপ-কম্বলের উত্তাপ, কুয়াশা ঢাকা ভোরে ও সন্ধ্যায় আনন্দ-কষ্টের মিশেল নিয়ে আমাদের জীবনে শীতকাল হাজির হয়। শীতের মিঠেরোদ পিঠে মেখে বাড়ির মেয়ে-বউরা এক সময় উলের সোয়েটার বুনত। গল্পের বই পড়ত। অর্ধেক দাওয়া ছড়িয়ে কাঁথা সেলাই করত। সে সব অবশ্য এখন গ্রাম, তস্যগ্রামেও আর সে ভাবে দেখা যায় না। দেথা যায় না উঠোনের কোণে মাটির চুলায় রান্না, চুলার পাশে বসে হাতের তালু গরম করে নেওয়া--- যদিও এই সব ছবি আর ছবির পিছনের গল্প আমাদের খুব চেনা।আর আছে গ্রামের স্কুলমাঠে পুতুল নাটক, সার্কাস, অপেরায় মাতেয়ারা সব রাত।
হিম শীতল হাওয়ায় সর্দি-কাশি তো আছেই। তাই শীতকে কেউ ভেবেছেন উৎসব, কেউ-বা মৃত্যু। অনেকে আবার শীতকালকে হতাশা ও আশাহীনতার কাল হিসেবেও বর্ণনা করেছেন । শীতপ্রধান দেশগুলোতে ‘এক শীত পেরোলে আরেক জীবনের সম্ভাবনা’কে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। এই শীতের শেষ দিকেই শুরু হয় সেই মেলা, এক সময় যাকে হলা হত, সব তীর্থ বাব বার / গঙ্গাসাগর একবার--- সেই গঙ্গাসাগর মেলা।
শুধু ভারতীয় সাহিত্য বা সংস্কৃতিতেই নয়, বিদেশি সাহিত্যেও শীত নিয়ে কবিতা, গল্প, উপন্যাস কম লেখা হয়নি। 'দ্য প্যারিস উইন্টার’ উপন্যাসে ইমোজেন রবার্টসন বিশ শতকের প্যারিসের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। কাহিনিতে তিনি নায়িকার একাকিত্ব এবং ক্ষুধার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। ইলানা তান রচিত রোমান্স কমেডি ‘উইন্টার ইন টোকিও’ বেশ সাড়া জাগানো কাহিনি। ‘হ্যাপি এন্ডিং’-এর মধ্য দিয়ে এখানে শীতের ইতিবাচকতাকে পরিবেশন করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাকে আশ্রয় করে জ্যান টারল্যু লিখেছেন, ‘উইন্টার ইন ওয়ারটাইম’। জার্মান বাহিনীর হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হল্যান্ডবাসীর শীত ও ক্ষুধার যন্ত্রণা জায়গা করে নিয়েছে এই ফিকশনে। ১৯৪০ সালে স্প্যানিশ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর ইউরোপে ফ্রান্স সেনাবাহিনীর উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে সি জে স্যানসম লিখেছেন, ‘উইন্টার ইন মাদ্রিদ’।
বাংলা কবিতা পড়লে দেখা যায়, শীত প্রবেশ করেছে মধ্যযুগে। বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যে। নায়িকার বারো মাসের কষ্ট-বর্ণনায়। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন : ‘পউষের প্রবল শীত সুখী যেজন। / তুলি পাড়ি আছারি শীতের নিবারণ ॥ / ফুল্লরার কত আছে কর্মের বিপাক। / মাঘ মাসে কাননে তুলিতে নাহি শাক ॥’
পরবর্তী কালে আধুনিক কবিরাও শীতকালের বন্দনা কিংবা বর্ণনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘শীতের হাওয়া হঠাৎ ছুটে এলো। / গানের হাওয়া শেষ না হতে। / মনে কথা ছড়িয়ে এলোমেলো। / ভাসিয়ে দিল শুকনো পাতার স্রোতে।’
আবার অন্য এক কবিতায় তিনি লিখছেন : ‘এসেছে শীত গাহিতে গীত বসন্তেরই জয়’। শীতকে তিনি মৃত্যুর প্রতীকেও প্রয়োগ করেছেন। তিনি ‘শীতের প্রবেশ’ কবিতায় লিখেছেন : ‘শীত, যদি তুমি মোরে দাও ডাক দাঁড়ায়ে দ্বারে। / সেই নিমেষেই যাব নির্বাক অজানার পারে।’
কবি জসীম উদ্দীন তাঁর ‘রাখাল ছেলে’ কবিতায় লিখেছেন : 'ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে, / সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে। / আমার সাথে করত খেলা প্রভাত হাওয়া, ভাই, / সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই। / চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দুখান পা, / বলছে ডেকে, ‘গায়ের রাখাল একটু খেলে যা!’... সরষে বালা নুইয়ে গলা হলদে হাওয়ার সুখে, / মটর বোনের ঘোমটা খুলে চুমু দিয়ে যায় মুখে! / ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশী পউষ-পাগল বুড়ী, / আমরা সেথা চষতে লাঙল মুর্শিদা গান জুড়ি।'
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘শীতরাত’ কবিতায় লিখেছেন : ‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে; / বাইরে হয়ত শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা।’ তার কবিতায় ঘুরে ঘুরে আসে ‘পউষের ভেজা ভোর’, ‘নোনাফল’, ‘আতাবন’ ‘চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত’, ‘ঝরিছে শিশির’, ‘পউষের শেষ রাতে নিমপেঁচাটি’।
শীতের সঙ্গে শরীরের ওমের যে সম্পর্ক, তাও ভুলে যাননি জীবনানন্দ। লিখেছেন সে কথাও : “হিমের রাতে শরীর ‘উম্’ রাখবার জন্য দেশোয়ালীরা/ সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে।'
শামসুর রহমানের ‘রূপালি স্নান’, কবিতায় আছে : ‘শিশিরের জলে স্নান ক’রে মন তুমি কি জানতে / বিবর্ণ বহু দুপুরের রেখা মুছে ফেলে দিয়ে / চ’লে যায় এই পৃথিবীর কোনো রূপালি প্রান্তে? / নোনাধরা মৃত ফ্যাকাশে দেয়ালে প্রেতছায়া দেখে, আসন্ন ভোরে / দু’টুকরো রুটি / না-পাওয়ার ভয়ে শীতের রাতেও এক-গা ঘুমেই বিবর্ণ হই, / কোনো একদিন গাঢ় উলাসে ছিঁড়ে খাবে টুঁটি / হয়ত হিংস্র নেকড়ের পাল, তবু তুলে দিয়ে দরজায় খিল / সত্তাসূর্যে যেসাসের ক্ষমা মেখে নিয়ে শুধু গড়ি উজ্জ্বল কথার মিছিল / হয়ত কখনো আমার ঠান্ডা মৃতদেহ ফের খুঁজে পাবে কেউ / শহরের কোনো নর্দমাতেই; —সেখানে নোংরা পিছল জলের / অগুনতি ঢেউ / খাব কিছুকাল।’
আল মাহমুদ লিখেছেন : ‘কখনো ভোরের রোদে শিশিরের রেনু মেখে পায় / সে পুরুষ হেঁটে যায় কুয়াশায় দেহ যায় ঢেকে।’
আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন: ‘শীতের ঢেউ নামি আসবে ফের / আমার বুড়ো হাড়ে ঝনাৎকার।’
শুধু কবিতা নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋতুভিত্তিক নাটকও লিখেছেন। লিখেছেন ‘রক্তকরবী’। (প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ১৯২৬) শীতকালের নাটক।
তাঁর পৌষের ফসল কাটার সেই জনপ্রিয় গানটির কয়েকটি লাইন হল : ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে—আয় রে চলে, / আয় আয় আয়। / ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, / মরি, হায় হায় হায়।... / মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হলো— / ঘরেতে আজ কে রবে গো। খোলো দুয়ার খোলো।’
আমেরিকান-ইংরেজ কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন—‘Stopping by woods on a snowing evening’. সোভিয়েত লেখক চেখভ বলেছেন— ‘মানুষ সুখী হলে জানতে চায় না— এটি শীত না বসন্ত’। প্রায় চারশো বছর আগে শেক্সপিয়ার ‘Winter tell’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন।
ইংরেজ কবি শেলী বলেছেন: ‘Oh, wind, if winter comes, can spring be far behind’. শেলীর এই ভাবনার সাদৃশ্য পাওয়া যায় কবি নজরুলের শীত-বন্দনায়। ‘শীতের সিন্ধু’ কবিতায় তিনি লিখেছেন : ‘ওগো মোর লীলা সাথী অতীত বরষার। / আজিকে শীতের রাতে নব অভিসার।’
জাপানি কবি বাশো তার হাইকুতে পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন: ‘অষ্টদৃশ্য বেশ / সাতটি কুয়াশায় ঢাকা / একটির ঘণ্টা ঢং ঢং।’— তার মানে কী দাঁড়ায়?
শুধু নির্ভেজাল সাহিত্যই নয়। বিখ্যাত লেখক বা মনীষীদের উক্তি নিয়েও কম কটাক্ষ করা হয়নি। সেই সব বহুল প্রচলিত উক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শীতের নানা অনুষঙ্গ ঢুকিয়ে প্রচুর প্যারোডিও করা হয়েছে। যেখানে শুধু কটাক্ষই নয়, ধরা পড়েছে প্রচুর মজাও। যেমন---
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : (এই শীতে) স্নান যে করে আর স্নান যে সহে / তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।
কাজী নজরুল : চল চল চল / মাথায় দু'ফোঁটা ছিটিয়ে জল, ভিজে তোয়ালেতে গা মুছে বল /ঢেলেছি আমি অনেক জল / চল চল চল।
স্বামী বিবেকানন্দ : স্নানে ঘৃণা, লেপে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ইশ্বর।
আব্রাহাম লিংকন : শীতকালে স্নান হচ্ছে জনগনের জন্য জনগনের দ্বারা জনগনের কষ্ট।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত : কোন বাথরুমে বল তো জল /সকল বাথরুমের চেয়ে ঠান্ডা / কোন বাথরুমে গায়ে পড়লে জল / ইচ্ছে হয় ধরে দিই ডান্ডা?
কার্ল মার্ক্স : শীতকালে পুরুষদের হারাবার কিছুই নেই, স্নান করার ইচ্ছেটি ছাড়া। জয় করার জন্য পড়ে আছে পুরো লেপের তলা।
লেনিন : শীতকালে স্নান হচ্ছে অত্যাচারের চরম পর্যায়।
মাও সে তুঙ : জ্যাকেট, সোয়েটার ও মাফলার দিয়ে শরীর ঘেরো। এটাই প্রতিক্রিয়াশীল শীতকে পরাজিত করার একমাত্র উপায়।
গান্ধী : শীতকালে স্নান না করা পরম ধর্ম।
নেতাজি : তোমরা যদি আমার স্নানের বালতিতে ঠান্ডা জল দাও, আমি তোমায় তেড়ে গালাগাল দেবো।
প্রাচীন গ্রিক পুরাণ মতে, শীতের দেবীর নাম অর্শিয়া। যদিও তিনি ছিলেন একজন মর্তের মানবী। তার বাবা ইরেকথিয়াস ছিলেন এথেন্স-এর শাসক। একদিন রাজকুমারী অর্শিয়া যখন ইলোসাস নদীর তীরে একাকী হাঁটছিলেন দখিনা বাতাসের দেবতা বোহেঁস প্রথম দেখাতেই তাঁর প্রেমে পড়লেন এবং তিনি জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন ইগগ্রোনাস নদীর তীরে স্পার্ডিয়ন পাহাড়ে। তার পর তাকে মেঘের আচ্ছাদনে ধর্ষণ করলেন। তার কাছে এই নিষ্ঠুরতা খুব স্বাভাবিক মনে হল, কারণ তিনি ছিলেন দেবতা আর অর্শিয়া ছিলেন সামান্য মানবী।
অর্শিয়া দুই মেয়ে ও দুই ছেলের জননী হলেন। তার মেয়ের নাম চিউনি ও ক্লিওপেট্রা আর দুই বায়ু সন্তান ক্লাসিয়াস ও জেথাস। যার দু'জনেই বোরাস নামে পরিচিত। এই ছেলেগুলোই পরবর্তী কালে আরাগোন্স-এর সঙ্গে বিভিন্ন অভিযানে বের হয়েছিলেন। তারও পরে মানবী অর্শিয়াকেই দেবরাজ জিউস পাহাড়ী ঠাণ্ডা বাতাসের দেবী বানিয়ে দিয়েছিলেন। কথিত আছে, পারস্য যুদ্ধে তিনি শীতল হাওয়া, কুয়াশা এবং তুষার দিয়ে অনেক জাহাজ ধ্বংস করেন। তাকে ট্রয় যুদ্ধের সময়ও অনেক যোদ্ধা, এমনকী দেব-দেবীরাও তার সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন।
এই শীতকাল নিয়েই গ্রিক পুরাণে আমরা দেখি দেবরাজ জিউস মনে করেছিলেন, মানুষ একদিন শক্তি সঞ্চয় করে দখল করে নেবে তাঁর স্বর্গ এবং তাদের প্রতি কোনও প্রার্থনাই তারা করবে না। দেবরাজ জিউস মানুষের উপরে ক্ষোভের ফলে অর্শিয়াকে ঠাণ্ডা বাতাস বইয়ে দিতে বলেন পৃথিবীতে। ডেমিটারকে বলেন, শীতের প্রকোপ বাড়িয়ে দিতে। প্রচণ্ড শীতে মানুষের এই অসহায় অবস্থা দেখে করুণা জাগে প্রমিথিউসের। তিনি শীতে কম্পমান ও অন্ধকারে ভীত মানুষদের প্রতি দয়াপ্রবণ হয়ে জিউসের প্রাসাদের মশালের কয়লার টুকরা থেকে আগুন চুরি করে এনে দেন মানুষকে। তিনি আগুনের ব্যবহারও মানুষকে শিখিয়ে দিয়ে যান, যাতে মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে পারে শীত ও অন্ধকারের কাছ থেকে। এ জন্য প্রমিথিউসকে সইতে হয় কঠোর শাস্তি। কিন্তু মানুষ রক্ষা পায় শীতের প্রকোপ থেকে। এমনই একটি উপকথা চালু আছে পেরুর নিপমোক উপজাতিদের ভেতর।
শীত এলেই চারদিকে শুরু হয়ে যায় চড়ুইভাতির তোড়জোড়। লোকে তখন পিকনিক করার জন্য সক্কাল-সক্কাল বেরিয়ে পড়েন বারুইপুর, বারাসত, গাদিয়ারা, ডায়মন্ড হারবার, ব্যান্ডেল চার্চ, আটান্ন গেটের মতো কাছাকাছি কোথাও। যান ভিড় জমান চিড়িয়াখানা, সায়েনসিটি, ভিক্টোরিয়া, ইকো পার্ক, জাদুঘর, বোটানিকেল গার্ডেন, নিকোপার্কে।
এই সময় ধর্মতলার ময়দান জুড়ে চলে পুরোদস্তুর শীতের আমেজ। পিঠে মৃদু রোদ্দুর মেখে দু'চোখ ভরে দেখে মাদারির খেলা। শোনে দেশওয়ালি গান। রামায়ণ পাঠ। সে সব ঘিরে ওই চত্বর জুড়ে বসে যায় মেলা।
এই সময় ভিড় উপচে পড়ে শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায়। আগে থেকে বুক করে না রাখলে হোটেলের ঘর পাওয়া যায় না। ভিড় হয় অজয় নদীর তিরে জয়দেবের মেলা ওরফে কেঁদুলি মেলায়।
ও পার বাংলার লোক তখন ভিড় জমান কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, বান্দারবান, নিঝুমদ্বীপে।
এই শীতেই লোকে ছুটে যায় আরও শীতলতম জায়গায়। সিমলা, কুলু, মানালি, দার্জিলিংয়ে। শুধুমাত্র তুষারপাত দেখবে বলে। এই শীতেই প্রেমিক-প্রেমিকারা আইসক্রিম খেতে খেতে হাত ধরে হেঁটে যায়।
গোটা শীতকাল জুড়েই দিন ছোট আর রাত বড় হয়। প্রচলিত আছে যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন, পঁচিশে ডিসেম্বর থেকেই দিন বড় হতে শুরু করে। রাত ছোট হতে থাকে। আর শীতের প্রকোপও একটু একটু করে কমতে থাকে। তবু শুধু পঁচিশে ডিসেম্বরে নয়, তেইশে জানুয়ারি, এমনকী ছাব্বিশে জানুয়ারিতেও, শীত যাই যাই করলেও, সে সময় বিশেষ দিন বলে কোনও লোকজন আর বাড়িতে থাকে না। পিলপিল করে বেরিয়ে পড়ে সব। শুধু মানুষ নয়, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এ দেশে উড়ে আসে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখিরাও।
আর ফাস্ট জানুয়ারি? সে দিন দক্ষিণেশ্বর মন্দির তো একেবারে উপচে পড়ে। উপচে পড়ে বেলুড় মঠ, সারদা মায়ের বাড়িও। ভোর থাকতে লাইন পড়ে যায় কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। কারণ, এই উদ্যানবাটীতেই ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারিতে ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস কল্পতরু হয়েছিলেন। সেই কল্পতরু উৎসব এখন মহাধুমধাম করে সর্বত্র পালিত হয়। পালিত হয় এই শীতকালেই।
তবে হ্যাঁ, একটা কথা মনে রাখতেই হবে। শীতের এই মরসুমটা উপভোগ্য হলেও, দেখা দিতে পারে কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা। তাই এই সময়ে একটু বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন।
মনে রাখবেন, এই সময় সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি আপনার ত্বককে ক্ষতি করতে পারে। তাই বাহিরে যাওয়ার আগে অবশ্যই ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে নিন।
চোখের ওপরের পাতায় হালকা অ্যাশ (ছাই) বা বাদামি রংয়ের শ্যাডো দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শ্যাডোর রং যতটা ন্যাচারাল হবে ততই ভাল। এর পর চোখের নীচে পছন্দ মতো রং--- নীল, সবুজ, বেগুনি দিয়ে রেখা টেনে নিতে পারেন।
ঠোঁটে হালকা গোলাপি বা বাদামি রংয়ের লিপস্টিক লাগাতে পারেন। মনে রাখবেন, স্মকিআইয়ের সঙ্গে গোলাপি ও পিচ রঙের লিপস্টিক বেশ মানানসই।
স্ট্রেইট করে চুল ছেড়ে রাখতে পারেন বা চাইলে চুলের নীচের অংশে কার্ল করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে মেকআপ হতে হবে হালকা।শীতে চুল বাঁধা যেতে পারে ব্যালোরিনা স্টাইলে। উঁচু করে চুল উঠিয়ে খোপাও করে নিতে পারেন। চাইলে সামনের চুল খানিকটা পাফ করে নিন।
নখে লাগাতে পারেন গাঢ় সবুজ, নীল, মেরুন, কালো বা হাল্কা রঙের নেইলপলিশ।
এই ভাবেই নিজেকে সাজান। অন্যকে সাজান। আর এই শীতকালটাকে যতটা পারেন, আরও রঙিন, আরও সুন্দর, আরও মধুময় করে তুলুন।
সিদ্ধার্থ সিংহ, ২৭/পি, আলিপুর রোড, কলকাতা
শেয়ার করুন