আপডেট :

        রিশাদের ব্যাটে বাংলাদেশের সিরিজ জয়

        কণ্ঠশিল্পী খালিদ মারা গেছেন

        বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ

        গুণী প্রধান শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান

        বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃ‌তিতে আইরিশ মন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন

        ইসলামবিদ্বেষ ঠেকাতে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস

        বাংলাদেশ-বৃটেন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫১ বছর: বৃটিশ হাইকমিশনার

        ঢাকায় সুইডিশ রাজকন্যা

        ইরাকের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তা করবে আইএইএ

        বিস্ফোরক মামলায় যুবদল-ছাত্রদলের ৪ নেতা কারাগারে

        জিএসপি সুবিধার মেয়াদ ২০৩২ সাল পর্যন্ত বাড়াতে আয়ারল্যান্ডের সমর্থন চাইলেন প্রধানমন্ত্রী

        ট্রাম্প মানসিকভাবে অসুস্থ: জো বাইডেন

        জৈন্তাপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬

        বিএনপি ইফতার পার্টিতে আল্লাহ-রাসুলের নাম না নিয়ে আওয়ামী লীগের গীবত গায়: প্রধানমন্ত্রী

        মার্কিন গণতন্ত্রকে কটাক্ষ পুতিনের

        শাল্লায় বিল শুকিয়ে মৎস্য আহরণ

        দেশে যুক্তরাষ্ট্রের পাপেট সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত সব নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ: সজীব ওয়াজেদ জয়

        সিএনজি-লেগুনা’র দখলে রাস্তা

        তিন বিভাগে ৩ দিন বৃষ্টির সম্ভাবনা

        এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম

অনুবাদ গল্প

অনুবাদ গল্প

 

চেচনিয়া
লেখকঃ অ্যান্টনি মারা
অনুবাদকঃ সৌমিত্র চৌধুরী

বোন নাতাশা মারা যাবার পর থেকে হাসপাতালেই ঘুমাতে শুরু করল সনিয়া। মাসে কয়েক দিন বাড়ি ফিরে এসে জামা কাপড় কেচে নিত। সেই দিন গুলোও কমে আসতে লাগল। বাড়ি ফিরবার, জামা কাপড় কাচবার তো কোন দরকার নেই। হাসপাতালে নার্সের গাউন পরেই চালিয় নিত। ট্রমা ইউনিটের খাটে ঘুম ভাঙত তাঁর। যে কোন সময়ে গুরুতর চোট পাওয়া কোন মানুষ আসতে পারে। তাই ইচ্ছে করেই রাত্রি বেলা ওখানে ঘুমাত সনিয়া। কোন কোন দিন রোগীর পরিজনদের পায়ের আওয়াজ কিম্বা চিৎকারে জেগে উঠে নিজের বিছানায় আহতকে শুইয়ে দিয়ে পরিচর্যা শুরু করে দিত। বুঝতে পারত সে জেগে আছে। এরকম কোন মর্মান্তিক ঘটনা স্বপ্নে দেখছে না।
সনিয়া সেদিন খাটে শুয়ে। এক নার্সের আওয়াজ, ‘একজন লোক তোমার জন্য অপেক্ষা করছে’।  
ক্লান্তি মুছে নিয়ে চোখ খুলল সনিয়া। বলল, ‘কেন? কী ব্যাপার?’
নার্সের স্বরে ইতস্ততা। বলল, ‘তিনি এখানেই দাঁড়িয়ে আছেন’।
মিনিট খানেক পরে হল ঘরের পথে দাঁড়িয়ে লোকটি তাঁর পরিচয় জানাল, ‘আমার নাম আখমেদ’।
রাশিয়ান ভাষায় বলল বটে তবে বেঠিক উচ্চারণ ভঙ্গি। তাই সনিয়া স্বাচ্ছন্দে চেচন ভাষাতেই কথা বলতে লাগল। আখমেদের মুখে ছোট দাড়ি ঝুলছে। ওর দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন মানুষটি বেশ ধর্ম পরায়ন গোছের। পরমুহুর্তেই মনে হল বেশির ভাগ পুরুষই তো আজকাল দাড়ি রাখছে! ক’জন আর দাড়ি কাটার ক্রিম কিনতে পারে? ক’জনের ঘরে আয়না আছে? যুদ্ধের ফলে দেশবাসীর গাল আর চিবুকে ধর্ম ভাব গজিয়ে উঠছে।
লোকটি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বছর আটেকের এক মেয়ের দিকে ইঙ্গিত করলেন। বললেন, ‘আমি আর আমার স্ত্রী এর কোন যত্ন নিতে পারছি না। আপনি একে কাছে রাখুন’।
‘এটা কোন অনাথ আশ্রম নয়’।
এই ধরনের অনুরোধ অস্বাভাবিক কিছু নয়। হাসপাতালটি জনসেবার জন্য অর্থ সাহায্য পায়।  খাবার এবং পরিষ্কার জল আছে এখানে। সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ, এখানে জাতি কিম্বা সামরিক আনুগত্যের হিসাব না করে আহতদের চিকিৎসা করা হয়। হাসপাতাল তৈরি হয়েছে পরিত্যক্ত এক বিশাল বাড়িতে। সরকার এবং বিদ্রোহী, যুদ্ধরত দুই পক্ষের কেউই আক্রমণ করেনি বাড়িটাকে।
সনিয়া মাথা নাড়াল। প্রতিদিন যুদ্ধে আহত মানুষগুলো আসছে। তাঁদের চিকিৎসা করবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই এখানে। প্রতিদিন অসংখ্য আহত মানুষের মৃত্যু ঘটছে। তার মধ্যে সুস্থ এক বাচ্চার দেখ ভাল করা তার পক্ষে অসম্ভব।
‘শনিবার বিদ্রোহীরা এসে এর বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। রবিবার সেনাবাহিনী মাকেও তুলে নিয়ে গেছে’। আখমেদ বলল।
দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে সনিয়া। যেন তারিখটা দেখলে সময় বুঝে নিতে পারবে। ‘আজ তো সোমবার’, সনিয়া বলল।
আখমদের মুখ ঝলমল করে উঠল।সনিয়া অনেক সময় বিদ্রোহীদের, কখনও বা সৈন্যদের আচরনে বিরুদ্ধতা দেখতে পায়। তবে সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে কখনই নয়।
‘আমি পারবো না,’ সনিয়া বলল। তবে গলার আওয়াজ দুর্বল ঠেকল। কাঁপা স্বর আর তাতে যুক্তির অভাব।
‘যুদ্ধের আগে আমি ডাক্তারি পড়তাম। মানে মেডিকেল ছাত্র’। চেচনিয়া ভাষায় বলছিল আখমেদ, ‘এটা আমার শেষ বছর। আমি এখানেই কাজ করবো যতদিন না মেয়েটির জন্য একটা বাড়ি ঠিক করতে পারি’।
সনিয়া করিডোরে আকিয়ে দেখে নিচ্ছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন রোগী। কোনও চিকিৎসক নেই। যাদের হতে অর্থ আছে, উঁচু ডিগ্রি আছে আর সময়মত বিদেশে পালাতে পেরেছে, তারাই দেশের এই হাল করে ছেরেছে।
‘বাবা-মা’রা স্থির করছে কোন্‌ দিন কোন্‌ সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেবে। তাই বলছি এই মেয়েকে কেউ খাওয়াবে না,’সনিয়া বলল।
‘তাহলে আমিই এখানে কাজ করবো’।
‘সে কি কথা’?
এবারসনিয়া মেয়েটির দিকে তাকাল।  ‘ও কথা বলতে পারে? কী নাম তোমার’?
‘হাওয়া, আখমেদ উত্তর দিল।

ছ’মাস আগে সনিয়ার বোন নাতাশাকে ইটালি থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল। কড়া নারার শব্দে দরজা খুলে বোনকে দেখে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি সোনজা। কী সুন্দর স্বাস্থ্য হয়েছে তার বোনটার! বোনকে জড়িয়ে ধরে তার পাছায় চাঁটি মেরে রসিকতা করছিলসনিয়া। ‘পাশ্চাত্য দেশে যতটা আতঙ্ক দেখেছিলি, তার সবটাই চর্বি হয়ে জমেছে তোর পেছনে’।
‘আয়, ঘরে আয়’, নাতাশাকে জড়িয়ে ধরেসনিয়া বলেছিল। নাতাশার মনে হল প্রয়োজনের বেশী সময় ধরে যেন আলিঙ্গন করে রেখেছে সোনজা। সোনজা আর নাতাশা সূর্য ডুবে যাবার আগে  রাতের খাবার খেয়ে নিল। চুল্লিতে আলু সেদ্ধ করে নেওয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী চার বছর আগে বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দিয়েছিল। তারপর কখনও মেরামত করা হয়নি। সোনজা বোনকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। মোমবাতির আলোয় ঘরটি দেখিয়ে বিছানার দিকে ইঙ্গিত করল। বলল, ‘নাতাশা, এই জায়গাতেই ঘুমাতে হবে তোকে।
অত্যন্ত ভালো মানুষের মত একটা সপ্তাহ কাঁটাল তারা। কারুর কোন কৌতূহল নেই। প্রশ্ন নেই। ছোট ছোট কথা চলত নিজেদের মধ্যে। সোনজার চোখে অস্বাভাবিক কিছু নজরে এলেও কোন মন্তব্য করত না। বাথরুমের সিঙ্কে রিবাভিরিন অ্যান্টি ভাইরাল ট্যাবলেটের (হেপাটাইটিস সি রোগের ওষুধ, অনুবাদক) শিশি দেখেও না। এমনকি নাতাশার ঘাড়ে সিগারেটের ছেঁকা দেখেও কিছু বলত না। হাসপাতালে রোগীদের কাটা ছেরার কাজে ব্যাস্ত থাকতসনিয়া আর বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকতো নাতাশা। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে খাবার নিয়ে ঢুকতসনিয়া আর নাতাশা খেয়ে ফেলত। সকাল বেলা উনুন জ্বালাতসনিয়া আর নাতাশা তখনও ঘুময়েই থাকত। সকাল হত, রাত্রি নামত। জীবন এভাবেই চলে যাবে, ভাবতোসনিয়া।
আখমেদ কথা রেখেছিল। সনিয়া মেয়েটিকে রাখতে রাজি হবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে নিয়ে হাসপাতালের পোশাক গায়ে চাপাল। সনিয়া ওকে হাসপাতাল দেখাতে নিয়ে গেল। বড় বাড়িটার দু’টো মাত্র তলা খোলা। বাকী তলার ঘর গুলো কর্মীর অভাবে বন্ধ হয়ে থাকে। কারডিওলজি, ইন্টেরনাল মেডিসিন আর এন্ডোক্রিনলজি বিভাগ গুলো দেখাল। মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরন। তার উপর পায়ের ছাপ পড়ছে তাদের। চাঁদের মাটিতে পায়ের ছাপের কথা মনে পড়ে গেল। লন্ডনে গিয়ে দেখা সেই স্মৃতি।
‘আর সব জিনিষ কোথায়’? আখমেদ জিজ্ঞেস করল। বিছানা চাদর ইনজেকশন-সিরিঞ্জ, গাউন, সারজিক্যাল টেপ, থার্মোমিটার, আইস ব্যাগ, ফরসেপ, কাঁচি –কিছুই তো নেই! কী দিয়ে ডাক্তারি করবো? খালিক্যাবিনেট, খোলাড্রয়ার, টেপ লাগানো কাচের দরজা। পর্দা ঢাকা বন্ধ ঘর গুলোর বাতাস ভারী হয়ে আছে বাসি বাতাসে।
‘ট্রমা আর প্রসূতি বিভাগ গুলো খুব কষ্ট করেই খোলা রাখছি আমরা’।
দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে আখমেদ বলল, ‘ট্রমা সেন্টার! ওটা তো খোলা রাখাই উচিত। কিন্তু প্রসূতি বিভাগ কেন’?
সশব্দে হেসে উঠলসনিয়া। খালি হল ঘর জুড়ে বাজতে থাকল ওর হাসি। বলল, ‘আমি জানি এটা খুব মজার ব্যাপার, তাই না! দেশে প্রত্যেকেই হয় যৌন সঙ্গমে মেতে আছে, নয়তো পটল তুলছে’।
‘না না’। আখমেদ মাথা নাড়ল।  
সনিয়া ভাবল হয়ত আখমেদ ওর অসভ্যতায় বিরক্ত হয়েছে।
‘তারা দুনিয়ায় আসছে আর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই ঘটনাই আখছার ঘটছে এখানে’।
সনিয়া আশ্চর্য হয়ে গেল। ভাবলো, আখমেদ হয়ত খুব ধর্মপ্রাণ এক মানুষ। -০-


[অ্যান্টনি মারা (Antony Marra) আমেরিকার লেখক। রাশিয়াতে পড়াশুনা করেছেন এবং দীর্ঘকাল বসবাস করেছেন। তাঁর এই গল্পটি (Chechnia) অতি বিখ্যাত এবং বহু পুরস্কারে সম্মানিত।

সৌমিত্র চৌধুরী, অনুবাদক। Dr. Soumitra Kumar Choudhuri, M.Sc., Ph.D., ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা]

শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত