আপডেট :

        সিলেট নগরীতে ২১ এপ্রিল থেকে কোভিডের ৩য় ও ৪র্থ ডোজ প্রদান করা হবে

        বৃহস্পতিবার কুশিয়ারা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে বর্ণাঢ্য আয়োজনে এ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়

        প্রথম পতাকার নকশাকারদের অন্যতম শিব নারায়ণ দাশের মৃত্যু

        নদী পেরিয়ে টেকনাফে আশ্রয় নিলেন বিজিপির আরও ১৩ সদস্য

        ইসরায়েলের রাতভর হামলায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি

        বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে ফরিদপুর জেলা সড়ক নিরাপত্তার কমিটির সভা

        মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে: ওবায়দুল কাদের

        দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামলো

        নিখোঁজ হওয়ার পরদিন নদীর তীরে স্কুলপড়ুয়া শিশুর লাশ পাওয়া গেলো

        খোলা তেলের দাম কমলেও, দাম বাড়লো বোতলজাত সয়াবিন তেলের

        দেশে বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে অসংখ্য শিশুরা

        শিশুখাদ্য সেরেলাকে বাড়তি চিনি পাওয়া গেছে বলে উঠে এসেছে এক গবেষণায়

        ফ্রান্সে শুটিং সেটে আহত অভিনেতা প্রিয়াঙ্কা

        জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত পাওয়া এমভি আবদুল্লাহর ২১ নাবিক ফিরছেন দেশে

        জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত পাওয়া এমভি আবদুল্লাহর ২১ নাবিক ফিরছেন দেশে

        দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সহযোগিতায় সমঝোতা সইয়ের প্রস্তাব

        আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে ভারতের ১৮তম লোকসভার নির্বাচন

        আজ বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) মধ্যরাত ১ ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেটে ধীরগতি থাকবে

        ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতির ঘটনা প্রবাহের নজর রাখার নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার

        প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

‘ঘরের ছেলে’ সরদার ফজলুল করিম: বিপ্লবী পাঠের জ্বলজ্বলে প্রদীপ

‘ঘরের ছেলে’ সরদার ফজলুল করিম: বিপ্লবী পাঠের জ্বলজ্বলে প্রদীপ

সরদার ফজলুল করিম

বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢুকে বছর ঘুরতেই সমাজ বিজ্ঞানের নেশায় আবিষ্কার করলাম এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে। এ অঞ্চলের সভ্যতা ও ঐতিহাসিক লড়াইয়ের বড় অংশীদার কৃষক শ্রেণীর উত্তরাধিকার এক আজন্ম সমাজ সচেতন বিদগ্ধ সব্যসাচী সন্তানকে । যার কয়েকটি লাইন আচমকা নাড়া দিয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ভাগে। তিনি বলেছেন -   

‘কিন্তু সূর্য আর ওঠে না। অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর হয়। আর্তনাদ ওঠে। এখন কি উপায়? কোথায় যাব আমরা? কোথায় যাচ্ছি? এখন কে আমাদের পথ দেখাবে? ’

হ্যাঁ বলছি সরদার ফজলুল করিমের কথা । বরিশালের আটিপাড়া থেকে শহরের কেন্দ্রে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে রাজনৈতিক বোধ সচেতনতায় এক নির্ভীক সততা দেখিয়েছেন যিনি আজন্ম ।  দর্শনের শিক্ষকতা থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রদর্শনের ভেতরে কমিউনিজমের রাজনৈতিক লড়াইয়ে একটি স্বতন্ত্র ধারায় নিজেকে গড়ে তুলেছেন। সাম্যবাদী ভাবাদর্শের জন্য ব্যাক্তিস্বার্থ কে জলাঞ্জলি দিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বা এমনকি পার্টি নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে শ্রমজীবি মানুষের মাঝে সাংগঠনিকভাবে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বুঝতেন – “কৃষকের সন্তানের কোনো শৈশব নেই।“ সেজন্য সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি । করে গেছেন নিরন্তর জ্ঞান সাধনা।

পাকিস্তান রাষ্ট্রদর্শন একটি অবধারিত ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে মার্ক্সবাদীদের একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র বয়ান ছিলো। ফয়েজ আহমদ ফয়েজ কবিতায় দেশভাগের যন্ত্রনা নিয়ে কলম তুলেছিলেন। এ জাতিবাদী উন্মাদনার মাঝে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের আঁতুড়সালে জন্ম নেওয়া সরদার খুব পরিষ্কারভাবে জানান দিয়েছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের কমিউনিস্ট বিরোধী আগ্রাসনের কথা । জাতীয়তাবাদ বা পাকিস্তানী ভাবাদর্শ একটি চিন্তাকাঠামো তার অসারতা প্রমান করতে মানুষের মাঝে গিয়ে তাদের ভ্রান্তি কাটাতে হবে যার জন্য নিরন্তর কাজ করে যেতে হবে যার জন্য কোন ধরণের হঠকারী ‘এন্টি পিপল’ অবস্থান নেওয়া যাবে না  । পাকিস্তান রাষ্ট্র তো মানুষের আবাসস্থল হিসেবে প্রাপ্তির লড়াই হিসেবে পাকিস্তানে গণতন্ত্র এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রক্রিয়াটার মধ্যে গণতান্ত্রিক উপকরণগুলো যুক্ত করতে চেয়েছে  । জাতীয়তাবাদীদের সাথে মিশে গিয়ে কমিউনিস্ট কর্মীদের বিচ্যুতি ও প্রাপ্তি নিয়ে সরদারের বোধ ছিলো যে, আসলে কম্যুনিস্টরা লং টার্মে চিন্তা করে। তারা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার টার্মে চিন্তা করেনি।

প্রথমদিকে শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইস্তফা দেওয়ার পরে তাকে থাকতে হয়েছিল কলকাতায় কবি আহসান হাবীবের বাড়িতে। সেখানে ছিল বিচিত্র জীবনযাত্রা। এক রাতে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে চলে এলেন নরসিংদীতে। নরসিংদীর চালাকচরে আত্মগোপন । কেমন ছিল সেই দিনগুলো? জানা যায় তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে-  ‘রাতে থাকতাম  এই যেমন ধরুন, কোনো একটা গরুর ঘর, তার মধ্যে বিছানাপত্র বিছিয়ে আমি থাকতাম। ঐ গ্রাম গরিব এলাকা ছিল। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তেমন কোন চাহিদা ছিল না আমার। হয়তো কোনদিন একটি পুঁটিমাছ দিয়ে বা কোনোদিন পাটকাঠি দিয়ে শুঁটকি মাছ পুড়িয়ে তা দিয়ে কিছু ভাত খেলাম। সে এলাকায় সাধারণ মানুষ সবসময় ভাত খেতে পেত না। ওটা আবার কাঁঠালের এরিয়া ছিল। কাঁঠালের সিজনে, সকাল বেলা কিছু কাঁঠাল দিত, সেই কাঁঠালের কোষ খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিতাম।’

তৎকালীন কাপাসিয়া, মনোহরদী, চরসিন্ধুরসহ নানান গ্রামে আত্মগোপনে সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একসময় আবার ঢাকায় এলেন আত্মগোপনের মাঝেই। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে ঢাকা জেলে রাজবন্দীরা প্রথম ভাগের ৪০ দিনব্যাপী অনশন ধর্মঘট শুরু করলেন।

সরদার ফজলুল করিম ঢাকায় এসে উঠেছিলেন  সাংবাদিক ও কবি সন্তোষ গুপ্তের বাড়িতে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা শহরের তাঁতি বাজার থেকে সরদার ফজলুল করিম তাঁর কয়েকজন বন্ধুসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তিনি যখন কারাগারে তখন রাজবন্দী হিসেবে মর্যাদা আদায়ের দাবিতে রাজবন্দীদের দ্বিতীয় দফা অনশন ধর্মঘট চলছিল এবং কারাগারে ঢুকে সাথীদের সঙ্গে তিনিও অনশনে যোগ দেন রাজবন্দী হিসেবে মর্যাদা আদায়ের দাবিতে। অনশনের প্রথম ছ’দিন ‘কারা প্রকোষ্ঠের’ মধ্যে দিনরাত মেঝেতে চোখ বুজে শুয়ে থাকতেন। মাথার কাছে জেলের সিপাহী জমাদার সকাল বিকাল ভাত-তরকারি থালায় করে রেখে যায় তার সামনে। কিন্তু তিনি সেগুলো ছুঁতেন না। শুধু মাঝে মধ্যে কেবল সামান্য লবণ মিশিয়ে পানি খেতেন। ছ’দিন পর সরদার ফজলুল করিম স্বেচ্ছায় অনশন না ভাঙার কারণে তাকে হাসপাতালে আনা হয় এবং তাকে অন্যান্য অনশনরত বন্দীদের সঙ্গে জবরদস্তি করে খাওয়ানোর বা ‘ফোর্সড ফিডিং’ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রোজ সকালে দশটার দিকে তাগড়া, জোয়ান একদল সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীসহ জেল হাসপাতালের কম্পাউন্ডার বা ডাক্তার একটা বাহিনী নিয়ে এসে চড়াও হত। তাদের হাতে থাকত বালতির মধ্যে পানির সঙ্গে দুধের পাউডার মেশানো ‘দুধ-পানি’। ফোর্সড ফিডিং-এর এই বাহিনী প্রত্যেক বন্দির কাছে গিয়ে বন্দিরা যেন বাধা দিতে না পারে সেজন্য তার হাত পা চেপে ধরত। তাদের হাত পা চেপে ধরে তাদের নাকের মধ্য দিয়ে একটা রবারের নল পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত। এই রবারের নলের ওপর দিকে রাখা বাটি বা কুপিতে সেই দুধ মেশানো পানি ঢেলে দিত। এভাবেই খাওয়ানো হতো অনশনরত বন্দিদের। শুরু থেকে যারা অনশন করেছিলেন তাদের ৫৮ দিন পুরো হওয়ার পরে একটা ফয়সালা হয়। আর সরদার ফজলুল করিম ত্রিশ দিন পুরো অনশন করেন। এর মাধ্যমে কাপড়-চোপড় এবং থাকা খাওয়ার ব্যাপারে কিছু মর্যাদা এবং উন্নত অবস্থার স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাদের। দীর্ঘ সোয়া পাঁচ বছর পর ১৯৫৫ সালের মার্চে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম। কারাবন্দী থাকা অবস্থাতেই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম। বিখ্যাত মার্কিন পত্রিকাগুলো কারাবন্দী থাকা অবস্থাতে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার খবর ফলাও করে ছেপেছিল। এক বিখ্যাত পত্রিকার শিরোনাম ছিল  ‘One communist from jail elected to constituent Assembly!’

১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত গণপরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। এসময় করাচীতে ছিলেন সরদার ফজলুল করিম। তার নামের আগে সরদার থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা মনে করত তিনি আসলেই সরদার গোষ্ঠীর এবং খুব প্রভাবশালী। কিন্তু, কিছুদিন পরেই ভুল ভাঙল তাদের।
তিনি আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন। তার বাসাতে সবসময় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ভিড় লেগে থাকত। তার চালচলন ছিল সাদাসিধে। তখন বেলুচের সীমান্ত গান্ধী তথা খান আবদুল গাফফার খানের কর্মীরা তার সঙ্গে দেখা করতে আসত।

অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, ‘সমারসেট হাউজে পার্লামেন্টের বাঙালি মেম্বাররা সাধারণত উঠতেন। একবার সরদার ভাই এসেছিলেন, আমাদের সরদার ফজলুল করিম। তার ওখানে গিয়েও দেখি সাক্ষাৎ প্রার্থীদের জমায়েত বটে। তবে এ আরেক কিসিমের। পাগড়ি মাথায়, পরনে লম্বা ঝুলের ঢোলা কামিজ, ঢোলা পাজামা পেশোয়ারি পাঠান। সবাই সীমান্তগান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের অনুগত কর্মী।  রাজনৈতিক কারণে কারা নির্যাতিত এক বাঙালি সরদারের সঙ্গে এঁরা মিলতে এসেছেন। দেখবার মতো সে দৃশ্য। এদিকটায় ছ’ফুট/সোয়া ছ’ফুট ইয়া ইয়া দশাসই জওয়ান পাঠান-নন্দন ওরা কয়েকজন, বিপরীতে বসে ছোটখাটো কৃশকায় মলিন অবয়বের এক বাঙালি সরদার। পলিটিকাল কথাবার্তা… আগ্রহে-শ্রদ্ধায় ওঁরা শুনে গেলেন। কী বিষম অহঙ্কার আমার, বাঙালিদের মুল্লুকেও তাহলে সরদার জন্মায়। সরদার ভাইয়ের মুখে বিনীত হাসি।’

নিজের স্মৃতিকথায় ২০০১ সালে সরদার ফজলুল করিম কমিউনিস্ট জীবন বোধের এক খসড়া হাজির করেন ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে - "কমিউনিস্ট পার্টিকে আমি একটি পরিবারের মতো দেখতাম। মেম্বাররা ছিল ভাইয়ের মতো। যেমন রবি গুহ কিছুই আমাকে ছাড়া খেত না; পূজার প্রসাদও আমাকে দিয়ে তারপর খেত।

কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার কেউ হতে চাইতো না। ভাবত, আমি মেম্বার হওয়ার উপযুক্ত নই। পার্টি মেম্বার করতে চায়, কিন্তু কর্মীরা মেম্বার হতে চায় না—এ রকম ছিল অবস্থা।

উচ্চ ধারণা ছিলো সবার কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে। সমাজ বদলাতে চাই আমরা, সেজন্যে কষ্ট করতে হবে, যদি না পারি তা করতে, তবে মেম্বার হব কী করে?

আমি নিজেকে পার্টির মেম্বার হিসেবে কোনোদিন দেখিনি। আমি মেম্বারশিপ ফি দিলাম, তারা আমার কাছ থেকে ফি নিল—এটা কখনো হয়নি। আমি ছিলাম ঘরের ছেলে।"

সরদারের এই আলাপটা গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তিবোধ, বাস্তবতা সম্পর্কিত নৈবক্তিকতার পাশাপাশি একজন রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে প্রয়োজন একটা পরিবর্তিত উন্নত মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ। এ যেন নিজের সাথে নিজের লড়াই। আজীবন সাম্যবাদী যে স্বপ্ন কোন বিপ্লব আকাঙ্ক্ষী ফেরী করে বেড়াবেন তার পূর্বশর্ত তো নিজের সাথের পথের সাথীকে বিশ্বস্ততা আর ভরসার বলয়কে শক্তভাবে আগলে রাখা। কেননা, বিপ্লব একটি অবশ্যম্ভাব্য বাস্তবতা এবং সরদার বিশ্বাস করতেন “এটি উপায়হীন মানুষের রক্ত শোষনকারীর কৃমির ওষুধ বিশেষ”। 

কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখার অনুপাতের চেয়ে সক্রিয় বিপ্লবী তৎপরতা তাঁদের নিজস্ব শক্তির ভিত্তি বলে যিনি মনে করতেন তিনিই সরদার ফজলুল করিম ।

তৎকালীন বাস্তবতার রাজনৈতিক অস্তিত্বের বোধের যে উজ্জ্বল নিদর্শন দেখা যায় তার ভিত্তি পাওয়া যায় আরেকটি ঘটনায় । পাকিস্তানি এক সাংবাদিক কবি ফয়েজ আহমেদকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি কমিউনিস্ট?’ ফয়েজ ভাবলেন কিছুক্ষণ, তারপর উত্তর দিলেন, ‘না, আমি কমিউনিস্ট নই। কমিউনিস্টের বড় পরিচয়, সে একজন কমরেড; যে কমরেড পার্টির বৈধ পরিচয় পত্র বহন করে; একইসাথে তার বিপ্লবী দায়িত্বও পালন করে। এখন কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিপি) পাকিস্তানে নিষিদ্ধ, তাহলে আমি কিভাবে কমিউনিস্ট?’

সরদারের স্মৃতিকাতরতার সাথে ফয়েজের সম্পুরক এ ঘটনা বিশ্লেষনে আমরা এ বিচ্ছিন্ন ও ছিন্নমূল  ভরসাহীন সময়ে কেউ যদি ঘরের লোক নিজেকে না করতে পারে তবে কমিউনিজম তো আদতে তার কাছে ভূতের মতো কেননা ঘরের মানুষ আর কতজনই বা হয়ে উঠতে পারে। আপনজনদের আকড়ে রাখতে পারতে হয় এ এক অদ্ভুত সম্পর্কের অধিকারবোধের জায়গা থেকে।

বিপ্লব বা সমাজ পরিবর্তনের নিরন্তর এ লড়াইয়ে আগে আপনজনদের কাছে ভরসার যায়গা অর্জন করতে হয়। হয়ে উঠতে হয় 'ঘরের ছেলে'। নূন্যতম এ অঙ্গীকারবোধের শর্তে আমি ব্যাক্তিগতভাবে কমিউনিজম পাঠ করি।

পাকিস্তান আমলে এক দশকের বেশী জেলজীবনের মাঝে  ১৯৭১ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সরদারকে  গ্রেফতার করে। এক পর্যায়ে একজন পাকিস্তানি মেজর এসে বলেন, ইউ আর এ বাস্টার্ড সান অব তাজউদ্দীন। আই শ্যাল টিচ ইউ।

শেষ পর্যন্ত তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রাখা হয়। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে তিনি ১৭ ডিসেম্বর জেল থেকে বেরিয়ে আসেন।
সরদার ফজলুল করিম ১৯৭২ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলেন, তখন দেখা ওসমানের সঙ্গে। ঘটনা প্রসঙ্গে ওসমান বলছে, ‘স্যার আপনি তো একটা ডেঞ্জারাস লোক। আপনি সেই যে পাকিস্তান ভাঙ্গবেন বইলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাড়লেন, পাকিস্তান না ভাইঙ্গা আপনি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলেন না।’ সরদার ফজলুল করিম এরপর  লিখেছিলেন, ‘আমার জীবনটাকে আমি এই দৃষ্টিতে দেখিনি। কিন্তু ওর অবজারভেশনে যে কিছুটা সত্য আছে তা অস্বীকার করি কি করে?’

জাতীয়য়াবাদী উন্মাদনাতে কমিউনিস্ট তার ব্যাক্তিগত লড়াইকে হারিয়ে যেতে দেয় না এবং সাম্যের প্রকাশভঙ্গি যে আদতে আরেকটু বিস্তৃতভাবে অনুধাবনের বিষয় তা সরদারের এ দৃষ্টিভংগিতে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে।  

বাংলাদেশপর্বে তিনি সরাসরি রাজনৈতিক সংযোগ না রেখে শিক্ষকতা ও জ্ঞানচর্চা করে গেছেন নিরলসভাবে।  প্রাচীন গ্রীকদর্শন ও মার্ক্সবাদী সাহিত্য অনুবাদ করেছেন।

নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন  পতনের পর অনেকের মোহমুক্তি ঘটে যার ফলে আদর্শ পরিবর্তনের ব্যাক্তি স্বার্থের এ জুয়ো খেলার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সরদার ফজলুল করিম বিরুদ্ধস্রোতে হাঁটেন ও ঘোষণা করেন, কেউ যদি কমিউনিস্ট না থাকে, তিনি একাই কমিউনিস্ট থাকবেন। ১৯৯৩ সালে সরদার আওড়েছেন, “বিপ্লব , সমাজতন্ত্র মরনচাঁদের রসগোল্লা নয়। তিক্ত চিরতার পানি”।  

ঘরের ছেলে সরদার ফজলুল করিম তো বিশ্বাস করতেন,
‘জীবন বনাম মৃত্যুর যে লড়াই আজ চলছে, তাতে জীবনই জয়ী হবে, মৃত্যু নয়।’

তাঁর জীবদ্দশায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে তাকে মধ্যাহ্নভোজনের আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, Your time is valuable and my time is also valuable. Let us not waste our time.’ (‘তোমাদের সময় মূল্যবান এবং আমার সময়ও মূল্যবান। আমরা আমাদের সময় অপচয় না করি’।)

সরদার ফজলুল করিমের জীবনপাঠে মতাদর্শগত দাসত্বের অন্ধ যান্ত্রিকতার চেয়ে ব্যাক্তিগতভাবে নিরন্তর এক 'উন্নত মানুষ' হয়ে উঠার লোভটা জিইয়ে রাখলে পৃথিবীটাকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ২০১৪ সালের ১৫ জুন  ৮৯ বছর বয়সে তার সব অস্তিত্বটুকু ছড়িয়ে রেখে বিদায় নিয়েছেন। বোধকে অনুকরণীয় পাঠ করে রেখে গেছেন যিনি সুবিধাবাদকে বারবার প্রত্যখ্যান করে দিরে গেছেন সরলতার সে প্রাণবন্ত আকাঙ্ক্ষিত আরাধ্যতা । যিনি বারবার কুর্নিশ করে গেছেন কৃতজ্ঞতাভরে তাঁর লেখায়, ‘আমার বাবা-মা নিরক্ষর এবং একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন। তাদের মতো লোকের কথা ছিল না আমাকে স্কুলে পাঠানোর। কিন্তু তারা আমাকে স্কুলে পাঠিয়েছেন। সেজন্য আমি এ-মাটির মানুষগুলোর কাছে ঋণী এবং এই দেশের মাটির প্রতি আমার মনের মধ্যে একটা ভক্তি জেগে আছে।’

সরদার বিশ্বাস করতেন, 'আমার মৃত্যু হবে না, আমি আপনাদের মাঝে বেঁচে থাকবো''।

হ্যাঁ । জ্ঞান চর্চার বাতিঘর হয়ে সরদার বেঁচে আছেন জ্ঞান পিপাসুদের মাঝে । 

দোহাই:
আমি মানুষ, সরদার ফজলুল করিম
সরদার ফজলুল করিম, আমি সরদার বলছি , অন্বেষা - ফেব্রুয়ারি, ২০১৩
দিনলিপি, সরদার ফজলুল করিম।
চল্লিশের দশকের ঢাকা, সরদার ফজলুল করিম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ: অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা, সরদার ফজলুল করিম
সরদার ফজলুল করিম : "সেই সে কাল: কিছু স্মৃতি কিছু কথা" (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ফেব্রুয়ারি,২০০১)

লেখক: রাফসান আহমেদ ; সাংস্কৃতিক কর্মী, নৃবিজ্ঞান ও দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ বাস্তবতা নিয়ে আগ্রহী পাঠক ।

শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত