ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা বাস্তবতার দ্বারা আক্রমণের শিকার
ব্রিটেনে ২০১০ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে কনজারভেটিভ পার্টি। কিন্তু গত কয়েক বছরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা বাস্তবতার দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। ব্রেক্সিট ইস্যুতে ডেভিড ক্যামরনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ (বর্তমানে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী) থেকে বিদায় নিতে হয়। করবিনবাদকে প্রত্যাখ্যান করায় বিদায় নিতে হয় থেরেসা মেকে।
করোনা মহামারি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পদ ছাড়তে হয় বরিস জনসনকে। অর্থনৈতিক সংকট বাড়িয়ে চলে যান লিজ ট্রাসও। ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রথম ভাষণে অর্থনৈতিক সুরক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু খুব বেশি এগোতে পারেননি। তাই তো তাকেও হয়তো বিদায় নিতে হতে পারে আগামী ৪ জুলাইয়ের নির্বাচনের মাধ্যমে। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার তালিকায় শীর্ষে আছেন বিরোধী লেবার পার্টির নেতা কেইর স্টারমার।
বিতর্ক পিছু ছাড়েনি, চাপে সুনাক
৪৪ বছর বয়সি এই রাজনীতিককে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় বছর ২২ আগে। তখন তিনি নেহাতই সাধারণ যুবক। বরাবরই অভিযোগ আছে, তিনি সাধারণ মানুষের নেতা নন। এই বিতর্কের শুরু বিবিসির একটি তথ্যচিত্রের সূত্র ধরে। মধ্যবিত্ত সমাজ প্রসঙ্গে সেই সময় সুনাকের বক্তব্য ছিল, ‘তারাই আমার বন্ধু যারা অভিজাত। আমার বন্ধুরা উচ্চবিত্ত শ্রেণির। খেটে খাওয়া মানুষ নন।’ গত অক্টোবর নারী-পুরুষ নিয়ে মন্তব্য করেও বিতর্কের মুখে পড়েন সুনাক। মানুষ চাইলেই তার ইচ্ছেমতো লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে না বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। আর তার পরিবার রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের চেয়েও ধনী—এই বিতর্ক তো আছেই। তিনিই দেশটির সবচেয়ে ধনী প্রধানমন্ত্রী।
ইনফোসিস প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণমূর্তির মেয়ে অক্ষতা হলেন সুনাকের স্ত্রী। একসময় অক্ষতার বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছিল। ব্রিটেনের বাসিন্দা হয়েও স্থায়ী বাড়ি অন্য দেশে দেখিয়ে কর ফাঁকি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। পরে অবশ্য সেই ভুল শুধরে নিয়েছিলেন সুনাকপত্নী।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও অক্ষতা বিতর্কে জড়ান। ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলাকে ব্রিটিশরা মেনে নেয়নি। অথচ রাশিয়ায় ব্যবসা চালিয়ে সেখান থেকে টাকা আয় করেছিলেন সুনাকের স্ত্রী। অক্ষতাকে নিয়ে আরো বিতর্ক বাঁধে গত বছর মে মাসে। স্টাডি হল নামে শিক্ষা-প্রযুক্তিবিষয়ক একটি সংস্থার অন্যতম শেয়ার হোল্ডার তিনি। এই সংস্থাটি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ পাউন্ড অনুদান পেয়েছিল বলে অভিযোগ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে সম্পত্তির খতিয়ান দিতে গিয়ে অক্ষতার সংস্থার কথা উল্লেখ করলেও সরকারি অনুদানের কথা বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন বলে বিরোধীরা অভিযোগ। এর আগেও অক্ষতার বিরুদ্ধে উঠেছিল অভিযোগ। সুনাকপত্নীর শিশুকল্যাণ সংস্থার বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে সরকারি অনুদান লাভের দাবি করেছিল বিরোধী দলগুলো। এমনকি নিরামিষভোজী শাশুড়ি সুধার একটি মন্তব্যের আঁচও সুনাকের গায়ে পড়ে। সুধামূর্তি মন্তব্য করেছিলেন যে, তিনি সব সময় নিরামিষ খাবার তার সঙ্গেই রাখেন। কারণ আমিষ আর নিরামিষ রান্নায় একই চামচ ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে তার সন্দেহ থাকে।
দল নিয়েও সংকটে সুনাক
প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ব্রিটেনের বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত ছয় মাস আগে আগাম জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। নানা জল্পনা-কল্পনার পর গত ২২ মে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে ৪ জুলাই জাতীয় নির্বাচনের এই ঘোষণা দেওয়া হয়। ছোট্ট একটি ঘটনায় গত বছরের শুরুর দিকে দলের মধ্যে বিরোধের মুখে পড়েন সুনাক। দলের মন্ত্রীদের সঙ্গেই তার মতবিরোধ তৈরি হয়। ঋষির দলের অনেকেই দাবি তুলেছেন, ব্রিটেনে শিশুদের নীলছবি দেখার ওপর আরো বেশি নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রয়োজন আছে। যদিও এতে ঋষি সায় দেননি। গত বছরের জুলাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে হেরে যায় কনজারভেটিভ পার্টি। নির্বাচনের মাত্র ১৫ দিন আগে গত সপ্তাহে জুয়ার অভিযোগে বিদ্ধ ঋষি সুনাকের দল। ব্রিটেনে নির্বাচন কবে হবে, সেই নিয়ে জুয়া খেলতেন অভিযুক্তরা। সেই অভিযোগেই গ্রেফতার হয়েছেন কর্মকর্তারা। কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী ক্রেগ উইলিয়ামস এবং লরা সন্ডার্সের ওপরও একই কারণে নজরদারি চালাচ্ছে মেট্রোপলিটান পুলিশ। ঠিক কোন সময়ে হতে পারে ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন, সেই দিনক্ষণ আন্দাজ করেই রমরমিয়ে চলছিল এই জুয়ার আসর, তাও খোদ প্রধানমন্ত্রীর পার্টির থেকেই। এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছেন দলের নির্বাচনি প্রচার কর্মকর্তা টোনি লি। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি তড়িঘড়ি নির্বাচন ঘোষণার নেপথ্যে জুয়াড়িদের হাত রয়েছে? এর আগে একের পর বিতর্কের কারণে দলের ৭৮ এমটি নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘটনা ২৭ বছর আগে ১৯৯৭ সালে ভরাডুবির আগের চিত্রকেও হার মানিয়েছে।
ভোটের আগের কিছু জনমত সমীক্ষায় ঋষি সুনাক ও তার দলের জন্য স্বস্তির ইঙ্গিত নেই। ভোট-সংক্রান্ত অভিপ্রায় ঘিরে সমীক্ষায় দেখা যায়, ভোটাররা কনজারভেটিভদের বিপক্ষের লেবার পার্টিকে ৪৮ পয়েন্ট দিয়েছেন আর কনজারভেটিভদের ২৭ পয়েন্ট দিয়েছেন। ইউগভ/টাইমসের প্রাক্-ভোট সমীক্ষা বলছে, ২০ শতাংশের সমর্থন রয়েছে কনজারভেটিভদের জন্য আর ৪৭ শতাংশ রয়েছে লেবার পার্টির সমর্থনে। সম্প্রতি দ্য টেলিগ্রাফ প্রকাশিত জরিপে দেখা গেছে, নির্বাচনে আসন হারাতে পারেন সুনাক নিজেই। ৬৫০ সদস্যের নিম্নকক্ষ হাউজ অব কমন্সে কনজারভেটিভদের ভাগ্যে জুটতে পারে মাত্র ৫৩টি আসন।
সুনাকের সরকারের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে উঠে আসছে ব্রিটিশ সরকারের কঠোর করনীতি। সাধারণ মানুষের আর্থিক দুর্দশার পাশাপাশি করোনার সময়ে সরকারের পার্টি গেট নিয়েও ক্ষুব্ধ ভোটাররা। ফলে আগামী নির্বাচনে সুনাকের দল আদৌ ক্ষমতায় ফিরতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় বাড়ছে। আরেকটি হলো কনজারভেটিভ পার্টির স্থায়িত্বের প্রশ্ন। লিজ ট্রাসের ৪৯ দিনের সরকার চলার পর প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে তার সরে আসার ঘটনা এর মধ্যে একটি দিক। এদিকে ২০২১ সাল খেকে ব্রিটেনে বহু গড় নির্বাচনে লেবাররাই কনজারভেটিভদের থেকে এগিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ট্রেন্ড চললে ৪ জুলাই ঋষির জন্য কোনো সুখবর আসবে না। যদিও সুনাক বলছেন, ভোটাররা যেন স্টারমারের হাতে ব্ল্যাংক চেক তুলে না দেন। স্টারমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পুনরায় গ্রেট ব্রিটেনকে ফিরিয়ে আনার।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন