বিশ্বে ১ কোটি ৪০ লাখ শিশু অপুষ্টির মুখে, মৃত্যুঝুঁকি আছে: ইউনিসেফ
সাহিত্যিক যাত্রার শুরু এবং কাশবন পত্রিকার সম্পাদনার পিছনে অনুপ্রেরণা
নুষকে আনন্দ দেবার জন্য লেখা উচিত
"মানুষকে আনন্দ দেবার জন্য লেখা উচিত। লিখেই ছাপানোর জন্যে ব্যস্ত হবেন না। লেখাটা ফেলে রাখুন, আবার পড়ুন, নাড়াচাড়া করুন, সম্পাদনা করুন, সংশোধন করুন। ধৈর্যের সাথে শব্দ গোছানোর সাধনা করে তারপর ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেন। লেখককে পড়তে হবে, জানতে হবে আগে। বিশেষ করে যারা নিউইয়র্কে সাহিত্যচর্চা করেন তাদের অফুরন্ত সুযোগ আছে। পড়ার মাধ্যমে নিজেকে ঋদ্ধ করে তারপর লেখার মাধ্যমে উদ্গীরণ করতে হবে"- বই, প্রকাশনা, লেখক ও পাঠক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলেছেন আমিনুল ইসলাম।
গত ১১ জুলাই, বৃহস্পতিবার, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক সম্প্রচার 'টক অব দ্য উইক' অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আমিনুল ইসলাম। এবারের উপস্থাপনায় ছিলেন, বরাবরের মতই 'টক অফ দ্য উইক' এর কারিগরি সহযোগিতায় থাকা এইচ বি রিতা।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই আমিনুল ইসলামের সংক্ষেপ পরিচয় তোলে ধরেন এইচ বি রিতা। আমিনুল ইসলামের জন্ম টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে- বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ করেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে 'কাশবন' নামে অগ্রসর সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারোটি। আমিনুল ইসলাম এর প্রকাশিত প্রথম ও সমাদৃত গবেষণা গ্রন্থ মরমী কবি 'আজহার বয়াতির জীবন ও গান।' ইরাক যুদ্ধের সময় বের হয় 'আগ্রাসন রুখে দাঁড়াও, মার্কিন পণ্য বর্জন কর।' 'কাশবন প্রকাশন' নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান-পরিচালনা করেন তিনি।আমিনুল ইসলাম বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য। কবি জসিম উদদীন একাডেমি, ধারণী সাহিত্য সংসদ এর-সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চলচিত্র ফিল্ম সোসাইটির ফাউন্ডার-ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি নজরুল একাডেমি, আলহেরা একাডেমি, কুদরত হোসনে আরা ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, মোজাম্মেল হক স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন।
আমিনুল ইসলামের কাছে শুরুতেই 'কাশবন প্রকাশন' সম্পর্কে জানতে চান এইচ বি রিতা। তিনি কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার দুই লাইন পাঠের মাধ্যমে শুরু করেন,
"তোমার দেখা পেয়ে, তোমার হাতে বন্দী আমার ভালোবাসার কাশ/ তাইতো আমি এই শরতে তোমার ক্রীতদাস।"
আমিনুল ইসলাম বলেন, "আমার জন্মস্থান নাগরপুর গ্রামের একদিকে ধলেশ্বরী, যমুনা। অন্যদিকে কালীগঙ্গা ও ইছামতী নদী। নদীর পাড়ের কাশবন, যার সাদা পালকের মতো পূর্ণ শোভা দেখা যেত শরৎকালে। এভাবেই কাশবন নামের একটা সাহিত্য পত্রিকা শুরু করি। ১৯৮৪ সালে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের প্রেরণাতে এবং তার লেখা প্রথম প্রকাশনার মাধ্যমে এই কাশবন প্রকাশন শুরু করি। পরবর্তীতে আমাদের প্রকাশনা থেকে পাঁচশর বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হচ্ছেন বিখ্যাত তাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, প্রাবন্ধিক বদরুদ্দীন ওমর।"
সাহিত্যিক যাত্রার শুরু এবং কাশবন পত্রিকার সম্পাদনার পিছনে অনুপ্রেরণা সম্পর্কে আমিনুল ইসলাম জানান, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আমি পড়াশোন করেছি। আমার সহপাঠী ছিলেন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, আলী ইমাম, নজরুলগীতি শিল্পী শবনম মুশতারী, কবি শামীম আজাদ। ছাত্র থাকা অবস্থায় শিক্ষকদের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যারের অনুপ্রেরণায় কাশবন পত্রিকা বের করি। মুদ্রণ থেকে শুরু করে সব বিষয়ে তিনিই আমাকে ধারণা দিয়েছিলেন।"
আমিনুল ইসলামের প্রথম গবেষণাগ্রন্থ 'মরমী কবি আজহার বয়াতির জীবন ও গান'।
এই গ্রন্থ লেখার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, "এটি একটা গবেষণাগ্রন্থ, ২০১১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। মরমী কবি আজহার বয়াতি আধ্যাত্মিক বা মরমী সাধক ছিলেন, তবুও তার লেখাতে কিছু সামাজিক বিষয় এসেছে। তারমধ্যে নাগরপুরের জমিদার বাড়ি নিয়ে পরিপূর্ণ একটা চিত্র আছে। এই সাধকের যখন সন্ধান পেলাম তখন মনে হয়েছিল এই মরমী গানগুলো উদ্ধার করা দরকার। ইতোমধ্যে এই সাধকের প্রতি নজর পড়লো বিখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীনের। আজাহার বয়াতির মেলাতে যোগ দিলেন সেলিম আল দীন। এই মেলাকেই কেন্দ্র করে 'কীর্তনখোলা' নাটকটি রচিত হয়। সেখান থেকে আমি আরো উৎসাহিত হয়েছিলাম।"
এবছর শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বঙ্গ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম। অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে, তিনি বলেন, "শিকাগো'র চুয়াল্লিশতম সম্মেলন একটি বিশাল ব্যাপার ছিল। প্রতিবার প্রায় আট থেকে দশ হাজার লোকের সমাগম হয়। কিন্তু এবারে জায়গার সংকুলান না হবার কারণে সাড়ে তিন হাজারের মতো মানুষ জড়ো হয়েছিল। একই সাথে দশটা ভ্যেনুতে অনুষ্ঠান চলেছে। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার এক আড্ডায় আমার সুযোগ হয়েছিল অংশগ্রহণের। নিউইয়র্কের বইমেলার বাংলাদেশী অংশগ্রহণকারীরা থাকে প্রায় নব্বই ভাগ। কিন্তু শিকাগোতে দেখা গেল বাংলাদেশী কোনো অংশগ্রহণকারী নেই। একটাই বইয়ের দোকান, বিশ্বজিৎ সাহার মুক্তধারা আর কয়েকটা কাপড়ের দোকান। দুই বঙ্গের সম্মেলন হয়েছিল কিন্তু বাংলাদেশে থেকে অংশগ্রহণকারী থাকলে ভালো হতো।"
আমিনুল ইসলাম বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য। বাংলা একাডেমির অবদান ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমি বাংলা একাডেমির সাথে পঞ্চাশ বছর ধরে সদস্য। এদের সাথে থাকার কিছু সুবিধা আছে। প্রতি বছর ডিসেম্বরে একটা সাধারণ সভা হয় যেখানে বাংলাদেশের সব সদস্য কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা সমবেত হন। আমরা সারাদিন একসাথে থাকি, গঠনমূলক আলোচনা করি। এক অসাধারণ সম্মেলনের মাধ্যমে সবার খুব আনন্দে সময় কাটে। তাছাড়া বাংলা একাডেমির প্রকাশিত যে কোনো বই বাংলা একাডেমির সদস্যরা অর্ধেক দামে কিনতে পারেন।বর্তমানে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে পাঁচ হাজার বই আছে।"
পাঠাগার ও পাঠোভ্যাস সম্পর্কে মতামত জানিয়ে তিনি আরো বলেন, "বাংলাদেশের পাঠাগারের খুব সংকট, পাঠাগারের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। আজকাল ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস, ই-বুকের ব্যবহার বেড়ে গেছে, মানুষের পাঠাভ্যাস কমে গেছে। মানুষ ড্রইংরুম সাজানোর জন্যে বই কেনে, পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠার জন্যে নয়। স্বাধীনতার পূর্বে যে পাঠাগার ছিল তা এখন ধ্বংসের পথে। জনগণকে সচেতন হতে হবে, শহরে যে আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটবাড়ি হচ্ছে সেখানেও পাঠাগার স্থাপন করতে হবে।"
আমিনুল ইসলাম তার কাজের জন্যে পেয়েছেন স্বীকৃতি পুরস্কার। এ নিয়ে তাঁর অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, "যে কোনো পুরস্কার লেখককে উৎসাহিত করে। সৃষ্টি যিনি করেন তাকে যদি সেটার স্বীকৃতি দেয়া হয় তাহলে সে উৎসাহিত হয়। তবে পুরস্কার পাবার জন্যে যেন কেউ না লেখে বা কাজ না করে। লেখার প্রতি যত্নবান হতে হবে। কবি-শিল্পী-লেখকের কাছে তাদের সৃষ্টিটাই বড় জিনিস।"
বাংলা একাডেমির একুশে বই মেলা ও জ্যামাইকা বইমেলার অনুভূতি জানিয়ে আমিনুল ইসলাম জানান, "বাংলা একাডেমির বইমেলা এখন বাংলাদেশের মানুষের একটা উপভোগের পর্ব হয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রভাতফেরী করে বাংলা একাডেমিতে এসে আলোচনা সভা হত। পরবর্তীতে চিত্তরঞ্জন সাহা, যিনি চৌমুহনী থেকে ঢাকায় এসে বাংলা একাডেমির বটতলায় মাদুর বিছিয়ে কিছু বই নিয়ে বসেছিলেন। তিনি পুথিঘর করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় চলে যান এবং মুক্তধারা গঠন করেন। স্বাধীনতার পর সেই মুক্তধারা ঢাকায় আসলো, এক পর্যায়ে নিউইয়র্কে আসলো। এই মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের হাত ধরে বিশ্বজিৎ সাহা আজকের এই বাংলা বইমেলা করছে। বাংলা একাডেমির চত্বরে চাদর বিছিয়ে বইমেলার যাত্রা শুরু করেছিলেন, যে বইমেলা আজকের মহীরুহ হয়ে বাংলার অন্যতম মেলায় পরিণত হয়েছে। জায়গার সংকুলান হয় না, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও টইটুম্বুর হয়ে যায়। দর্শনার্থী হয় বটে কিন্তু বই বিক্রয় এবং পাঠের হার অনেক কমেছে। কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের মুল্য বেড়ে গেছে, পাঠক ফিরে যায়, এটা একটা বড় সমস্যা।"
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে দর্শক হিসাবে যুক্ত হোন সোহানা নাজনীন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, "কেউ যদি আপনার প্রকাশনা থেকে বই প্রকাশ করতে চান, তবে সেটার প্রস্তুতি কেমন হতে পারে? আমিনুল ইসলাম জানান, "প্রযুক্তির উন্নতির কারণে আজকাল সবাই ঘরে বসেই বই ছাপাচ্ছে। ত্রিশ চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতায় বলবো এখন দেশ-বিদেশ থেকে সবাই সরাসরি আমাদের কাছে বই পাঠিয়ে দেন। এতে করে আমরা বিব্রত হই। পুরাতন নিয়মে প্রথমে প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি জমা হতো, কয়েকজন সদস্যের তৈরি বোর্ড দ্বারা অনুমোদনের পর সেই বই ছাপা খানায় যাবার অনুমতি পেতো। বাকিগুলো বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করা হতো। আমিও এই পুরানো নীতি অবলম্বন করি। অনেক বই ছাপার জন্যে উদগ্রীব থাকি না, বরং বইটা ছাপানোর আগে ভালোকরে পড়ি। কোন দুর্বল প্রকাশনা যেন না হয়, পাঠকদের কাছে যেন আমরা আদ্রিত হতে পারি। আগে সারাবছর ধরে আমরা বই বের করতাম। এখন নতুন যুগ, সবাই একুশকে কেন্দ্র করে একুশের বইমেলাতে বই বের করার ধুম ফেলে দেয়। এতে করে ভুল করার সম্ভবনা থাকে, প্রকাশকদের এই ব্যাপারে সচেতন থাকা দরকার।"
দর্শকদের পক্ষ থেকে সুমন শামসুদ্দীনের প্রশ্ন ছিল, মরমী গান কাব্যের প্রথম দিকের চর্চা মূলত কোন যুগে শুরু হয়েছিল? আমিনুল ইসলাম বলেন, "চর্যাপদ একধরনের মরমী গান, বাংলার প্রথম চর্যাপদের আবিষ্কার একধরনের গীত। বাউলরা মানবিক কথা বলতে পারেন। লালন ফকিরের ও আজাহার বয়াতির গানে আমরা দেখি যে, তারা মানুষকে বড় করে দেখেছেন। তাদের সাধনা ছিল দেহকেন্দ্রিক, সুতরাং বাউল সাধনার মূল বিষয় শরীর। 'যা আছে বিশ্বভান্ডে তা আছে দেহ ভান্ডে' এই চিন্তা চেতনায় তারা বিশ্বাসী।"
এভাবেই নিজ সাহিত্য যাত্রা, অভিজ্ঞতা, কাজ, ভাবনা ও প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি সমৃদ্ধ করে তোলেন আমিনুল ইসলাম। সবশেষে অতিথি সহ সকল দর্শকের প্রতি ধন্যবাদ ও শুভ কামনা জানিয়ে তথ্যবহুল আলোচনা পর্বটি শেষ করেন উপস্থাপিকা এইচ বি রিতা। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার "টক অফ দ্য উইক" অনুষ্ঠানটি প্রতি বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক সময় রাত নয়টায় ফেসবুক লাইভে সম্প্রচারিত হয়ে থাকে।
সুত্রঃ প্রথম আলো
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন