আটককেন্দ্রে মেক্সিকান অভিবাসীর মৃত্যু, চলতি বছরে আইসিই হেফাজতে ১৪তম প্রাণহানি
কর আইনজীবী কর ফাঁকির অভিযোগে সমালোচনার মুখে
তিনি নিয়মিত করদাতা। বহু বছর ধরে নিজের ও স্ত্রীর নামে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর বা স্থায়ী আমানত রাখছেন কয়েক কোটি টাকা। তবে মেয়াদ পূর্ণ হোক বা না হোক, ৩০ জুনের আগেই সব এফডিআর ভেঙে টাকা তুলে নেন পে অর্ডার আকারে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ফের নতুন এফডিআর খোলেন। যেমন গত ৩০ জুনের আগে শুধু নিজ নামে পৌনে ৯ কোটি টাকার এফডিআর ভেঙে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ১১ কোটি টাকার বেশি এফডিআর করেছেন। বছরের পর বছর এভাবে আয় গোপন রেখে কর ফাঁকি দিচ্ছেন তিনি।
যে করদাতা বছরের পর বছর এমন অস্বাভাবিক কাণ্ড করে চলেছেন, তাঁর নাম নিরঞ্জন ঘোষ। তিনি একাধারে কর আইনজীবী ও অ্যাক্সেসরিজ ব্যবসায়ী। বসবাস ঢাকার খিলগাঁওয়ে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের (আইটিআইআইইউ) অনুসন্ধানে তাঁর ব্যাংক লেনদেনে এমন অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েছে। তাঁর স্ত্রী অন্তরা ঘোষের ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করছেন তিনি।
রাজস্ব গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, নিরঞ্জন ঘোষ তাঁর এফডিআরে অর্থ আয় হিসেবে দেখালে নিয়মিত করহার হবে ২৫ শতাংশ। প্রাথমিক ধারণা, তিনি অন্তত সাড়ে তিন কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়েছেন। এমনও হতে পারে, যে আয় থেকে বিশাল অঙ্কের এফডিআর করছেন, তা বৈধ আয় নয়। উৎস দেখাতে পারবেন না বলে লুকোচুরি খেলছেন। ইতোমধ্যে নিরঞ্জন ঘোষ ও তাঁর স্ত্রীর সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত (ফ্রিজ) করা হয়েছে। এ ছাড়া আয়, সম্পদ ও লেনদেন খতিয়ে দেখতে ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন তথ্য চেয়েছে এনবিআর।
এনবিআর-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আয় গোপন করে কর ফাঁকি দিতেই নিরঞ্জন ঘোষ প্রতিবছর জুন শেষের কর্মদিবসের আগেই এফডিআর ভাঙছেন, যাতে আয়বর্ষের শেষ দিনে তা ব্যাংক হিসাবে প্রদর্শিত না হয়। আয়কর আইনজীবী হওয়ায় তিনি ফাঁকির রাস্তাটি বোঝেন। ফাঁকি দিতে গিয়ে আয়কর রিটার্নে সম্পদ বিবরণীতে পে অর্ডার আকারে থাকা অর্থও প্রদর্শন করেন না। এফডিআর ভাঙানোর সময় ব্যাংক যে উৎসে ১০ শতাংশ কর কেটে নিয়েছে, চূড়ান্ত কর দেওয়ার সময় তা সমন্বয়ের দাবিও করেন না। কারণ আয় গোপন করলেই তাঁর লাভ বেশি।
যেভাবে ধরা পড়লেন নিরঞ্জন ঘোষ
সূত্র জানায়, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে নিরঞ্জন ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী অন্তরা ঘোষের সর্বশেষ ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন যাচাই করা হয়। দেখা যায়, নিরঞ্জন ঘোষ নামমাত্র ব্যক্তিগত আয় দেখিয়েছেন। এ ছাড়া মৎস্য খাত ও ব্যবসা থেকেও নামমাত্র আয় দেখিয়েছেন। তিনি তিন কোটি ১৩ লাখ টাকার নিট সম্পদ দেখিয়েছেন। ব্যাংক হিসাবের ব্যালান্স ‘শূন্য’ দেখানোর ফলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়।
প্রাথমিক অনুসন্ধান দেখা গেছে, নিরঞ্জন ঘোষ চলতি বছরের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সাউথইস্ট ব্যাংক কাকরাইল শাখায় চারটি এফডিআর ভেঙে সুদসহ প্রায় ৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকার পে অর্ডার নেন। এতে তাঁর ব্যালান্স শূন্য হয়ে যায়। এ ছাড়া মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি শাখায় এফডিআর ভেঙে সুদসহ ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার পে অর্ডার নেন। কিন্তু সর্বশেষ করবর্ষের রিটার্নে এফডিআরের বিষয় উল্লেখ করেননি। গত ৭ জুলাই নিরঞ্জন ঘোষ সাউথইস্ট ব্যাংক করপোরেট শাখায় ১১ কোটি ১৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার ১২টি এফডিআর করেন। অর্থাৎ সাউথইস্ট ব্যাংক কাকরাইল শাখা ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে জুনের শেষ সপ্তাহে এফডিআর ভাঙিয়ে নেওয়া পে অর্ডারের টাকার সঙ্গে আরও প্রায় ২ কোটি ৩৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা যোগ করে মোট ১১ কোটি ১৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার এফডিআর করেন নতুন করে। এই টাকা আয়কর আইন অনুযায়ী অপ্রদর্শিত আয় হিসেবে গণ্য।
আইটিআইআইইউর প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এই অর্থের ওপর ২৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য কর হবে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। জরিমানাসহ তা প্রায় চার কোটি টাকা হবে। তিনি ২০২৩-২৪ আয়বর্ষে আয় দেখিয়েছেন ৩২ লাখ ৬৫ হাজার ১০৭ টাকা। এর বিপরীতে আয়কর দিয়েছেন ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৮৫২ টাকা। এ ছাড়া করদাতা নিরঞ্জন ঘোষ রিটার্নে মৎস্য খাতে যে আয় দেখিয়েছেন, তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। পেঁয়াজ আমদানির জন্য অনুমতিপত্র নিয়েছেন। কিন্তু রিটার্নে পেঁয়াজের ব্যবসা সম্পর্কে কিছু উল্লেখ নেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু ২০২৪-২৫ করবর্ষ নয়; করদাতা নিরঞ্জন ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী অন্তরা ঘোষ আগের ৫টি করবর্ষে একইভাবে ব্যাংক হিসাবের ব্যালান্স শূন্য দেখিয়ে আসছেন। এই ছয় করবর্ষের রিটার্ন যাচাই করা হচ্ছে। নিরঞ্জন ঘোষের খিলগাঁও এলাকায় এএএ প্লাস অ্যাক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আয় দেখিয়েছেন প্রায় ৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।
নিরঞ্জন ঘোষের বক্তব্য
নিরঞ্জন ঘোষের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমেই তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, এফডিআরের মূলধনের ওপর কেন কর দিতে হবে? তিনি বলেন, এফডিআর যে কোনো সময় নগদায়ন বৈধ। তা ছাড়া যে পরিমাণ অর্থের কথা বলছে এনবিআর, প্রকৃতপক্ষে এত টাকার এফডিআর নেই। এই এফডিআরের ব্যাখ্যা ও কর দিতে হবে পরবর্তী করবর্ষে। তা ছাড়া ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত কর পরিশোধেরও সময় আছে।
তিনি বলেন, ‘আমি পেঁয়াজ আমদানির জন্য অনুমতি নিয়ে রেখেছি। কিন্তু ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে রাখায় পণ্য আমদানি করতে পারছি না। এভাবে ব্যবসা আটকে রাখা এখতিয়ার-বহির্ভূত কাজ। ব্যবসা চালু না থাকলে দেবেন কীভাবে– প্রশ্ন তাঁর।
আইটিআইআইইউ কমিশনারের বক্তব্য
এ বিষয়ে আইটিআইআইইউ কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রকিব সমকালকে বলেন, রিটার্নে এফডিআর দেখানো নেই। ৩০ জুনের আগে এফডিআর ভেঙে ‘ব্যালান্স শূন্য’ করা হয়। ৩০ জুনের পর আবার সেই টাকা এফডিআর করা হয়। রিটার্নে ব্যালান্স শূন্য দেখিয়ে কর ফাঁকি দিতে অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন এই করদাতা। একজন আইনজীবীর কাছে এমনটা আশা করা যায় না।
আবদুর রকিব বলেন, কর ফাঁকির এই কৌশল সামনে আসার পর তারা করদাতাদের রিটার্ন যাচাইয়ে আরও সচেতন হবেন। তাদের ধারণা, অনেক করদাতা কর ফাঁকি দিতে ৩০ জুনের আগে এমন কাজ করেন।
শেয়ার করুন