ট্রাম্পের আচরণ, ভাষা এবং নৈতিক মান নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ৫ নভেম্বর। কমলা হ্যারিস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের চলমান জড়িপগুলো দেখাচ্ছে-হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে যাচ্ছে দু'জনের মধ্যে। কে হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের আগামীর প্রেসিডেন্ট-এ নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা মুশকিল। তবে আলোচলা সমালোচনার বিরতি নেই।
কমলা হ্যারিস প্রথমবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে হ্যারিসের জনপ্রিয়তা যেমনই থাকুক, তার আচরণ বা নৈতিকতা নিয়ে ট্রাম্পের মতো খুব একটা সমালোচনা নেই। বরং ট্রাম্পের আচরণ, ভাষা এবং নৈতিক মান নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। তার কিছু মন্তব্য এবং আচরণ জনগণের জন্য অপমানজনক। ট্রাম্পের শাসনকালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বেড়ে যাওয়ারও রেকর্ড আছে, বিশেষ করে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হামলার পর। অনেকের মতে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট এবং ট্রাম্পের নেতৃত্বের অযোগ্যতার প্রমাণ।
কিন্তু তারপরও রিপাবলিকান প্রাথমিক ভোটাররা ট্রাম্পকেই আবারো প্রেসিডেন্টশিয়্যাল নির্বাচনের জন্য দাড় করিছেয়েন। এবং ৭৫ মিলিয়ন আমেরিকান, সম্ভবত তারও বেশি, ট্রাম্পের জন্যই ভোট দিতে প্রস্তুত-এমনটাই বলেছেন USA TODAY-এর লেখক, কলামিস্ট নিকোল রাসেল। তিনি নিজেও একজন রিপাপলিকান সমর্থক এবং ক্যাপিটাল হামলার পর থেকে তিনি ট্রাম্পের বিরোধী ছিলেন। তবে তিনি নিজেও ভোট দিতে যাচ্ছেন ট্রাম্পকেই।
ট্রাম্পের মতো এত সমালোচিত একজন প্রার্থীকে কেন আমেরিকানরা ভোট দিকে প্রস্তুত?
অনেকের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিমালা শক্তিশালী।
এই নির্বাচনে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ- বিদেশনীতি, অর্থনীতি এবং সীমান্ত নিরাপত্তা। ট্রাম্প তার প্রথমবার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এই সবকটি বিষয়কে সামলাতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করেন অনেক আমেরিকানরা। যদিও আবার অনেকেই ট্রাম্পের নীতি এবং সিদ্ধান্তগুলিকে মার্কিন অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন, উদাহরণস্বরূপ, তার বাণিজ্য নীতিগুলি এবং ট্যাক্স কাটার সিদ্ধান্তগুলি অনেকের কাছে বিতর্কিত। এছাড়াও ট্রাম্পের বিদেশ নীতিতে কিছু ভোটার অসন্তুষ্ট প্রকাশ করছেন, বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী মনোনীত কামালা হ্যারিসের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অত্যন্ত দুর্বল বলে ভাবছেন অনেকে। যেমন রাসেল বলেছেন, "এরা সম্পূর্ণ সোশ্যালিস্ট ধারণার প্রতিফলন, যার মধ্যে বাড়ির জন্য ডাউন পেমেন্ট বিতরণ এবং একাধিক "বিনামূল্যে" কর্মসূচি রয়েছে। হ্যারিসের পরিকল্পিত বেতনভাতার ভারে আমেরিকা দেউলিয়া হয়ে যাবে।"
বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের অধীনে, মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের উচ্চতায় পৌঁছেছিল, যা দুই বছর আগে ৯.১% ছিল। মুদি পণ্যের দাম, ভাড়া, বন্ধকী হার এবং গাড়ির দাম এখনও উচ্চ। অনেক আমেরিকান প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে নিত্য লড়াই করছেন।
মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত আমেরিকানরা তাদের আয়ের চেয়ে বেশি কর পরিশোধ করছে। বেশিরভাগ পরিবার তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কিছু বাড়তি টাকা রাখতে পারছেন না। এ সময় ট্রাম্পের কর কমানোর উদ্যোগ (পুনরায় নির্বাচিত হলে তিনি আরও বাড়াতে পারেন) অনেকের ভোট পাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
যেমন রাসেল বলেছেন, "আমি আশা করি ট্রাম্প আমদানি পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন না, তবে আমি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে ট্রাম্পের অর্থনীতিকেই প্রাধান্য দেব। ট্রাম্পের শাসনকালে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল, এবং জ্বালানি শিল্পের ওপর বিধিনিষেধ কমানো সবার জন্যই সুফল আনবে।"
পররাষ্ট্র নীতি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল মনে হচ্ছে। ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার সিদ্ধান্তের ফলে আংশিকভাবে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতি যুক্ত করে বিশ্ব পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। বিলিয়নেয়ার হেজ ফান্ড ম্যানেজার বিল অ্যাকম্যানের একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "এগুলি সবই একটি আগুনের জগতে পরিণত করেছে।"
রাজনীতিতে উপলব্ধি বা পার্সেপশন- অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বিষয়, সেক্ষেত্রে ট্রাম্প হ্যারিসের তুলনায় শক্তিশালী নেতা হিসেবে গণ্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অনেকের মতে, ট্রাম্প একজন দক্ষ চুক্তিকারক, আর এটাই বর্তমান বিশ্ব ইতিহাসের এই মুহূর্তে আমেরিকার প্রয়োজন। যদি ট্রাম্প ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞাগুলি পুনর্বহাল করেন এবং রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের মধ্যে বাড়তে থাকা জোটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতে পারে।
অনেক আমেরিকান মনে করছেন, মার্কিন দক্ষিণ সীমান্তকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এটি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের অধীনে, ট্রাম্প-যুগের নীতিগুলি বাতিল করা হয়েছিল, যার ফলে প্রায় ৮ মিলিয়ন অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছেন বলে অ্যাক্সিওসের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১.৭ মিলিয়ন মানুষ সীমান্ত টহল বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। এছাড়াও, চোরাচালানকারীরা প্রায় ৫০,০০০ পাউন্ড মরণঘাতী ফেন্টানিল সীমান্ত পার করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এসেছে। বর্তমানে এই ইস্যুটি ট্রাম্পের জন্য একটি সুবিধা। ট্রাম্প জনগণের জন্য যদি আর কিছু নাও করেন, তবু নিশ্চিত যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কল্যাণের জন্য সীমান্ত সুরক্ষিত করবেন।
কামালা হ্যারিসকে অতিমাত্রিক বলে মনে করেন কলামিস্ট রাসেল। তিনি বলেন, "আমি হ্যারিসকে ভোট দিতে পারি না। আমি বুঝতে পারি না কিভাবে এমনকি মধ্যপন্থীরা তাকে সমর্থন করতে পারে। গত চার বছর ধরে ট্রাম্পকে গণতন্ত্র ধ্বংস করার অভিযোগ করার পর, ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হ্যারিসকে প্রেসিডেনশিয়্যান প্রার্থী হিসাবে মনোনীত করেছে, যেখানে তিনি আমাদের বৈধভাবে নির্বাচিত, বয়স্ক এবং দুর্বোধ্য রাষ্ট্রপতিকে প্রতিস্থাপন করে একটিও ডেমোক্র্যাটিক ভোট পেতে ব্যর্থ হন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ছিন্নভিন্ন করেছে ডেমোক্রেটিক পার্টি।"
রাশেল বলেন, "হ্যারিসের আসল বিশ্বাস বোঝা কঠিন। তার মে কৌশলীগুলি মারাত্বক। তবে তার মতামত স্পষ্ট হলেও, তা ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রগতিশীলতার প্রতি প্রবল সমর্থন প্রকাশ করে। হ্যারিস টেক্সাসে গর্ভপাতের প্রসঙ্গ তুলে উপশহরের নারী ভোটারদের ভয় প্রদর্শন করছেন। হ্যারিস
বাইডেনের সঙ্গে মিলে, গত চার বছরে আমেরিকানদের জীবনের মানোন্নয়নে কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।"
এ মাসে গ্যালাপের প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৫২% আমেরিকান মনে করেন তারা এবং তাদের পরিবার চার বছর আগের তুলনায় বর্তমানে খারাপ অবস্থায় আছেন। শুধুমাত্র ৩৯% মনে করেন, তারা ভালো অবস্থানে আছেন; আর ৯% মনে করেন তাদের অবস্থা অপরিবর্তিত।
রাশেল বলেন, "২০২৪ সালে, আমরা এমন একটি জাতি যারা অস্বস্তিকর মুদ্রাস্ফীতির দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কট ভোগ করছি, বেড়ে চলা অসহনীয় ঋণের মধ্যে আছি, যেখানে বিধ্বংসী যুদ্ধগুলো বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হতে পারে। এখন আরও চার বছর একই পথে চলার সময় নয়।"
রাশেল বলেন, "ডোনাল্ড ট্রাম্পতটকে তিন ধরনের মানুষ নির্বাচনে ভোট দেবেন। প্রথম ক্যাটাগরির ভোটাররা হলেন আমার মতো কনজারভেটিভরা যারা ট্রাম্পকে পছন্দ করেন না কারণ আমরা মনে করি তিনি সত্যিকারের কনজারভেটিভ ধারণাগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেন না। আমি তার চরিত্রগত ত্রুটি এবং আইনগত সমস্যায়ও অত্যন্ত বিরক্ত। দ্বিতীয় ক্যাটাগরির ট্রাম্প ভোটাররা হলেন ডান-কেন্দ্রের আমেরিকানরা যারা ডেমোক্রেটিক পার্টির বামপন্থী সংস্করণে তাদের মূল্যবোধ বা ধারণাগুলো খুঁজে পান না, যা হ্যারিস এবং তার সহযোগী মিনেসোটার গভর্নর টিম ওয়ালজ প্রতিনিধিত্ব করেন। ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেওয়ার তৃতীয় পক্ষটি হল-যারা তাকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। তারা মনে করেন তিনি নিয়ম ভেঙে ফেলেন, প্রবণতার বিরুদ্ধে যান এবং প্রান্তিক মধ্য আমেরিকান ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করেন।
ট্রাম্প নিজের মালিকানাধীন গলফ কোর্সে সাধারণ মানুষের সাথে সময় কাটান এবং তারপরও ম্যাকডোনাল্ডসের এপ্রন পরে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তৈরির পদ্ধতি শিখেন, এগুলি তার সমর্থকরা পছন্দ করেন। ট্রাম্প যে একজন অঙ্গীকারবদ্ধ, ধারাবাহিক আদর্শবাদী নন, এটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ তারা নিজেও তেমন নন।"
মিলিয়ন মিলিয়ন ভোটার ট্রাম্পের প্রতি আকৃষ্ট হন কারণ তারা মনে করেন ট্রাম্প আমেরিকাপন্থী, সামরিক-পন্থী এবং জীবনপন্থী ট। এই কনজারভেটিভরা—২০২০ সালে ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া ৭৪.২ মিলিয়ন আমেরিকানের অধিকাংশ। তারা ট্রাম্পকে একজন যোদ্ধা, দুইবারের হত্যা প্রচেষ্টার শিকার এবং আমেরিকান স্বপ্নের প্রতীক বলে মনে করেন। এই ভোটারদের জন্য, ট্রাম্পের চরিত্র এবং নেতৃত্বের শৈলী তাদের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিষয়, যা তাদের আশা ও প্রত্যাশার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তারা ট্রাম্পের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ও নিরাপদ আমেরিকার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে চান।
তবে রাসেল বলেন, "বর্তমান প্রেসিডেন্ট যখন আমাদের মধ্যে যারা ট্রাম্পের জন্য ভোট দেবেন তাদের "গার্বেজ" হিসেবে উল্লেখ করেন, তখন তা অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং অপমানজনক।"
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন