যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় মুকুট এনে দিলেন নতুন অলিম্পিয়ান নোয়া লাইলস
যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিন্টার নোয়া লাইলসকে নিয়ে নেটফ্লিকসে কিছু দিন আগে একটা ফিচার তৈরি করা হয়েছিল। লাইস সেখানে জানিয়েছিলেন তিনি অলিম্পিকে শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে চান। তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কেউ থাকবে না। বেগুনি রঙের ট্র্যাকের রাজা হতেই প্যারিসে যাবেন। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে লাইলস দেখালেন, তিনি যা বলেছিলেন সেটাই করে দেখালেন। পরশু রাতে প্যারিসের স্তাদে দি ফ্রান্সে প্রায় ৭০ হাজার দর্শকের সামনে নিজেকে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। ১০০ মিটারে স্বর্ণ পদক জয় করে দেখিয়ে দিলেন, তিনি যা বলেছিলেন সেটাই করেছেন। ২০ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রকে হারানো মুকুট ফিরিয়ে দিলেন লাইলস। ২০০৪ অলিম্পিক গেমসে শেষবার ১০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণ জয় করেছিলেন জাস্টিন গ্যাটলিন।
এরপর আর যুক্তরাষ্ট্রকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। জামাইকান স্প্রিন্টার উসাইন বোল্টের অলিম্পিকের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের চেয়ারটা দখল করে রেখেছিলেন। তার সঙ্গে কোনো অলিম্পিয়ান পেরে উঠছিলেন না। সবাইকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন উসাইন বোল্ট। বেইজিং অলিম্পিক, লন্ডন অলিম্পিক এবং রিও অলিম্পিকে বোল্ট সবাইকে উড়িয়ে দিয়েছেন। টোকিও অলিম্পিকে ইতালীয়ান স্প্রিন্টনার মার্সের জ্যাকব অলিম্পিক জয় করেছিলেন, ১০০ মিটারে। তার পরও যুক্তরাষ্ট্রে সাফল্য পায়নি। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় মুকুট এনে দিলেন নতুন অলিম্পিয়ান নোয়া লাইলস। ২০ বছর অপেক্ষার অবসান। এবার ২০০ ও চার গুনিতক ৪০০ মিটার লড়াইয়ে স্বর্ণ চান। দ্বিতীয় হয়েছেন উসাইন বোলেটর দেশ জামাইকার কিশানে থম্পসন। নোয়া লাইলস এবং কিশানে থম্পসন একই সময় দৌড় শেষ করেছেন। দুই জনের মধ্যে সমান সমান টক্কর হয়েছিল। দুই জনেরই টাইমিং ছিল ৯.৭৯ সেকেন্ড।
কিন্তু বিচারকরা বিজয়ী নির্ধারণের জন ১ সেকেন্ড ভাগ করলেন, সেই হিসাবে নোয়া লাইলসের টাইমিং হয় ৯.৭৮৪ এবং কিশানের টাইমিং ধরা হয় ৯.৭৮৯। দশমিক ০০৫ সেকেন্ড ব্যবধানে স্বর্ণ পদক বিজয়ী ঘোষণা করা হয় নোয়া লাইলসকে। স্প্রিন্ট শেষ হওয়ার পর ফটো ফিনিশে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এত কম ব্যবধানে অলিম্পিক স্প্রিন্টারে জয় আগে দেখা যায়নি। এই ঘোষণার আগেই স্বর্ণ জয়ের আনন্দে ভাসতে থাকেন ফুর্তিবাজ নোয়া লাইলস। তার শরীরিক ভাষা যেন আগুনের ফুলকি। পরতে পরতে আত্মবিশ্বাসের ঢেউ জেগে উঠছিল। অলিম্পিক গেমসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। এই ফাইনাল ইভেন্ট বাংলাদেশ সময় রাত দেড়টায় শুরু হয়।
ইভেন্ট শুরু হওয়ার আগে স্টেডিয়ামে সব বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। অন্ধকার হয়ে যায় স্টেডিয়াম। আকাশে নিরাপত্তার জন্য উড়তে থাকা দুটি হেলিকপ্টার পরিষ্কার দেখা যায়। স্টেডিয়ামের ভেতরে লাল নীল বাতি জ্বলতে শুরু করে। মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে স্টেডিয়ামের রং সেকেন্ডে সেকেন্ড বদলে যায়। হাতে হাতে মোবাইল ফোনগুলো রোমাঞ্চকর ছবিগুলো ভিডিও করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রঙ্গিন হয়ে ওঠে ৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালের ঐতিহাসিক স্টেডিয়াম। ২৭ বছরের তরুণ নোয়া লাইলস যখন স্তাদে দি ফ্রান্সে প্রবেশ করেন, এক দৌড়ে ট্র্যাকের মাঝখানে চলে গিয়েছিলেন। সব সময় চমক দিতে ভালোবাসেন তিনি। সেটাই করেছিলেন। স্বর্ণপদকটা জয় করেই চলে গেলেন গার্লফ্রেন্ডের দিকে। জামাইকান অ্যাথলেট জুলিয়ান ব্রমফিল্ডের কাছে। জুলিয়ান টোকিও অলিম্পিক গেমসের পদক জয়ী অ্যাথলেট। সেখানেই ছিলেন লাইলসের মা। তাদের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন লাইলস। লাফাতে লাফাতে লাইস গেলেন মিকসড জোনে। কথা বললেন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকদের সঙ্গে।
সেখানেই এসেছিলেন আরও এক ব্যক্তি। খুশিতে টগবগ করছিলেন। সাদা রঙের মানুষ, সাদাচুল, হাত উঁচিয়ে লাইলসকে ডাকলেন। লাইলস ছুটে আসার জন্য সাংবাদিকদের কাছে বিদায় চাইলেন। ইত্তেফাক প্রশ্ন করেছিল সেই মানুষটিকে 'আপনি লাইলসের বন্ধু কিনা। তিনি জবাব দিলেন, আমি লাইলসের কোচ ল্যান্স ব্রাউম্যান।' লাইলস এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। বারবার একজন আরেক জনকে জড়িয়ে ধরে হাসছিলেন, আবেগে ভাসছিলেন। ক্যামেরাগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ল ছবি তোলার জন্য।
শ্বাসরুদ্ধকর লড়াইয়ে শেষে সংবাদ সম্মেলনেও লাইলস যেন একই ছবি। প্রশ্নের জবাবগুলো দিয়েছেন হাসতে হাসতে বলছিলেন, 'আমি জানতাম, আমাকে হারানো কঠিন হবে। আমি এসেছি রেকর্ড গড়তে। আমার আরও যেসব ইভেন্ট রয়েছে সেখানেও আমি জিততেই থাকব। অন্যরা তাকিয়ে দেখবে।'
তবে অবাক করা বিষয় রিও অলিম্পিকে উসাইন বোল্টের সংবাদ সম্মেলনে হল ভর্তি সাংবাদিক ছিলেন। প্রবেশপথে দুয়ারেও দাঁড়িয়ে ছিলেন সাংবাদিকরা। আর লাইলসের সংবাদ সম্মেলনে যে কেউ প্রশ্ন করতে পেরেছেন এবং হলের চার ভাগের তিন ভাগই ফাঁকা ছিল। উসাইন বোল্টের উত্তরাধিকার হতে যাচ্ছেন কিনা, সেই প্রসঙ্গ নিয়ে এখনই কথা বলতে রাজি না লাইলস। এখন তিনি নোয়া লাইলসকে উপভোগ করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে লাইলসের ডান পাশে বসা ছিলেন রৌপ্য পদক জয়ী জামাইকার কিশানে থম্পসন আর বাম পাশে ব্রোঞ্জ পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রেড কার্লি, যিনি ব্রোঞ্জ জয় করেছেন ৯.৮১ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে।
এই ফ্রেড কার্লি টোকিও অলিম্পিকে রৌপ্য জয় করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে বেরিয়ে গেলেন ১০০ মিটারে পদক জয়ী তিন অ্যাথলেট নোয়া লাইলস, জামাইকার কিশানে থম্পসন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রেড কার্লি। তখনও তাদের পেছনে পেছনে ক্যামেরা। স্টেডিয়ামের বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ডোপ টেস্ট রুমে যাচ্ছিলেন। লিফটে উঠার আগে রৌপ্য জয়ী জামাইকার কিশানে থম্পসনকে জড়িয়ে ধরে সরি বললেন স্বর্ণ জয়ী নোয়া লাইলস। কেউ গিয়েছিলেন সেলফি তুলতে কিন্তু পাত্তা দেননি লাইলস। কোচ এবং লাইলস দুই জনেই এক সঙ্গে নো, নো, নো-সেলফি প্লিজ।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন